সমাজ তাঁদের বাঁকা চোখে দেখে৷ তাঁরা যে হিজরা! সরকার বাঁকা চোখটা একটু সোজা করার চেষ্টা করছে৷ নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ৷ মানুষের সমাজে মানুষ অজ্ঞতা, অন্ধতা, কুসংস্কারের কারণে চিরকাল অবজ্ঞা, অবহেলা পাবে তা তো হয় না৷
বিজ্ঞাপন
সাম্প্রতিক কিছু খবরে ট্রান্সসেক্সুয়াল বা ট্রান্সজেন্ডার, অর্থাৎ হিজরাদের প্রতি সরকারের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে৷ প্রথমে হিজরাদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দেয়া হলো৷ তারপর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে এলো হিজরাদের ট্রাফিক পুলিশে নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ৷ হ্যাঁ, একটি মাত্র কাজেই হিজরারা সুযোগ পেতে পারেন৷ উন্নত বিশ্বে এমন খবরে হাসির রোল উঠতে পারে, কেউ কেউ প্রশংসা না করে সমালোচনাও করতে পারেন৷ হিজরাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কেন সব কাজ করার অধিকার নেই – এই প্রশ্নও নিশ্চয়ই তুলবেন অনেকে৷ তবে তাঁরা না বুঝলেও আমরা জানি, বাংলাদেশে একটি ক্ষেত্রেও হিজরাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা সরকারের জন্য রীতিমতো একটা ‘জায়ান্ট স্টেপ'৷
তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত মানুষগুলোকে বঞ্চনার ঘেরাটোপ থেকে তুলে আনার আরেকটি উদ্যোগ শুরু হলো সপ্তাহ খানেক আগে৷ তাঁদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তার স্বীকৃতি দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ এসএমই খাতের আওতায় হিজরাদের ঋণ দেয়ার জন্য ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷ এ নির্দেশ কার্যকর হলে অদূর ভবিষ্যতে হিজরাদের শিল্পোদ্যোক্তার ভূমিকাতেও দেখা যাবে৷ শুধু সুখবর নয়, বাংলাদেশের অগ্রগতির অন্যতম সোপানও হতে পারে এই উদ্যোগ৷
পাকিস্তানের হিজরারা নেচে ভয় কাটান
দিনের বেলা ওয়াসিম সেলফোনের সরঞ্জাম বেচেন৷ রাতে তিনি মহিলা সেজে বিভিন্ন পারিবারিক উৎসবে নাচেন৷ ওয়াসিম হলেন হিজরা, রক্ষণশীল পাকিস্তানে যা এক অনন্ত সংগ্রাম৷ আলোকচিত্রী মুহম্মদ মুহাইসেনের তোলা ছবি৷
ছবি: picture-alliance/AP/Muhammed Muheisen
নিশীথ নর্তকী
রাওয়ালপিন্ডি শহরে আঁধার নেমে এলে ওয়াসিমের মুজরা শুরু হয়৷ ২৭ বছর বয়সি ওয়াসিম নাচেন ‘‘হিজরা’’ হিসেবে, যাকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বলা হয়ে থাকে৷ পাকিস্তানে প্রায় আট লাখ হিজরা আছেন, বলে অনুমান৷ বিয়েশাদি এবং অন্যান্য উৎসবে নাচনেওয়ালি হিসেবে তাঁরা খুবই জনপ্রিয়, কেননা হিজরার নাচ মঙ্গল আনে বলে অনেকের বিশ্বাস৷ কিন্তু শুধুমাত্র সেখানেই হিজরারা গ্রহণযোগ্য৷
ছবি: picture-alliance/AP/Muhammed Muheisen
দিনের আলোয়
পাকিস্তান ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পুরুষদের মহিলাদের বেশ ধারণ করাটা আজও অবাঞ্ছনীয়৷ ওয়াসিম দিনের বেলা সেলফোনের সরঞ্জাম বিক্রি করেন৷ তাঁর সহকর্মী কিংবা বন্ধুবান্ধব ওয়াসিমের নিশীথ জীবন সম্পর্কে কিছুই জানেন না৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Muheisen
ওয়াসিম হলেন রানি
ওয়াসিমের এই দ্বিমুখী জীবনের কারণ হলো: ‘‘নাচনেওয়ালি হিসেবে আমি বেশি রোজগার করি৷’’ বাস্তবিক যাঁরা হিজরা বলে পরিচিত, তাঁদের কাছে জীবন একটা অনন্ত সংগ্রাম৷ যে নর্তকী হিসেবে কাজ করতে পারেন না, তাঁর জন্য বাকি থাকে শুধু পতিতাবৃত্তি৷ সেই সঙ্গে নানা অপমান ও অপব্যবহার – যা ওয়াসিমও খুব ভালোভাবেই চেনেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Muheisen
