নিয়োগ দুর্নীতিতে উঠে এসেছে দুই নারীর নাম।হৈমন্তী গঙ্গোপাধ্যায় ও সোমা চক্রবর্তী। তাদের নিয়ে হইচই তুঙ্গে।
বিজ্ঞাপন
কোটি কোটি টাকার নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় কেন্দ্রীয় সংস্থা গ্রেপ্তার করে তৃণমূলের যুব নেতা কুন্তল ঘোষকে। হঠাৎই একদিন তিনি হৈমন্তী গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম করেন। তাকে 'রহস্যময়ী' তকমা দেন।
এই দুর্নীতিমামলায় সন্দেহের ঘেরাটোপে আছেন গোপাল দলপতি, তার দ্বিতীয় স্ত্রী হৈমন্তী। যদিও বছরখানেক আগে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা দায়ের হয়েছে বলে হৈমন্তী জানিয়েছেন। তিনি পেশায় মডেল, অভিনেত্রী। কুন্তলের মুখে তার নাম শোনার পর মিডিয়া হৈমন্তীর বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে। তারা জানান, কন্যার সঙ্গে সম্পর্ক নেই।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ অর্পিতার বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা পাওয়া গেছে। অর্পিতা এখনো জেলে। অর্পিতার পর এখন এই দুই নারীকে নিয়ে প্রচুর হইচই হচ্ছে। যত তদন্ত এগোচ্ছে, তত একটা বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে, নিয়োগ দুর্নীতির শিকড় অনেক গভীরে। প্রচুর মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত। তারা চাকরি দেয়ার নামে কোটি কোটি টাকা তুলেছে।
‘অবৈধ টাকা হলে শুধু জানি না বলে রেহাই পাওয়া যাবে না’
বেশ কয়েকদিন হৈমন্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি সংবাদমাধ্যম। এরই মধ্যে নানা তথ্য প্রকাশ পেতে থাকে। গোপালের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে 'নমিনি' হিসেবে রয়েছেন হৈমন্তী। একাধিক জমি ও বাড়ির মালিকানা রয়েছে মডেলের নামে। গোপালের তৈরি করা কয়েকটি সংস্থার ডিরেক্টর পদেও তিনি রয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে।
মিডিয়ার সামনে উপস্থিত হয়ে হৈমন্তী নিজেকে ‘নির্দোষ' দাবি করেছেন। তার বক্তব্য, "নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়ে আমি কিছু জানি না। গোপালের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিইনি। আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা হচ্ছে।"
যে কুন্তল হৈমন্তীর নাম তুলে হইচই ফেলেছেন, তিনিই আবার ব্যাকফুটে সোমা চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে। পার্লার মালকিন সোমাকে দফায় দফায় ৫০ লাখ টাকা দেন কুন্তল। সল্টলেকের অভিজাত মলে তার নেল লাউঞ্জ রয়েছে। তদন্তে এই সংক্রান্ত তথ্য উঠে আসার পর ইডি সোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ফের শুক্রবার তাকে নথিপত্র নিয়ে যেতে হবে ইডি কার্যালয়ে।
সোমা স্বীকার করেছেন, তিনি টাকা নিয়েছেন। তার বক্তব্য, "কুন্তলের সঙ্গে এক বন্ধু মারফত আলাপ হয়। ব্যবসার জন্য আমার টাকার দরকার ছিল। কুন্তল টাকা দিতে রাজি হন।" তবে কুন্তলের সঙ্গে নিয়োগ দুর্নীতির যোগ আছে তা সোমা জানতেন না বলে দাবি করেছেন। কুন্তলকে সোমার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে এড়িয়ে গিয়েছেন।
বিক্ষোভে রাস্তায় চাকরিপ্রার্থীরা, তাদের জীবনে উৎসব নেই
করোনার পর এবার শারদোৎসবে মেতেছে গোটা পশ্চিমবঙ্গ। তবে চাকরিপ্রার্থীরা উৎসবের মধ্যেও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
উৎসবের দিনেও প্রতিবাদ
