বিধিনিষেধ শিথিল করার তিনদিনের মধ্যেই জার্মানিতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের হার লাফিয়ে বেড়েছে৷ এমন অবস্থায় রোগীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দিয়েছেন দেশটির বিজ্ঞানীরা৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীরা এখন গড়ে একের বেশিজনকে সংক্রমিত করছেন৷ দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান রবার্ট কখ ইনস্টিটিউট-আরকেআই শনিবার জানিয়েছে সংক্রমণের হার এক দশমিক একে পৌঁছেছে৷ বুধবার পর্যন্ত এই হার ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ছয়-পাঁচ৷
জার্মানির সরকারের লক্ষ্য ছিল এটি একের নিচে রাখা৷ অর্থাৎ আক্রান্তরা যেন গড়ে একজনেরও কম মানুষকে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত করেন৷ যাতে স্বাস্থ্য সেবার উপরে মাত্রাতিরিক্ত চাপ না পড়ে৷
এর আগে এপ্রিলের মাঝামাঝিতে জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল সংক্রমণের হারের বিপরীতে দেশটির স্বাস্থ্য সেবার সক্ষমতার চিত্র তুলে ধরেন৷ তিনি বলেন, এই হার যদি এক দশমিক এক হয় তাহলে বিদ্যমান স্বাস্থ্য সেবার সক্ষমতার সবটা ব্যবহারে অক্টোবর পর্যন্ত সময় পাওয়া যাবে৷ এটি যদি ২০ ভাগ বেড়ে এক দশমিক দুই হয় তাহলে জুলাইতেই স্বাস্থ্যসেবার সবটুকু সক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে৷ সংক্রমণের হার এক দশমিক তিন হলে সেটি আরো এগিয়ে জুনে চলে আসবে৷
কড়াকড়ি উঠে গেলেও জার্মানিতে কী কী বন্ধ থাকবে?
করোনা সংকটের কারণে জার্মানিতে কড়াকড়ির মেয়াদ আপাতত ৩ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে৷ এই সময়ে বা তারপরেও কিছু ক্ষেত্রে বাধানিষেধ তুলতে চাইছে না সরকার৷ এমনই কিছু দৃষ্টান্তের দিকে নজর দেওয়া যাক৷
ছবি: JACQUES COLLET/AFP/Getty Images
কমপক্ষে দেড় মিটার দূরত্ব
সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে প্রকাশ্যে মানুষের মধ্যে কমপক্ষে দেড় মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে৷ একা, দুইজন অথবা পরিবার বা বাসার অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে বার হওয়ার অনুমতি রয়েছে৷ সব ক্ষেত্রেই কড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে৷ করোনায় আক্রান্ত কোনো মানুষ যাতে বড়জোর একজনের বেশি মানুষকে সংক্রমিত করতে না পারে, সেই লক্ষ্যেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Sommer
বন্ধ থাকবে কিন্ডারগার্টেন
স্কুলের নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্লাস আবার চালু করার সিদ্ধান্ত নিলেও সরকার এখনো কিন্ডারগার্টেন খুলতে সাহস পাচ্ছে না৷ শিশুদের কাছে সামাজিক দূরত্ব ও কড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রত্যাশা করা কঠিন বলেই মূলত এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পেশার মানুষ যাতে কাজে যেতে পারেন, সেই লক্ষ্যে তাদের শিশুদের দেখাশোনার জন্য জরুরি ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Fassbender
বার, রেস্তোঁরা খুলছে না
বার বা রেস্তোরাঁর বদ্ধ ঘরে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি বলে এই সব স্থাপনাও আপাতত বন্ধ রাখছে জার্মানির সরকার৷ তবে কিছু রেস্তোঁরা রান্না করা খাবার কেনার ব্যবস্থা শুরু করেছে৷ বাইরে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে অর্ডার দিয়ে মোড়কবন্দি খাবার কিনছেন অনেক মানুষ৷ বাসায় খাবার পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করলেও বাধা নেই৷
ছবি: picture-alliance/D. Kubirski
বড় আকারের অনুষ্ঠানের উপর নিষেধাজ্ঞা
কনসার্ট, উৎসব, খেলার ম্যাচ ইত্যাদি যে সব অনুষ্ঠানে অনেক মানুষের সমাবেশ হয়, সেগুলি আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত বন্ধ রাখছে জার্মানির সরকার৷ ভিড় যেখানে অনিবার্য, সেখানে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা কার্যত অসম্ভব৷ আয়োজকদের পক্ষেও এমন গ্যারেন্টি দেওয়া সম্ভব নয়৷ একই কারণে বন্ধ থাকছে মিউজিয়াম, গ্যালারির মত স্থাপনাও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রার্থনা করা যাবে না উপাসনালয়ে
গির্জা, মসজিদ, সিনাগগ, মন্দির – কোনো ধর্মের মানুষই আপাতত সমবেত হয়ে প্রার্থনা করতে পারবেন না৷ সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্কের পর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে৷ উপাসনালয়ে কড়া বিধিনিয়ম নিশ্চিৎ করে প্রার্থনার ব্যবস্থা করতে পারলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা চিন্তা করবে সরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gentsch
ভ্রমণ, পর্যটনের জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে
ভ্রমণেও বহাল থাকছে নিষেধাজ্ঞা৷ এমনকি দেশের মধ্যে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের কাছে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞাও তুলে নিচ্ছে না সরকার৷ খুব জরুরি ক্ষেত্রে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে৷ পর্যটকের অভাবে বেশিরভাগ হোটেলও বন্ধ থাকছে৷ সীমান্তবর্তী অঞ্চলের নিত্যযাত্রীদের জন্য শুধু কয়েকটি হোটেল খোলা রাখা হচ্ছে৷ তবে ১৪ দিনের কোয়ারান্টিনের নিয়ম মেনে বেশি মানুষ সেই সুযোগ গ্রহণ করছেন না৷
