ইউক্রেনের যুদ্ধে নিরীহ মানুষের ভয়াবহ অবস্থার দৃশ্য গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিচ্ছে৷ মূল যুদ্ধের পাশাপাশি সাইবার যুদ্ধ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংঘাতও কম হচ্ছে না৷ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আজকের সংকটকে ভিন্ন মাত্রা দিচ্ছে৷
প্রতীকী ছবিছবি: Jakub Porzycki/NurPhoto/imago images
বিজ্ঞাপন
অনলাইনেও ইউক্রেন-রাশিয়া লড়াই
04:14
This browser does not support the video element.
এ পর্যন্ত হ্যাকারদের এমন বাহিনী কখনো দেখা যায়নি৷ ইউক্রেনকে রাশিয়ার ডিজিটাল হামলারও মোকাবিলা করতে হচ্ছে৷ ইউক্রেনের উপ প্রধানমন্ত্রী ও ডিজিটাল বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী মিখাইলো ফেডেরভের ডাকে সাড়া দিয়ে আড়াই লাখেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবী সে দেশের আই-টি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন৷ রাশিয়ার উপর সাইবার হামলাই তাঁদের লক্ষ্য৷ অক্সফোর্ড ইনফরমেশন ল্যাবসের জর্জিয়া অসবোর্ন বলেন, ‘‘সেই বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে দেশপ্রেমী হ্যাকিং অ্যাক্টিভিস্ট রয়েছে৷ তারা কখনো বিঘ্ন ঘটাচ্ছে, কখনো বা সরকারের ওয়েবসাইট বিকল করে লজ্জাজনক অবস্থা সৃষ্টি করছে৷ কিন্তু আমার মতে সাইবার যুদ্ধের ঘোষণা তারা করে নি, বরং বিবৃত করছে৷''
মূলত অস্ত্রের জোরেই ইউক্রেনে যুদ্ধ চালানো হচ্ছে৷ শহরে বোমাবর্ষণ, আবাসন ধ্বংসের কারণে মানুষকে ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে হচ্ছে৷ দৃশ্যমান সেই যুদ্ধের পাশাপাশি দুই পক্ষই অনলাইন ও ডিজিটাল হামলাও চালাচ্ছে৷ সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্টেফান দুগ্যাঁ মনে করেন, ‘‘সাইবার হামলা ঘটলে পানি, খাদ্য, জ্বালানি ও স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটে৷ সংঘাতের ঝুঁকির মধ্যে আমরা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছি৷''
অনলাইনেও ইউক্রেন-রাশিয়া লড়াই
04:14
This browser does not support the video element.
তবে পথে ট্যাংক নামার আগেই হ্যাকাররা ইউক্রেনের উপর হামলা চালিয়েছে৷ সরকার ও ব্যাংকের ওয়েবসাইট বিকল করে দেওয়া হয়েছে এবং সংক্রমিত কম্পিউটারে ম্যালওয়্যার তথ্য নষ্ট করে দিয়েছে৷
২০১৪ সালে ইউক্রেনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের উপর বড় আকারের সাইবার হামলা ঘটেছিল৷ ২০১৫ ও ২০১৬ সালে হ্যাকাররা শীতের মাঝে বিদ্যুৎ নেটওয়ার্কের একটা অংশ বন্ধ করে দিয়েছিল৷ ২০১৭ সালে এক সাবোটাজ সফটওয়্যার হার্ড ডিস্ক ও সার্ভার মুছে দিয়েছিল৷ জর্জিয়া অসবোর্ন বলেন, ‘‘২০১৭ সালে নোটপেটিয়া নামের বড় আকারের এক হামলার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শিল্পজগতের ক্ষতি হয়েছিল৷ মেয়ার্স্ক নামের জাহাজ কোম্পানিও সেই ধাক্কা সামলেছে৷ অনেক শিল্পের উপর এমন হামলায় গোটা বিশ্বে প্রায় এক হাজার কোটি ডলার অংকের ক্ষতি হয়েছে৷ অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী এর বড় প্রভাব টের পাওয়া গেছে৷''
