স্মৃতিভাণ্ডারের অনেক রহস্য আমরা এখনো উন্মোচন করতে পারিনি৷ বিশেষ করে ভয়, আতঙ্ক, বিপদের ঘটনা অনেক দিন পরেও আমাদের পীড়া দেয়৷ বিজ্ঞানীরা সেই ট্রমা মুছে ফেলার চেষ্টা করছেন৷
বিজ্ঞাপন
কত স্মৃতি আছে, যা মানুষকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়৷ সেই স্মৃতি আজকের অনেক সিদ্ধান্ত সহজ করে তোলে, ভবিষ্যতের জন্য আমাদের প্রস্তুত করে তোলে৷ কিন্তু যে খারাপ ঘটনা, ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ছাপ আমাদের মস্তিষ্কে গেঁথে আছে – চাইলেও যেগুলি মুছে ফেলা যায় না, সেই স্মৃতির কী হবে?
২০০২ সালে রোব্যার্ট যখন সৈন্য হিসেবে আফগানিস্তানে মোতায়েন ছিলেন, তখন তাঁর ইউনিটের সৈন্যরা একটি রকেট নিষ্ক্রিয় করার সময় মারাত্মক ভুল করে৷ ফলে বিস্ফোরণ ঘটে৷ তিনি বলেন, ‘‘এই সব ছবি আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না৷ হঠাৎ আমি গোলাগুলির মধ্যে নিজেকে দেখতে পাই৷ চারিদিকে লাশ, নানা মুখ চলে আসে৷''
শরীরে অংশ, পোড়া মাংসের গন্ধ, কান ফাটানো শব্দ – বার বার ফিরে আসে৷ সেই সব স্মৃতি রোব্যার্ট-কে অস্থির করে তোলে৷ চরম আতঙ্ক তাকে গ্রাস করে৷ তাঁর এই রোগের পোশাকি নাম ‘পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার' বা পিটিএসডি৷
আতঙ্ক বা ভয় দূর করার ৯ উপায়
খানিকটা আতঙ্ক বা ভয় থাকা খুবই স্বাভাবিক৷ তবে কেউ কেউ অকারণেই ভীত হন, আতঙ্কে থাকেন৷ এমন কি তাঁদের ‘প্যানিক অ্যাটাক’ও হয়৷ তাই ভয়কে জয় করে জীবনকে সহজ করার কিছু উপায় জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Jensen
অনুভূতি গুছিয়ে রাখুন
মনে মনে ভাবুন আপনার কোনো বড় সমস্যা বা অসুবিধা নেই৷ যে কোনো পরিস্থিতির জন্য আপনি নিজেকে তৈরি রাখুন৷ তাহলে অকারণে যেটুকু ভয় আপনার হচ্ছে সেটা আস্তে আস্তে চলে যাবে৷ কারণ, মানসিক প্রস্তুতিই হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় প্রস্তুতি৷
ছবি: Fotolia/runzelkorn
সমীক্ষা যা বলছে
রবার্ট কখ ইন্সটিটিউটের করা এক সমীক্ষায় জানা গেছে শতকরা ৩ দশমিক ৯ ভাগ জার্মান জীবনের কোনো-না-কোনো সময় আতঙ্ক বা ভয়ের সম্মুখীন হয়েছেন৷ আরেক সমীক্ষা বলছে, শতকরা ২০ ভাগ মানুষের জীবনের কোনো এক সময় প্যানিক অ্যাটাক হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Gambarini
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন
বিশেষজ্ঞরা জানান, সুস্থ জীবনযাত্রাই কিন্তু মানুষকে যে কোনো আতঙ্ক থেকে রক্ষা করতে পারে৷ ক্যাফেইন, নিকোটিন অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন৷ খাওয়া-দাওয়া এবং ঘুম সময়মতো করুন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ভয় নিয়ে কথা বলুন
প্লেনে ভ্রমন করতে অনেকেই ভয় পায়৷ আবার অনেকে উঁচু বা নীচের দিকে তাকালে ভয় পায়৷ আবার কেউবা জনগণের সামনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে ভীষণ নার্ভাস বোধ করেন৷ এমনকি অনেকে শপিং মল বা রাস্তায় বেশি মানুষ দেখলেও আতঙ্কিত হয়ে যান৷ যদিও বা জানেন, এতে ভয় বা আতংকের কোনো কারণই নেই, তার পরেও তাঁদের ভয় হয়৷ এসব ক্ষেত্রে ভয় নিয়ে অন্যদের সাথে কথা বলুন, দেখবেন ধীরে ধীরে ভয় কেটে যাবে৷
ছবি: Colourbox
নিজেকে ভালো করে চিনুন
ভয়ের কারণ নিয়ে নিজেই একটু ভাবুন৷ এর আগে কী এমন কিছু ঘটেছে যার কারণে আপনার এই আতংক? নাকি এমনিতেই ভয়?
