বিচারপতি রাজকুমার মান্থা জানিয়েছেন, প্রাথমিকে টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট বা টেট পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে ভুল ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখবে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। এই বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করবেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। এক মাসের মধ্যে তারা হাইকোর্টে রিপোর্ট জমা দেবে।
দ্বিতীয় নির্দেশও বিচারপতি মান্থাই দিয়েছেন। খাদ্য দপ্তরের সাব ইন্সপেক্টর নিয়োগ নিয়ে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও দুর্নীতির বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে সিআইডি। আপাতত এই পরীক্ষা ও নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় প্রক্রিয়ার উপর স্থগিতাদেশ জারি করেছেন তিনি।
টেট পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে কী অভিযোগ?
হাইকোর্টে আবেদনকারীরা জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে প্রাথমিকের টেট পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে২১টি প্রশ্নে ভুল ছিল। তাদের দাবি, ওই ২১টি প্রশ্নে ভুলের দায় কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে এবং সবাইকে ২১টি প্রশ্নের ক্ষেত্রে পুরো নম্বর দিতে হবে।
বিচারপতি মান্থা এই আবেদনের জবাবে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। এই কমিটির সদস্য কে হবেন তা ঠিক করার দায়িত্ব দিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতীর উপাচার্যের উপর। একমাসের মধ্যে কমিটির সুপারিশ পাওয়ার পর বিচারপতি এই বিষয়ে তার সিদ্ধান্তের কথা জানাবেন।
এসআই পরীক্ষা নিয়ে
রাজ্য পাবলিক সার্ভিস কমিশন এই পরীক্ষা নেয়। সেখানেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। বিচারপতি মান্থার নির্দেশ, এই বিষয়ে যতগুলি অভিযোগ এসেছে, সবগুলি নিয়ে সিআইডি-র এডিজি তদন্ত করবেন। এখন এই পরীক্ষার ফলপ্রকাশ, নিয়োগ কিছুই করা যাবে না।
কলকাতায় টেট চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের পাঁচশ দিন
পাঁচশ দিন ধরে কলকাতার রাজপথে বসে টেট চাকরিপ্রার্থীরা। রক্ত দিয়ে 'পাঁচশ দিনে'র পোস্টার লিখলেন আন্দোলনকারীরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
লাগাতার পাঁচশ দিন
ঝড়-জল-বৃষ্টি উপেক্ষা করে টানা পাঁচশ দিন ধরে কলকাতার রাজপথে বসে আছেন এই বিক্ষোভকারীরা। চাকরির দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন তারা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
টেট পাস করেও চাকরি নেই
প্রাথমিক স্তরে পড়ানোর জন্য টেট পাস করতে হয় পশ্চিমবঙ্গে। এই চাকরিপ্রার্থীরা টেট পাস করেও চাকরি পাননি। সে কারণেই পাঁচশ দিন ধরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন তারা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মুখে কালি লেপে
মুখে কালি লেপে প্রতিবাদ দেখিয়েছেন চাকরিপ্রার্থীরা। কলকাতা ময়দানে মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তির নিচে বসে আছেন তারা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
নেতাদের কথা
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলের নেতারা এসে দেখা করছেন তাদের সঙ্গে। পাঁচশ দিনের আন্দোলনে মঞ্চে গেছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম।
সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য বয়সের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে। চাকরিপ্রার্থীদের ভয়, এভাবে চলতে থাকলে তাদের বয়স পার হয়ে যাবে। তখন আর নতুন করে চাকরি পাওয়া যাবে না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শিক্ষা দুর্নীতি এবং পশ্চিমবঙ্গ
টেট, এসএসসি-সহ শিক্ষাক্ষেত্রে একাধিক দুর্নীতি নিয়ে নাস্তানাবুদ পশ্চিমবঙ্গ। চাকরিপ্রার্থীরা আলাদা আলাদা জায়গায় আন্দোলনে বসেছেন। এসএসসি-প্রার্থীদের আন্দোলন হাজার দিন পার করেছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
7 ছবি1 | 7