রাশিয়া থেকে সন্দেহভাজন সাইবার হামলা আজও বন্ধ হয়নি৷ গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে তথ্য চুরি থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো অবকাঠামোর উপর ডিজিটাল হামলা ঘটছে৷ সামরিক বাহিনীর যোগাযোগও লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে৷ গিসেকে ও ডেভরিয়েন্ট কোম্পানির কর্ণধার রাল্ফ ভিন্টারগ্যার্স্ট বলেন, ‘‘ভুলবেন না, আজ প্রতিটি ট্যাংক, প্রত্যেকটি বিমানে উন্নত কম্পিউটার বসানো রয়েছে, যেগুলি নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত৷ সেই সব যন্ত্রের মধ্যে বড় আকারের সাইবার প্রযুক্তি রয়েছে৷''
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ইউক্রেন রাশিয়ার হামলার মোকাবিলা করছে৷ ডিজিটাল মন্ত্রী মিখাইলো ফেডেরভ তাঁর যুদ্ধবিরোধী অভিযানে টুইটার ব্যবহার করছেন৷ ইন্টারনেট চালু রাখতে তিনি ইলন মাস্ককে অনুরোধ করেছেন৷ মাস্ক সেই অনুরোধে সাড়াও দিয়েছেন৷
তিনি বিদেশি কোম্পানিগুলির উদ্দেশ্যে রাশিয়াকে বয়কট করার ডাক দিয়েছেন৷ ইতোমধ্যে অসংখ্য কোম্পানি সে দেশ ত্যাগ করেছে৷ অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রা বিশাল হয়ে উঠছে৷ অক্সফোর্ড ইনফরমেশন ল্যাবসের জর্জিয়া অসবোর্ন বলেন, ‘‘ডিজিটাল মন্ত্রী হিসেবে ফেডেরভ টুইটারে অত্যন্ত সক্রিয়৷ তিনি রাশিয়ার ব্যবসাবাণিজ্য বয়কট করতে কোম্পানি প্রধানদের উপর চাপ দিচ্ছেন৷''
কম্পিউটার ভাইরাসের তুলনায় বোমার কারণে ধ্বংসলীলার মাত্রা অনেক বেশি হলেও আজ সমান্তরালভাবে বাস্তব ও ডিজিটাল যুদ্ধ চলছে৷
প্রতিবেদন: হ্যুটার/লাৎসাক/এসবি
ইউক্রেন যুদ্ধে যেসব অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে
রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করে ২৪ ফেব্রুয়ারি৷ নিজস্ব অস্ত্র ছাড়াও পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার মোকাবিলা করছে ইউক্রেন৷
ছবি: Alexander Zemlianichenko/AP/picture alliance
কিনজাল মিসাইল
মিগ-৩১ বিমানের গায়ে সাদা কিনজাল মিসাইল দেখতে পাচ্ছেন৷ শব্দের গতির চেয়ে এর গতি প্রায় পাঁচগুণ বেশি৷ তাই একে হাইপারসনিক মিসাইল বলা হয়৷ ১৯ মার্চ রাশিয়া জানায়, ইউক্রেনের পশ্চিমের একটি বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার ধ্বংস করতে এই মিসাইল ব্যবহার করা হয়েছে৷ আর ২৯ মার্চ এক ঊর্ধ্বতন মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা জানান, রাশিয়া নিয়মিত এমন মিসাইল ব্যবহার করছে৷ ছবিটি ২০১৮ সালে তোলা৷
ছবি: Alexander Zemlianichenko/AP/picture alliance
ভ্যাকুয়াম বোমা
এই বোমা থার্মোব্যারিক বোমা বা অ্যারোসল বোমা নামেও পরিচিত৷ ছবিতে রাশিয়ার টিওএস-১এ থার্মোব্যারিক রকেট লঞ্চার দেখা যাচ্ছে, যেটা থেকে ভ্যাকুয়াম বোমা ছো়ড়া হয়৷ ইউক্রেন যুদ্ধে এই সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে বলে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে৷ ভ্যাকুয়াম বোমার আঘাতে অনেক বড় আগুনের গোলা সৃষ্টি হয়৷ এটি সুরক্ষিত ভবন, যন্ত্রপাতি ধ্বংস করতে পারে৷ মানুষকে মেরে ফেলতে কিংবা আহত করতে পারে৷
ছবি: Leonid Faerberg/ZUMAPRESS/picture alliance
ক্লাস্টার বা গুচ্ছ বোমা