ছবি: DW/C. Grün
নেতৃত্বের প্রস্তুতি নিন
মনোচিকিৎসক আন্দ্রেয়াস স্ট্র্যোলে জানান, যেসব পরিস্থিতির কারণে মানুষ ভয় পায়, সেগুলো থেকে দূরে সরে না গিয়ে বরং এই পরিস্থিতিতে কথা বলার বা নেতৃত্ব দেয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা উচিৎ৷ তাছাড়া আয়নার সামনে নিজে নিজে কথা বললেও ভয় কেটে যায়৷ তবে মানুষের সামনে নাচ, গান আবৃত্তির মতো অনুশীলনের মধ্য দিয়ে খুব সহজেই ভয়কে জয় করা সম্ভব৷
ছবি: picture-alliance/dpa/U. Perrey
খেলাধুলা
বয়ঃসন্ধিকালে অনেকেরই মস্তিষ্ক এলোমেলো থাকে, ওরা ঠিক কী করবে বা করা উচিৎ বুঝতে পারেনা৷ কথায় কথায় রাগ, দুঃখ, আতঙ্ক কাজ করে মনের ভেতরে৷ মনোচিকিৎসক ডা.আন্দ্রেয়াস স্ট্র্যোলে জানান, খেলাধুলা, ব্যয়াম বা বক্সিংয়ের মধ্যে দিয়ে নিজের রাগ, দুঃখ, ভয় বা অভিমানকে নাকি খুব সহজে বের করে ফেলা সম্ভব ৷ সোজা কথায় বলা যায়, আতঙ্ক দূর করতে শারীরিকভাবে সক্রিয় হওয়া উচিৎ৷
ছবি: Getty Images/AFP/E. Soteras
বাড়তি চাপ নয় কিন্তু !
স্কুলে ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ক্লাসে সেরা হওয়ার প্রতিযোগিতাও অনেকসময় মস্তিষ্কে প্রচন্ড চাপও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাড়ায়৷ এই পরিস্থিতিতে মেয়ে বা ছেলেটিকে মা-বাবা এবং শিক্ষককে বোঝানোর দায়িত্ব নিতে হবে যে , প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়াটাই যেন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য না হয়৷ আর এতে দেখা যাবে সন্তানটি কোনোরকম চাপ ছাড়াই ভালো রেজাল্ট করছে৷
ছবি: Imago/Jochen Tack
ভয়কেই জিইয়ে রাখা উচিৎ নয়
তবে কোনো ভয়কেই জিইয়ে রাখা উচিৎ নয়৷ ভয়ের কারণ নিয়ে প্রথমে পরিবার বা বন্ধুদের সাথে কথা বলুন৷ সফল না হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন৷ তা না হলে ছোট ছোট ভয়ই পরে প্যানিক অ্যাটাকের মতো বড় আকার ধারণ করতে পারে৷
ছবি: Andrea Diefenbach/Kehrer-Verlag
9 ছবি1 | 9
ইউরোপীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট-এর বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় হলো – স্মৃতি আদৌ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কিনা এবং সেটা সম্ভব হলে কীভাবে তা করা যায়৷ আন্ড্রে ফিশার এমন এক কোড খুঁজছেন, যা ভয়ের স্মৃতি মুছে দিতে পারে৷ তিনি ‘লং টার্ম মেমারি' নিয়ে কাজ করছেন৷ সেখানেই ভয়ের স্মৃতি জমা থাকে৷ যে এনজাইম নেতিবাচক স্মৃতি জমা রাখার দায়িত্বে রয়েছে, সেটির খোঁজ করছেন তিনি৷ ভয় কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে মস্তিষ্কে জাঁকিয়ে বসে, ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালিয়ে তিনি সেটা জানার চেষ্টা করছেন৷
খাঁচার মধ্যে একটি ইঁদুরকে গারদের মাধ্যমে সামান্য মাত্রায় ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়৷ ফলে ইঁদুরটি ভয়ে নড়াচড়া করতে পারে না৷ বিজ্ঞানীরা এই অবস্থাকে ‘কনডিশানাল ফ্রিজিং' বলেন৷ এক দিন পর ইঁদুরটিকে একই খাঁচায় পুরে দেওয়া হয়৷ সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রিক শকের কথা তার মনে পড়ে যায়৷ ভয় আবার ফিরে আসে৷ প্রো. আন্ড্রে ফিশার বলেন, ‘‘এটা মানুষের মতোই৷ যেমন মানুষ কোনো নতুন শহরের নতুন কোনো গোলমেলে এলাকায় গিয়ে ছিনতাইয়ের শিকার হয়৷ পরের বার সেখানে গিয়ে সে অত্যন্ত সতর্ক থাকে৷ চালাক মানুষ সেখানে আর ফেরেই না৷''
আপনার কি এই ফোবিয়াগুলো আছে?