যখন একা
বহু ধর্মবিশ্বাসী মানুষ ‘‘না স্ত্রী, না পুরুষ’’ এই জীবদের ঘৃণা করেন৷ জঙ্গি ইসলামপন্থিরা প্রকাশ্যেই হিজরাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গীরণ করে থাকে৷ কাজেই হিজরারা থাকেন সঙ্গোপনে, নিজেদের মধ্যে৷ ‘‘আমি রাস্তায় বেরলে মানুষজন হাঁ করে থাকে’’, জানালেন ৪৩ বছর বয়সি বখতাওয়ার: ‘‘আমি যখন অন্য হিজরাদের সঙ্গে নাচি, শুধুমাত্র তখনই আমার নিজেকে নিরাপদ এবং সম্মানিত বলে মনে হয়৷’’
ছবি: picture-alliance/AP/Muhammed Muheisen
স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা
মানুষের চোখ এড়ানোর জন্য হিজরারা শহরের অলিগলিতে আশ্রয় নিয়েছেন, এমনকি নিজেদের সহকর্মী ও পরিবারবর্গের কাছেও সত্তার মহাসত্যটি গোপন রাখেন তাঁরা৷ অথচ ২০১১ সালে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত ‘তৃতীয় লিঙ্গ’-কে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ হিজরারা তাঁদের পাসপোর্টে লিখতে পারেন যে তাঁরা হিজরা; তাঁরা ভোট দিতে কিংবা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন এবং আর পাঁচজনের মতো কাজে যেতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/AP/Muhammed Muheisen
সমানাধিকারের দাবি
২০১৩ সালের সংসদীয় নির্বাচনে বিন্দিয়া রানার মতো প্রার্থীরা প্রথমবারের মতো অংশ নিতে পারেন (ছবিতে ডানদিকে)৷ নির্বাচনে জিততে না পারলেও, রানা সমানাধিকার এবং বৈষম্যের অন্ত ঘটানোর দাবিতে তাঁর বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও-র কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন: কেননা শুধু আইন করে পাকিস্তানের রক্ষণশীল সমাজের মনোভাব পরিবর্তন করা সম্ভব নয়৷
ছবি: picture-alliance/AP/Shakil Adil
টানাপোড়েন
আজও খুব কম মানুষই ৪৪ বছর বয়সি আমজাদের মতো সগর্বে বলতে পারেন: ‘‘নারী হিসেবে একমাত্র কাজ, যা আমি করতে পারি না, তা হল সন্তানের জন্ম দেওয়া৷’’
ছবি: picture-alliance/AP/Muhammed Muheisen
7 ছবি1 | 7
হিজরারা ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে দক্ষতা দেখাতে পারবেন কিনা, ঋণ পেলে শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে সফল হতে পারবেন কিনা – এমন প্রশ্ন এখনো কেউ তুলেছেন বলে শুনিনি৷ সাহসিকতায় তাঁরা অনেকের চেয়েই এগিয়ে – হিজরারা বড় বড় ঘটনায় এমন প্রমাণ রাখার পর এ সব প্রশ্ন তোলার সুযোগ খুব একটা নেই৷ বইমেলায় ব্লগার অভিজিৎকে কুপিয়ে মারার ঘটনা শত শত নারী-পুরুষ চেয়ে চেয়ে দেখেছেন, অভিজিতের স্ত্রী চিৎকার করে সাহায্য চাইলেও শত লোকের ভিড় থেকে একজনও এগিয়ে যাননি৷ অথচ মনে করে দেখুন, আরেক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে কুপিয়ে মারার সময় কাছে ছিলেন একজন লাবণ্য৷ লাবণ্য হিজরা৷ কী সাহসিকতায় তিনি এক হামলাকারীকে হাতেনাতে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তা তো আমরা জানি৷
লাবণ্য নামটি এলে রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা'-র লাবণ্যের কথা মনে পড়ে৷ শেষের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ অবশ্য সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে, অন্য অর্থেই লিখেছিলেন, ‘‘পরমায়ু নিয়ে বেঁচে থাক প্রবীণ অধ্যাপক, প্রবীণ পলিটিশিয়ান, প্রবীণ সমালোচক৷'' সাহসী লাবণ্য সম্পর্কে জানার পর আমি হিজরাদের আরো বেশি করে পরমায়ু কামনা করি৷ নীরব, নিষ্ক্রিয়, আত্মকেন্দ্রিক মানুষের চেয়ে সোচ্চার, সক্রিয়, সাহসী, দরদি মানুষই তো আমাদের বেশি দরকার!