খাদ্য দপ্তরের ৪৮০ জন সাব ইন্সপেক্টর নেয়ার জন্য ২০২৩ সালে বিজ্ঞপ্তি বের হয়। গতবছর অগাস্টে আবেদনপত্র নেয়া শুরু হয়। এই বছর ১৬ ও ১৭ মার্চ নিয়োগ পরীক্ষা হয়। অভিযোগ, পরীক্ষা শুরুর আগে টেলিগ্রাম, হোয়াটস অ্যাপ-সহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায়। প্রায় ১২ লাখ মানুষ সাব ইন্সপেক্টরের চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
এই প্রশ্নফাঁস নিয়ে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছিল। চাকরিপ্রার্থীরা পাবলিক সার্ভিস কমিশন অফিসের সামনেও বিক্ষোভ দেখান।
পুলিশ পরে শিলিগুড়ি থেকে পাঁচজনকে ধরে। অভিযোগ, তারা পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকে প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে তা ফাঁস করেছিল।
এরপর হাইকোর্টে এই পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে আবেদন জানানো হয়। সেই আবেদনের জবাবেই সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি মান্থা। তিনি জানিয়েছেন, ২২ মে-র মধ্যে সিআইডিকে রিপোর্ট জমা দিতে হবে।
আইনজীবীর বক্তব্য
আবেদনকারীর আইনজীবী শামিম আহমেদ বলেছেন, ''এক হাতে টাকা দিন, অন্য হাতে চাকরি নিন নামে একটা হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। সেই অভিয়োগের ভিত্তিতেই হাইকোর্টে মামলা করা হয়। আমাদের দাবি হলো, ওই পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। নতুন করে পরীক্ষা নিতে হবে।''
শামিম টেলিভিশন চ্যানেল নিউজ১৮ বাংলাকে বলেছেন, ''পিএসসি-তে এই অভিযোগ নতুন নয়। এর আগেও আমরা দেখেছি, খালি খাতা জমা দিয়ে মানুষ চাকরি পেয়েছে। হাইকোর্ট সিআইডি-র এডিজিকে তদন্ত করতে বলেছে।''
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেছেন, ''ভারতের নানা রাজ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশে হয়েছে। রাহুল গান্ধী প্রতিবাদ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে। অবশ্যই সিআইডি, সিবিআই তদন্ত হওয়া উচিত।''
উৎসবেও বিক্ষোভকারীদের দিন কাটে রাস্তায়
দিন আসে, দিন যায়। বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় বসে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। তাদের জীবনে উৎসবের স্থান সীমীত। বিক্ষোভস্থলে বসেই পুজোর দিন কেটে যায়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিক্ষোভের মাধ্যমেই পুজো কাটে
প্রায় তিন বছর ধরে তারা রাস্তায়। শিক্ষক হওয়ার পরীক্ষায় পাস করার পরেও তারা কেউ চাকরি পাননি। অভিযোগ, দুর্নীতি করে অন্যরা কম নম্বর পেয়েও চাকরি পেয়ে গেছে। তারা এখন 'কেয়ার অফ রাস্তা'। বিক্ষোভ দেখিয়েই দিন কাটছে। এবারের দুর্গাপুজোও তাদের কেটে গেল বিক্ষোভ দেখিয়েই।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পুজোর দিনেও
পুজোর দিনেও বসে তারা পোস্টার লিখেছেন। লিখেছেন, কত দিন ধরে তারা এখানে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। দশমীর দিন বসে বসে পোস্টারে সেটাই লিখছিলেন এক বিক্ষোভকারী, তাদের বিক্ষোভ ৯৫৪ দিনে পড়লো।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিক্ষোভস্থলে দুর্গার ছবি
এবার বিক্ষোভস্থলে দুর্গার ছবি নিয়ে এসেছিলেন বিক্ষোভকারীরা। সেখানেই তারা প্রণাম জানিয়েছেন। আর বিষণ্ণ মনে বিক্ষোভ দেখিয়ে গেছেন এই আশা নিয়ে যে, কোনো একদিন তারাও ন্যায় পাবেন। চাকরি পাবেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শিউলি ফুলের অঞ্জলি
বিক্ষোভকারীরাই নিয়ে এসেছিলেন শিউলি ফুল। সেই ফুল হাতে নিয়েই দুর্গার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সেই ফুল রাখলেন ছবির সামনে। সেই সঙ্গে ন্যায় পাওয়ার প্রার্থনাও করলেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মালা বানাচ্ছেন কেউ
কিছু বিক্ষোভকারী মালা তৈরি করেছিলেন। সেই মালা বিজয়া দশমীর দিন তারা পরিয়ে দিলেন মূর্তিতে। এভাবেই পূজোর দিনগুলো কাটলো তাদের।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ডিএ-র দাবিতেও আন্দোলন চলছে
শুধু চাকরিপ্রার্থীরাই নয়, ডিএ-র দাবিতে আন্দোলন করছেন সরকারি কর্মীরা। তারাও পুজোর দিনগুলি কাটিয়েছেন রাস্তায় বিক্ষোভ দেখিয়ে। উৎসব তাদের কাছে আর রঙিন নয়। তাদের বক্তব্য, আন্দোলনের পথ কঠিন। সেই পথে থাকতে গেলে ধৈর্য দরকার।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কেন উৎসবেও আন্দোলনে?
আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, আন্দোলন একবার শুরু করলে তা আর মাঝপথে ছেড়ে দেয়া যায় না। তখন উৎসবের দিনেও বিক্ষোভ বন্ধ রাখা যায় না। রাস্তায় একবার নেমে পড়লে সেখানে থাকতে হয়। সেজন্যই দুর্গাপুজোয় যখন সকলে মেতে উঠেছে, তখন তারা বিক্ষোভ দেখিয়ে গিয়েছেন নিজেদের মতো করে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
তিন বছর ধরে এভাবেই
স্কুল সার্ভিস কমিশনে চাকরির পরীক্ষাতে পাস করেও নিয়োগ পাননি মারুফা বানু। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেছেন, ''তিন বছর ধরে উৎসেবর মরশুম এভাবেই কাটছে। আমরা না ঘুরতে যেতে পারি। না আমরা নতুন পোশাক কিনি। আমাদের জীবনে উৎসবের কোনো রং নেই।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'আনন্দ আসবে কী করে'
বিক্ষোভকারী দীপ্তি হালদারের বক্তব্য, ''পুজোর পাঁচ দিন নিরানন্দে কেটেছে। পরিবারের সঙ্গে ভালো করে পুজো দেখতে পারিনি। চাকরি থাকলে তবে তো আনন্দ করার কথা আসে। দুর্গাপুজোয় এটাই প্রার্থনা করি, আমাদের আর্থিক অবস্থা যেন ঠিক হয়। চাকরি যেন হয়।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ইচ্ছেই নেই'
টেট পাস প্রার্থী, পিয়ালী প্রামাণিক জানিয়েছেন, ''আমাদের ইচ্ছেটাই চলে গেছে। আমাদের একটাই প্রার্থনা, একটাই প্রশ্ন, একটাই দাবি, আমাদের চাকরিতে নিয়োগ কবে হবে?''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
এইভাবে কতদিন?
কতদিন এইভাবে বিক্ষোভ দেখাতে হবে, সেই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই আন্দোলনকারীদের কাছে। আর কত বছর এইভাবে উৎসবের দিন ফুটপাথে বসে কাটাতে হবে, তাও তারা জানেন না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
11 ছবি1 | 11
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ''খাদ্য দপ্তরের সাব ইন্সপেক্টর নিয়োগের পরীক্ষাতেও প্রশ্ন ফাঁস এবং সেখানেও দুর্নীতি। আদালত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। যুবকরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেছে। তারা এই দুর্নীতি মানবে না।''
তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ জানিয়েছেন, ''এটা'আইনি বিষয়। আদালতের বিচারাধীন বিষয়। যে দপ্তরের বিষয়, তাদের আইনজীবীরা বিষয়টি দিখছেন। এই মুহূর্তে দলের তরফ থেকে কোনো মন্তব্য করব না।''
নিয়োগে এত দুর্নীতির অভিযোগ কেন?
নিয়োগ-দুর্নীতি ও প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে পরপর তিনটি নির্দেশ দিলো কলকাতা হাইকোর্ট। এসএসসি দুর্নীতি মামলায় প্রায় ২৬ হEজার জনের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারপর টেটের প্রশ্নপত্রে ভুল ও সাব ইন্সপেক্টর নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও দুর্নীতি নিয়ে দুইটি নির্দেশ দিয়েছে তারা।
প্রবীণ সাংবাদিক আশিস গুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। পরিস্থিতি একটা মাত্রাছাড়া জায়গায় চলে যাচ্ছে। একে রাজ্যে শিল্প নেই। তার উপর শিক্ষক ও অন্য সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি সমানে এরকম দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তাহলে বুঝতে হবে, পরিস্থিতি মারাত্মক।''