নুসরাত থেকে আলিয়া ভাট: অর্ধেক বিজ্ঞাপন তুমি অর্ধেক কল্পনা
২০ সেপ্টেম্বর ২০২১দু'দিন যেতে না যেতেই আবার শিরোনামে বিজ্ঞাপন৷ এবারে যে বিষয় ঘিরে বিতর্ক, বা বলা ভালো তর্ক, তা হচ্ছে হিন্দু ধর্মমতে বিয়েতে কন্যাদান বা সম্প্রদানের দিকটি৷ আলোচ্য বিজ্ঞাপনে মূল চরিত্রে নববধূর বেশে হিন্দি ছবির অভিনেত্রী মহেশ ভাটের কন্যা আলিয়া ভাট, যার কাজ এই বিজ্ঞাপনে দেখানো হিন্দু ধর্মের সব আচারকে প্রশ্ন করা৷
এই বিজ্ঞাপনে আলিয়া দর্শকদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখেন, কন্যা সন্তানের নিজের ঘর কোনটি? কেন তাকে সব সময় দেখা হয় ‘পরের ঘরের ধন' হিসাবে? প্রশ্নগুলি অবশ্যই যৌক্তিক, কিন্তু ‘মোহে' নামের ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনের প্ল্যাটফর্মে এই প্রশ্ন কতটা যৌক্তিক? বা কার্যকর? বলে রাখা ভালো, ‘মোহে' ব্র্যান্ডটির মূল পণ্যই বিয়ের পোশাক৷ অর্থাৎ, বিয়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই ব্র্যান্ডের আগাগোড়া৷
তবে ‘মোহে' প্রথম নয়৷ এর আগেও তো এমন অনেক ‘সাহসী' বিজ্ঞাপন দেখেছে ভারত৷ বিয়ের আরেক গুরুত্বপূর্ণ পণ্য সোনার গয়নার নানা বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য৷
শুধু তাই নয়, নির্মাতারা বানিয়েছেন, আর আমরা দর্শকরা দেখেছি৷ চায়ের কাপ হাতে কখনো হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দ্যের সার্ফ এক্সেলের ‘দাগ আচ্ছে হ্যায়' বিজ্ঞাপন বা সিঙ্গল মাদার নারীর দ্বিতীয় বিয়ের গল্পে তানিশকের গয়নার বিজ্ঞাপন দেখে বাহবা দিয়েছি৷ কয়েক সেকেণ্ডের জন্য আমাদের অনেকেরই মনে হয়েছে, ‘যাক, দেশ বদলাচ্ছে!'
কিন্তু আদতে কি তার ছিঁটেফোঁটাও টেলিভিশনের পর্দা থেকে চলকে পড়েছে বাস্তবে? তিন বছর আগে দেখা তানিশকের সেই বিজ্ঞাপন আমরা অনেকেই দেখেছিলাম, সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করে প্রশংসা করেছিলাম এই উদ্যোগকে৷ মনে মনে ভেবেছিলাম, সত্যিই হয়তো ভারতবর্ষ বদলাচ্ছে৷ সময়ের সাথে সাথে একদিন গোটা দেশের সমাজ হয়তো সহজভাবে মেনে নেবে এক নারীর একা মাতৃত্বের লড়াইয়ের গল্পকে৷
কিন্তু তারপর বাস্তবে যখন নুসরাত জাহানের ‘সিঙ্গল মাদার' হওয়া নিয়ে গোটা সংবাদমাধ্যম থেকে সোশাল মিডিয়া ব্যস্ত হয়ে উঠলো তার চরিত্রের ময়না তদন্ত করতে, তখন কি আমাদের কারো মনে পড়েছিল সেই বিজ্ঞাপন? জানি না৷
বিজ্ঞাপন নির্মাতারাও কি কেউ তাদের তুলে ধরা বার্তার বাস্তবায়নের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন? আমার মনে পড়েনা৷
তবে জনগণের স্মৃতিশক্তির মতো কি তারাও অ্যামনেশিয়ায় ভোগেন? তাদেরও কি ‘বার্তা দেবার দায়' শুধু বিজ্ঞাপন পর্যন্তই আটকে? নাকি এইসব বার্তা দিলে আজকের দিনের ‘উওক ইয়ুথ কালচার' বা সচেতন তারুণ্যের বাজারের কিছুটা নিজের দিকে টানা যায় বলেই বিজ্ঞাপন বানানো? কে জানে!
অন্যদিকে, আলিয়া এই বিজ্ঞাপনে কন্যাদানের বিপক্ষে ‘কন্যামান' রাখার কথা বললেন বলে তাকে ‘হিন্দুবিরোধী' হিসাবে দাগিয়ে দিচ্ছে টুইটার-ফেসবুকের একাংশ৷ আসল হোক বা মেকি, নারীর সম্মান চেয়ে করা প্রশ্ন অনেকের চোখে হিন্দুবিরোধী মনে হচ্ছে৷
অথচ বাজারের হাতে নারীর পণ্যায়ণ, যা বিশেষ করে বিয়ে ও প্রসাধনীর বাজারের জন্য অপরিহার্য, তা কারো কাছে সমস্যাজনক ঠেকছে না৷ হিন্দু, মুসলিম কারো না৷
২০২১ সালে দাঁড়িয়েও নারীর ক্ষমতায়নের গল্প বলতে গেলে বিয়ের প্লট ধার করতে হয়৷ নারীর সম্মানের দাবি করতে গেলে বিজ্ঞাপনে দেখাতে হয় যে পাত্রপক্ষ কন্যাদানে না হলেও সম্প্রদানে বিশ্বাসী৷ পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেন না তারা বিবাহের মাধ্যমে সন্তানকে দান করে দেবার মানসিকতা৷
ঠিক একই ভাবে বিজ্ঞাপনও কাটিয়ে উঠতে পারে না চমকের বা স্টান্ট দেখানোর স্বভাব৷ চারদিকে বাস্তব যতই কঠিন হোক না কেন, বিজ্ঞাপনের দুনিয়ার একটা বাড়তি সুবিধা আছে৷ ‘বাস্তবের সাথে কোনো মিল নেই' শিরোনামে সতর্কীকরণ দিয়ে তারা সহজেই পার পেয়ে যেতে পারে৷ করেও ঠিক তাই৷ একটু খানি উসকে দিয়েই ফুড়ুৎ!
৩০ সেকেণ্ডের বিজ্ঞাপনে পাঁচ সেকেণ্ডের প্রগতিশীলতাই যথেষ্ট বাকি ২৫ সেকেণ্ডের বাজারকেন্দ্রিকতা, মানুষের পণ্যায়ণসহ আমাদের সার্বিক সামাজিক বাকহীনতাকে ভুলিয়ে রাখতে৷
এই যে আলোচনায় উঠে এলেন আলিয়া ভাট ও মোহে ব্র্যান্ডের জামাকাপড়, তাতে করে আসন্ন দুর্গাপূজা-দীপাবলি-বিয়ের মরসুমে এই ব্র্যান্ডের কাটতি বাড়বে না তার হিসাব কেউ রাখছে কি? আলিয়া ভাটের নতুন ছবি বেরোবে সামনে, তার হিট বা ফ্লপ হবার খবরও আমরা রাখব৷
কিন্তু এইসব ‘প্রগতিশীল' বিজ্ঞাপন দেখে বা দেখিয়ে বাস্তবের ওপর কোনো প্রভাব আদৌ পড়ছে কি না, সেই হিসাব রাখবে কে? কে যাচাই করবে বাস্তবে কতটা সুরক্ষিত হলো কোনো কন্যার ‘মান'? নুসরাত জাহান?