ছবি: JACQUES COLLET/AFP/Getty Images
6 ছবি1 | 6
করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় গত বুধবার ম্যার্কেল নিয়ম কানুনগুলো শিথিলের ঘোষণা দেন৷ তবে শনিবার সংক্রমণের নতুন হারের কথা জানিয়ে সামনের দিনগুলোকে আরো সতর্ক পর্যবেক্ষণে রাখতে বলেছে আরকেআই৷
তাদের হিসাবে শনিবার পর্যন্ত দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৬৯ হাজার ৫৫১ জনে৷ মারা গেছেন সাত হাজার ৩৬৯ জন৷ এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন এক লাখ ৪৩ হাজার ৩০০ জন৷
আরকেআই এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে এখন ১৯ হাজার ৭৩২ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন৷ তাদের মধ্যে ইনটেনসিভ কেয়ার বা নিবিড় পরিচর্যায় রয়েছেন এক হাজার ৬৫০ জন৷ এক হাজার ২২৬ টি ক্লিনিকে আরো বারো হাজার ৯৬ টি আইসিইউ শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে৷
এফএস/এআই (রয়টার্স, ডিপিএ, এএফপি)
করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ১০০ দিন
গত ২৭ জানুয়ারি প্রথম করোনায় সংক্রমিত রোগী পেয়েছিল জার্মানি। সেই থেকে শুরু করোনাবিরোধী লড়াইয়ের ১০০ দিন হয়ে গেল। দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Heimken
প্রথম রোগী মিউনিখে
করোনা সংক্রমণের পর দীর্ঘ চিকিৎসা-পর্ব শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা রোগীটি মিউনিখের।
ছবি: Reuters/F. Bensch
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঘোষণা
চীনে সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় ততদিনে করোনা নিয়ে আতঙ্ক জার্মানিতেও কিছুটা ছড়াতে শুরু করেছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েন স্পান সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, "আমরা সতর্ক এবং প্রস্তুত আছি। আন্তর্জাতিক ও ইউরোপীয় পর্যায়ে এবং সব রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছি আমরা।"
ছবি: AFP/O. Andersen
নির্বিঘ্ন প্রথম মাস
ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত জার্মানিতে জনজীবন একেবারে স্বাভাবিক ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য চলেছে। সীমান্ত খোলা ছিল। নির্বিঘ্নে এবং সফলভাবে শেষ হয়েছে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব বার্লিনালে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক মানুষ অংশ নিয়েছেন সে উৎসবে।
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Kalaene
মার্চেও নিশ্চিন্ত বার্লিন
বার্লিনে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে ২ মার্চ। জার্মানির রাজধানী শহরের যে হাসপাতলে তার চিকিৎসা হয়েছিল, সেখানকার মেডিকেল অফিসার বিষয়টিকে একেবারে পাত্তা না দিয়ে বলেছিলেন, "এটা কাকতালীয় ঘটনা।" ছবিতে মার্চে বার্লিনে অনুষ্ঠিত বুন্ডেসলিগার একটি ম্যাচের দৃশ্য৷
ছবি: Getty Images/Bongarts/M. Hangst
আসল লড়াই শুরু
মার্চ মাসে পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে শুরু করে। বাতিল করতে হয় বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল ট্রাইড শো।
ছবি: picture-alliance/dpa/B.v. Jutrczenka
ম্যার্কেলের সতর্কবার্তা
চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল তখনো চুপ। ১১ মার্চ নীরবতা ভাঙলেন, এক সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট ভাষায় বললেন, এখনই সতর্ক না হলে জার্মানির ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মানুষ করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে।
ছবি: Getty Images/AFP/K. Nietfeld
সীমান্ত বন্ধ, জনজীবনে বিধিনিষেধ
তারপর ধীরে ধীরে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেয় জার্মানি। খাদ্য সামগ্রী এবং জরুরি প্রয়োজনীয় দ্রব্য ছাড়া বাকি সব দোকান, ব্যবসা পতিষ্ঠান বন্ধ করে ঘরের বাইরে চলাফেরায়ও আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা। বাতিল করা হয় খেলাধুলা, সংস্কৃতিসহ সব বিষয়ের সব অনুষ্ঠান।
ছবি: picture-alliance/dpa/CTK/M. Chaloupka
প্রশংসিত জার্মানি
সংক্রমিতের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও জার্মানিতে করোনা সংক্রমণে মৃত্যুহার এখনো কম। এ পর্যন্ত সংক্রমিত হয়েছেন এক লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ, মৃতের সংখ্যা সাত হাজারের কম। মৃত্যুহার কম রাখতে পারায় বিশ্বজুড়ে চলছে জার্মানির চিকিৎসাব্যবস্থার প্রশংসা।
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Heimken
বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা
তবে বন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা বলছে, খুব সতর্ক না হলে সংক্রমণ দশগুণ বেড়ে ১৮ লাখ হয়ে যেতে পারে। সুতরাং, করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইটা হয়তো দীর্ঘই হবে জার্মানিতে।