দুই আঙুলের পরীক্ষা নিষিদ্ধ
১৩ এপ্রিল ২০১৮ধর্ষণের শিকার নারীর ভার্জিনিটি বা ‘সতীত্ব’ পরীক্ষার নামে ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ শুধু নিষিদ্ধই নয় আদালত অনুসরনীয় আট ধরনের নির্দেশনাও দিয়েছে৷ সরকার ঘোষিত ‘হেলথ কেয়ার প্রটোকল’ পুরোপুরি অনুসরণের কথাও বলা হয়েছে৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্র ( আসক)-এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রথম কাজ হলো এটা ব্যাপকভাবে প্রচার করা৷ সবাইকে জানিয়ে দেয়া৷ যাঁরা ধর্ষণ মামলার শারীরিক পরীক্ষা এবং তদন্তের সঙ্গে জড়িত, তাঁরাই যদি এটা না জানেন, তাহলে দেখা যাবে পুরনো আইনেই তাঁরা কাজ করছেন৷ আর এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক৷ না নিলে আদালতকে আবার ব্যবস্থা নিতে হবে৷’’
২০১৩ সালে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্র্যাক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও নারীপক্ষ ধর্ষণের শিকার নারীর ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ বাতিলের আবেদন জানিয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে৷ শুনানির পর তখন আদালত ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ কেন অবৈধ হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করে৷ পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচিবকে নারী ও শিশুধর্ষণ ঘটনার পরীক্ষার বিষয়ে নীতিমালা প্রনয়ণ করে তিন মাসের মধ্যে দাখিল করতে বলা হয়৷ এ নির্দেশের পর সরকার হেলথ কেয়ার প্রটোকল নামে একটি গাইডলাইন তৈরি করে৷
বৃহস্পতিবার আদালত রুল নিষ্পত্তি করে ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করে রায় দেন৷ বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি একেএম সাহিদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায়ের সঙ্গে আট ধরনের নির্দেশনা দিয়েছেন৷ তার মধ্যে রয়েছে:
ক. ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর পরীক্ষা একজন নারী চিকিৎসক বা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দিয়ে করাতে হবে৷ এ সময় একজন নারী গায়নোকোলজিস্ট, একজন নারী ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, ভিকটিমের একজন নারী আত্মীয়, একজন নারী পুলিশ সদস্য ও নারী সেবিকা রাখতে হবে৷
খ. ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ যে সনদ দেবেন, তাতে অভ্যাসগত যৌনতা বলে কোনও মন্তব্য করা যাবে না৷ পরীক্ষার পর ধর্ষণের শিকার নারীর যাবতীয় গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে৷ বিচারাধীন মামলায় নিম্ন আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণকালে নারীকে অমর্যাদাকর কোনও প্রশ্ন করা যাবে না৷
গ. যদি ধর্ষণের শিকার নারীর আঘাত বা ক্ষত গভীর থাকে, সেক্ষেত্রে একজন গায়নোকোলজিস্টের কাছে তাঁকে পাঠাতে হবে৷ এক্ষেত্রে ঠিক কোন কারণে ওই গভীর ক্ষতের পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে, তা লিখতে হবে৷ কোনও আঘাত বা ক্ষত না থাকলে ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীর ক্ষেত্রে স্পার্স স্পেক্যুলাম দিয়ে (এক ধরনের যন্ত্র, যা দিয়ে যৌনাঙ্গ এলাকায় পরীক্ষার করা হয়) পরীক্ষা করা যাবে না৷
ঘ. হেলথ কেয়ার প্রটোকল ব্যাপকভাবে প্রচার এবং সংশ্লিষ্টদের কাছে, বিশেষ করে চিকিৎসক, আদালত, পাবলিক প্রসিকিউটর (নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল), ধর্ষণ মামলায় পুলিশের সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা, আইনজীবীর কাছে সরবরাহ করতে হবে৷ একইসঙ্গে হেলথ কেয়ার প্রটোকল বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সেমিনার করতে হবে৷
ব্লাস্টের আইনজীবী শারমিন আক্তার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এই আইনটি আগে ছিল না৷ কিন্তু ১৯৭০ সালে কিভাবে যে আইনটি ঢুকে যায় তা আমরা জানি না৷ হাইকোর্টের আদেশে একদম সুনির্দিষ্ট করে বলে দেয়া আছে, কিভাবে পরীক্ষা এবং তদন্ত করতে হবে৷ কী ধরণের কিট ও ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার করতে হবে৷ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যাতে এটা কার্যকর করা যায় তারও বিকল্প ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে৷ যদি নারী গায়নোকলজিস্ট না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে পুরুষ গায়নোকলজিস্টের সহায়তা নেয়া যাবে৷ কিন্তু সরকারের উচিত হবে গত বছর তারা যে হেলথ কেয়ার প্রটোকল করেছে, তা পুরোপুরি অনুসরণ করা৷ সেটা করতে যা যা করণীয়, তার ব্যবস্থা নিতে হবে৷’’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘টু ফিঙ্গার টেস্ট করা হতো ভার্জিনিটি পরীক্ষার জন্য৷ এটার আসলে কোনো প্রয়োজন ছিল না৷ কারণ, ধর্ষণের সঙ্গে ভার্জিনিটির কোনো সম্পর্ক নাই৷ একজন বিবাহিত নারী ধর্ষণের শিকার হতে পারেন৷ একজন যৌনকর্মীও ধর্ষণের শিকার হতে পারেন৷ এটা ছিল নারীর জন্য এক অবমাননাকর পরীক্ষা৷’’ তিনি বলেন, ‘‘ভারতে ২০১৩ সালে টু ফিঙ্গার টেস্ট নিষিদ্ধ করা হয়৷ কিন্তু আমাদের দেশে ছিল৷ আর এটার মাধ্যমে প্রমাণের চেষ্টা চলতো নারী হেবিচুয়েটেড কিনা৷ এখন আদালতের রায়ের মাধ্যমে তা বিলোপ হলো৷ এটা নারীর মর্যাদা রক্ষার জন্য বড় প্রয়োজন ছিল৷’’
সুলতানা কামাল বলেন, ‘‘আমরা এই অমর্যাদাকর ও মধ্যযুগীয় আইন বাতিলে দীর্ঘদিন চেষ্টা করে সফল হয়েছি৷ এটা একটা যুগান্তকারী রায়৷ এখন এটা কার্যকরে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে৷’’