নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন এবং তার দুই সহযোগীকে ভারতের পুলিশ কলকাতা থেকে গ্রেফতারের পর আট দিনের রিমান্ডে নিয়েছে৷ এদিকে বাংলাদেশ সরকার তাকে ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে জানা গেছে৷
বিজ্ঞাপন
গত ২৭শে এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়৷ এর তিনদিন পর তাদের লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে৷ এই ঘটনায় আরেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে মামলা হয়৷ নিহত নজরুলের শ্বশুর শহিদুল ইলাম অভিযোগ করেন নারায়ণগঞ্জ ব়্যাব-১১-র কমান্ডার লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মাহমুদ, মেজর আরিফ হোসেন এবং লে. কমান্ডার এম এম রানা নজরুলের প্রতিপক্ষ নূর হোসেনের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা ঘুস নিয়ে ৭ জনকে হত্যা করেছে৷
এই ঘটনায় ৩ র্যাব কর্মকর্তাসহ এ পর্যন্ত ১২ জনকে গ্রেফতার করা হলেও ঘটনার পর পরই নূর হোসেন দেশের বাইরে পালিয়ে যান৷ এরই মধ্যে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে র্যাবের সাবেক দুই কর্মকর্তা মেজর আরিফ হোসেন এবং লে. কমান্ডার এম এম রানা আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন৷
শনিবার গভীর রাতে কলকাতার দমদম বিমানবন্দর-সংলগ্ন বাগুইহাটি থানার পুলিশ নূর হোসেন এবং তার দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করে৷
ঢাকায় পুলিশ সূত্র জানায়, নূর হোসেন ভারতে আত্মগোপন করে আছেন, এ খবর নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়৷ এরই ভিত্তিতে ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি (এনআইএ) ও বাগুইআটি থানার পুলিশ গ্রেপ্তার অভিযান চালায়৷
কলকাতার পুলিশ জানিয়েছে, সাত খুনের পর নূর হোসেন পালিয়ে কলকাতায় গিয়ে ৮ই জুন কৈখালি ইন্দ্রপ্রস্থ আবাসনের পাঁচতলা বাসায় ওঠেন৷ দুই সঙ্গী ওহিদুর জামান শামীম ও সৌমেন খান সুমনকে নিয়ে দুই মাসের জন্য ফ্ল্যাটটি তিনি ভাড়া করেন৷ ওহিদুরের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার বুড়িপাড়া ও সুমনের বাড়ি ফতুল্লা থানার রামবরাস গ্রামে৷
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
ছবি: Getty Images/AFP
10 ছবি1 | 10
নূর হোসেন নিজেকে বাপী সাহা পরিচয় দিয়ে পাঁচতলার তিন বেডের ফ্ল্যাটটি ২০ হাজার ভারতীয় টাকায় ভাড়া নিয়েছিলেন৷
গ্রেপ্তারের পর তাঁদের বিরুদ্ধে বেআইনি প্রবেশের দায়ে সেখানকার থানায় মামলা হয়েছে৷
মামলার এজাহারে বলা হয়, বসিরহাট সীমান্ত দিয়ে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ করেন৷ তাঁদের কাছ থেকে পুলিশ পাঁচটি মোবাইল ফোন এবং ১১টি সিম উদ্ধার করে৷ এর মধ্যে একটি সিম বাংলাদেশের গ্রামীণফোনের৷ ভারতে অবস্থানের কোনো কাগজপত্র বা পাসপোর্ট তাঁদের কাছে ছিল না৷
তাদের রবিবার বারাসাত আদালতে হাজির করে পুলিশ ১৪ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন৷ ২৩শে জুন পরবর্তী শুনানি হবে৷ আদালতে নূর হোসেনের পক্ষে কেউ জামিনের আবেদন করেননি৷
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, রোববার সকালে তিনি টেলিফোনে কলকাতার অ্যান্টি-টেররিজম স্কোয়াডের এসিপি অনিমেষ সরকারের সঙ্গে কথা বলে নূর হোসেনের গ্রেপ্তার সম্পর্কে নিশ্চিত হন৷ তিনি নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন বলে জানান৷ আর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল জানিয়েছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকায় নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনতে আইনগত কোন জটিলতা হবে না৷
এদিকে নূর হোসেন কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছে এই খবরে নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন৷ তারা রবিবার মিছিল করে নূর হোসেনকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে তার বিচারের দাবি জানান৷