এক বছর পরেও ছবিটা বদলালো না। ২০২১ সালের দুর্গোৎসবেও ঘরবাড়ি ছেড়ে এভাবেই আন্দোলনের মধ্যে কাটিয়েছিলেন চাকরিপ্রার্থীরা। এই বছরও কাটাচ্ছেন। তারা উৎসবে নেই, প্রতিবাদে আছেন। এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের কাছে উৎসবের আলাদা তাৎপর্য নেই। তাদের দাবি, পরীক্ষা দিয়ে পাস করার পরেও দুর্নীতির জন্য চাকরি পাননি। তাই সকলে যতদিন চাকরি না পাচ্ছেন, ততদিন প্রতিবাদ চলবে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
তিন দফার প্রতিবাদ
এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১৯-এ। তিন দফায় এই আন্দোলনের বয়স আজ সাড়ে পাঁচশ দিন পেরিয়ে গেছে। কলকাতা হাইকোর্ট জানিয়েছে, এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগে দুর্নীতি ছিল। কতজন এইভাবে চাকরি পেয়েছেন তা জানানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ঝড়-জল উপেক্ষা করে
এই কয়েকবছরে গান্ধীমূর্তির পাদদেশের এই ধর্নামঞ্চ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা এই মানুষগুলোর কাছে অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। নেই পানীয় জলের ব্যবস্থা, নেই শৌচাগারও। ঝড়-বৃষ্টি-রোদ উপেক্ষা করে দিনের পর দিন অবস্থান করে চলেছেন এরা। কেউ অসুস্থ বাবা-মাকে বাড়িতে রেখে কেউ বা কোলের শিশুকে সঙ্গে নিয়ে। আন্দোলন এখন এদের জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
উৎসবের দিনেও
গত দুইবছর ধরে ধর্না মঞ্চেই কেটেছে উৎসবের দিনগুলি। দুইটি ঈদ, দুইটি দুর্গাপুজার মত বড় উৎসব এভাবে কেটেছে চাকরিপ্রার্থীদের। বস্তুত তাদের জীবনে উৎসব নেই, আনন্দ নেই, আছে কেবল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে চাকরি পাওয়ার লড়াই।
ছবি: Subrata Goswami/DW
অর্পিতার কাহিনি
পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার অর্পিতা হাজরা। ধর্নামঞ্চে উপস্থিত থাকার জন্য যাতায়াত মিলিয়ে সাতঘণ্টা লাগে অর্পিতার। ভোর পাঁচটায় উঠে রান্না করে তারপর আসেন, আবার বাড়ি ফিরে ১০ বছরের মেয়েকে নিয়ে পড়াতে বসেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আনন্দ নয়, লড়াই
অর্পিতা জানালেন, ''ছোট্টো মেয়েটাকে নিয়ে যখন জামাকাপড়ের দোকানে গিয়ে শপিং করার কথা, পুজোর চারদিন কীভাবে কাটাব সেই পরিকল্পনা করার কথা, সেই সময় বসে রয়েছি রাস্তার ধারে। পুজোটা আমাদের কাছে প্রবল যন্ত্রণার। সকলকে আনন্দ করতে দেখে আরও যন্ত্রণা পাই ভেতরে ভেতরে।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
ঈদও কেটেছে এখানেই
সরকারিভাবে বসতে নিষেধ ছিল, তাও এইবছর দুপুরের পরে এখানে বসেই ঈদ পালন করেছে কামরুজ্জামান, বাড়ির লোকেদের সঙ্গে দেখা করাও হয়ে ওঠেনি। অন্যান্যবার দুর্গাপুজোতেও মুর্শিদাবাদের বাড়ির সামনের পুজোতেই হাজির থাকে কামরুজ্জামান। এইবছর ধর্নামঞ্চেই কাটবে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নিরানন্দ পিঙ্কি
হুগলির পিঙ্কি সাধুখাঁ জানালেন, ''আমাদের এবারের পুজোর দিনগুলো এভাবে কাটার কথা ছিল না। চাকরির নিয়োগপত্র হাতে পেয়ে বাচ্চার হাত ধরে মণ্ডপে মণ্ডপে অনন্দ করে বেড়ানোর কথা ছিল। যেদিন থেকে জানতে পেরেছি আমরা দুর্নীতির শিকার, সেদিন থেকে আমাদের জীবনের আনন্দ চলে গিয়েছে।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
সীমার প্রশ্ন
পুজোমণ্ডপে না গিয়ে কোলের বাচ্চা নিয়ে ধর্নামঞ্চে অবস্থান করছেন সীমা। তিনি বললেন, ''নিজের মনেই যদি আনন্দ না থাকে বাচ্চাকে কীভাবে আনন্দ দেব বলতে পারেন?''