কেউ ভালোবাসতে ভয় পান, তো কেউ ফোনের ব্যাটারি শেষ হওয়ার আতঙ্কে থাকেন৷ এমন কিছু ফোবিয়া বা আতঙ্ক আছে প্রতিনিয়ত আমরা যাদের মুখোমুখি হচ্ছি৷
ছবি: Fotolia/lassedesignen
নোমোফোবিয়া
বর্তমান যুগে এই ফোবিয়াতে আমরা কম বেশি সকলেই আক্রান্ত৷ আপনার মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই বা চার্জ ফুরিয়ে যাচ্ছে –তাহলেই শুরু হয়ে যায় এই ফোবিয়া৷ ব্রিটিশ পোস্টের এক জরিপ বলছে, শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ আতঙ্কে থাকেন যে, তাঁর ফোনটি চুরি হতে পারে বা তিনি সেটি বাড়িতে ফেলে আসতে পারেন৷ ইউরোপের অনেক ক্লিনিক এঁদের জন্য থেরাপির ব্যবস্থা করছে৷
ছবি: Colourbox
জেফিরোফোবিয়া
কোনো ব্রিজ বা সেতু পার হওয়ার সময় আপনার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় বা মাথা ঘোরে? তাহলে আপনি এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত৷ নিউইয়ার্কে অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারস ক্লিনিক এ ধরনের ফোবিয়ার থেরাপি দিয়ে থাকে৷
সব ধরনের ভয় বা আতঙ্কের মধ্যে ফিলোফোবিয়া হলো সবচেয়ে দুঃখের৷ চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, ভালোবাসার সম্পর্কে আঘাত পাওয়া নিয়ে কারুর কারুর মধ্যে ভয় কাজ করে৷ বিশ্বাস, প্রতিশ্রুতি রক্ষা – এ সব বিষয় নিয়ে আতঙ্কে থাকেন অনেকে৷ এঁরা কাউকে ভালোবাসতে ভয় পান, কেননা তাঁরা মনে করেন এতে যন্ত্রণা পেতে হবে৷ সাধারণত পূর্বের কোনো বিচ্ছেদের ঘটনা এ ধরনের ফোবিয়ার জন্ম দেয়৷
ছবি: Fotolia/ lassedesignen
ডিসাইডোফোবিয়া
জার্মান দার্শনিক ভাল্টার কাওফমান বলেছেন, ‘‘কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে এই ফোবিয়ার উৎপত্তি হয়৷’’ তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তি কিছু লুকাতে চাইছেন এবং সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সেই সত্যিটা বেরিয়ে পড়বে – এমন আশঙ্কাই এই ফোবিয়ার কারণ৷ এ সমস্ত ব্যক্তিরা তখন বাবা-মা, সরকার বা ধর্মীয় নেতার শরণাপন্ন হন, কারণ তাঁরা মনে করেন এই মানুষগুলো তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে৷
ছবি: MK-Photo/Fotolia.com
এর্গোফোবিয়া
এই ফোবিয়াটা হয়ত আমাদের প্রায় অনেকের মধ্যেই আছে৷ কর্মক্ষেত্র বা অফিসে যাওয়ার ভয়, বা অফিসের পরিবেশ নিয়ে আতঙ্ক৷ এটা আসে জনসমক্ষে কথা বলতে না পারা, সামাজিক পরিবেশ, অর্থাৎ সহকর্মীদের সাথে খাপ খাওয়ার ভয় বা সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয় থেকে৷
ছবি: Fotolia/bluedesign
হাফেফোবিয়া
কিছু মানুষ অন্যের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলতে চান৷ কারণ এতে তাঁরা ভয় পান৷ চিকিৎসার ভাষায় এ ধরনের আতঙ্ককে হাফেফোবিয়া বলে৷ কোনো কোনো মানুষ এ ফোবিয়া নিয়েই জন্মায়৷ আবার কারো কারো ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের পর এই ফোবিয়া দানা বাধে৷ এ ধরনের রোগীদের কেউ স্পর্শ করলে, তাঁরা ভয়ানক আতঙ্ক বোধ করেন৷ কারো কারো শ্বাস-প্রশ্বাসও বন্ধ হয়ে যায়৷
ছবি: Dan Race - Fotolia.com
ফোবোফোবিয়া
সব ফোবিয়ার রাজা বলা হয় একে৷ অর্থাৎ এই ফোবিয়া হলো সব আতঙ্কের আতঙ্ক৷ সব কিছুতেই ভয় করে তখন৷ কোনো ট্রমা থেকে এই ফোবিয়া হতে পারে৷ চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনেক ধরনের আচরণগত থেরাপি বা চিকিৎসা আছে এই ফোবিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য৷
ছবি: Fotolia/lassedesignen
7 ছবি1 | 7
বিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে ভয়ের পেছনে যুক্তি থাকে৷ সেই ভয় বিপদ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে দিয়ে সুরক্ষা দেবার চেষ্টা করে৷ কিন্তু ট্রমার ক্ষেত্রে স্মৃতি ফিকে হয়ে যায় না, সব সময়ে সজাগ থাকে৷ তথাকথিত ফ্ল্যাশব্যাক যে কোনো সময়, যে কোনো জায়গায় ফিরে এসে পীড়া দিতে পারে৷