ছবি: Subrata Goswami/DW
উৎসব আর নেই
আশিকুল ইসলাম জানালেন, ''যোগ্য হয়েও চাকরি পাইনি। এই আনন্দে এখন আর কোনও উৎসাহ পাই না। দিনলিপি থেকে মুছে গেছে উৎসব।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
দুর্গারা পথে
মুর্শিদাবাদের রহুল বিশ্বাস বললেন, ''একদিকে দেবী দুর্গা পুজিত হচ্ছেন আর এখানে দুর্গারা বঞ্চিত হয়ে পথের ধারে পড়ে আছে। সরকার চাইলে যেকোনও সময় আমাদের এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
নিরুপায় তপতী
বাড়িতে সন্তানকে রেখে চুঁচুড়া থেকে প্রতিদিন এই ধর্নামঞ্চে আসেন তপতী দাস। পুজোমণ্ডপে গেলেও মন পড়ে থাকবে এই ধর্নামঞ্চে। তিনি জানালেন, ''আমরা নিরুপায়। বাধ্য হয়ে একটা আশা নিয়েই দিনের পর দিন বসে রয়েছি এখানে।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
চোখে জল জয়ন্তের
সাড়ে তিন বছরের বাচ্চা ফোনে তাকে বার বার বাড়িতে আসতে বলছে। বাবার কোলে চড়ে ঠাকুর দেখার বায়না ছোট্ট ছেলেটার। কথাগুলো বলতে বলতে চোখ মুছতে থাকে বীরভূমের জয়ন্ত। ''যখন সারা কলকাতা আলোর রোশনাইতে মেতে উঠেছে, আমরা গান্ধীমূর্তির পাদদেশে, অন্ধকারেই পড়ে আছি। দুইটি পুজো এভাবেই কেটেছে, চাকরির নিয়োগপত্র হাতে না পেলে জীবনের সব পুজো এখানেই কাটাতে পারি।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
নিয়োগপত্র চাই
বনগাঁর সোমা মালাকার বললেন, ''দুর্নীতি করে যারা চাকরি পেয়েছে, তারা আজ পরিবার পরিজন নিয়ে আনন্দে পুজো কাটাচ্ছে। অথচ আমরা যোগ্য হয়েও পথে পড়ে রয়েছি। চাকরির নিয়োগপত্রই আমাদের কাছে পূজার প্রসাদ। যেদিন হাতে পাব সেদিনই আমাদের সত্যিকারের পুজো।'' বললেন, বনগাঁর সোমা মালাকার।
ছবি: Subrata Goswami/DW
14 ছবি1 | 14
তথাকথিত এই 'রহস্যময়ী'দের সঙ্গে দুর্নীতির মাস্টার প্ল্যানের যোগ কতটা আছে? কুন্তল বা গোপালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বা পরিচয়ের সূত্রে এই নারীরা তাদের কাছ থেকে কতটা 'সুবিধা' পেয়েছে? টাকার বিনিময়ে চাকরি দেয়ার চক্রে কি এরা যুক্ত, এই প্রশ্ন উঠছে।
গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির রাজ্য সম্পাদক রঞ্জিত শূর ডয়চে ভেলেকে বলেন, "একজন অভিযুক্ত কি না সেটা বোঝার আগেই তাকে কার্যত দোষী সাব্যস্ত করে দেয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন। হৈমন্তীর ক্ষেত্রে এটা কিন্তু হচ্ছে।"যদিও সোমার বিষয়ে সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, "৫০ লাখ মানে বিপুল টাকা। ব্যবসার জন্য টাকা ঠিকঠাক চুক্তি মেনে নেয়া হয়েছে কি না দেখতে হবে। শুধু জানি না বলে রেহাই পাওয়া যাবে না। বিশেষত এটা যদি অবৈধভাবে তোলা টাকা হয়।"
আজ টলিউড অভিনেতা বনি সেনগুপ্ত ইডি কার্যালয়ে হাজির হন। কুন্তলের সঙ্গে তার আর্থিক লেনদেনের সূত্র মিলেছে বলে খবর।
এই প্রশ্নও উঠছে যে, এই নিয়োগ দুর্নীতির ভবিষ্যৎ কি? অনেকের নামই তো এখানে উঠছে। অনেক তথ্য সামনে আসছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই দুর্নীতির কারিগররা ধরা পড়বে, নাকি সবকিছু ধামাচাপা পড়ে যাবে? শুভাশিসের বক্তব্য, "হাওয়ালা থেকে সারদা মামলার নিষ্পত্তি আজও হল না। কত বড় নেতার নাম উঠে এসেছিল। কিছুদিন পর সব ধামাচাপা পড়ে যায়।"