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল বাচেলেট বুধবার জানান, রাশিয়া জনবহুল এলাকায় অন্তত ২৪ বার এমন বোমা ব্যবহার করেছে বলে তার অফিস অভিযোগ পেয়েছে৷ এই বোমার এমন নামকরণের কারণ এই বোমায় অনেকগুলো ছোট ছোট বোমা (বম্বলেট) থাকে৷ ক্লাস্টার বোমা বিস্ফোরিত হলে ছোট বোমাগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে৷ ফলে একটা বিশাল এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ ছবিটি ফাইল থেকে নেয়া৷
ছবি: MOHAMMED ZAATARI/AA/picture alliance
কালিবা ক্রুজ মিসাইল
ইউক্রেনের সামরিক ও সরকারি ভবনে হামলা চালাতে কালিবা ক্রুজ মিসাইল ব্যবহার করেছে রাশিয়া৷ ছবিটি ফাইল থেকে নেয়া৷
ছবি: Tass/imago images
ইস্কান্দার ব্যালিস্টিক মিসাইল
এই মিসাইল সর্বোচ্চ ৫০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে৷ বড় ভবন ও সুরক্ষিত, দুর্ভেদ্য অবকাঠামো ধ্বংস করতে পারে এটি৷ বেলারুশ থেকে কিছু ইস্কান্দার মিসাইল ইউক্রেনের দিকে ছোড়া হয়েছে বলে জানা গেছে৷
ছবি: Russian Defense Ministry via AP/picture alliance
আর্টিলারি সিস্টেম
২৬ ফেব্রুয়ারির এই ছবিতে ইউক্রেন সীমান্তের কাছে রাশিয়ার বেলগোরোদ এলাকায় ‘উরাগান’ মাল্টিপল রকেট লঞ্চার সিস্টেম দেখা যাচ্ছে৷ তার দুদিন আগে ইউক্রেনে হামলা শুরু করেছিল রাশিয়া৷ উরাগান ছাড়াও রাশিয়ার কাছে সোভিয়েত আমলের ডিজাইন করা ‘গ্রাট’, ‘স্ম্যার্শ’ রকেট লঞ্চার আছে৷
ছবি: Mikhail Voskresenskiy/SNA/imago images
ফসফরাস বোমা?
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ২৫ মার্চ জানান, রাশিয়া ইতিমধ্যে ফসফরাস বোমা ব্যবহার করেছে৷ লুহানস্কের গভর্নর জানান একটি গ্রামে এমন বোমা হামলায় দুই শিশুসহ কমপক্ষে চারজন মারা গেছেন৷ জেলেনস্কির মন্তব্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে ক্রেমলিনের মুখপাত্র জানান, রাশিয়া ‘‘কখনও আন্তর্জাতিক কনভেনশন লঙ্ঘন করেনি৷’’ ছবিতে ১৯৪৫ সালে ফসফরাস বোমার ব্যবহার দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: United Archives International/imago images
জ্যাভলিন মিসাইল
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এই অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল ব্যবহার করছে ইউক্রেন৷ পশ্চিমা দেশগুলো এসব তাদের সরবরাহ করেছে৷ গত ডিসেম্বরের ছবিতে জ্যাভলিনসহ ইউক্রেনের সেনাদের দেখা যাচ্ছে৷
এটি একটি অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট মিসাইল৷ এটিও পশ্চিমের কাছ থেকে পেয়েছে ইউক্রেন৷
ছবি: LEILA GORCHEV/AFP/Getty Images
বায়রাকতার ড্রোন
যুদ্ধ শুরুর আগে ইউক্রেনকে এই ড্রোন দিয়েছিল তুরস্ক৷ এটি ব্যবহার করে রাশিয়ার মিলিটারি কনভয়ের উপর হামলার ভিডিও প্রকাশ করেছে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী৷
ছবি: Emrah Yorulmaz/AA/picture alliance
ক্ষয়ক্ষতির হিসাব
ওরিক্স মিলিটারি অ্যানালিসিস ব্লগের তথ্য উল্লেখ করে বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, মঙ্গলবার (২৯ মার্চ) পর্যন্ত রাশিয়ার ৩১৮টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়েছে কিংবা সেনারা ফেলে পালিয়ে গেছেন৷ এছাড়া পাঁচশর বেশি সাঁজোয়া যান, ১৬টি ফাইটার জেট, ৩৫টি হেলিকপ্টার ও নৌবাহিনীর দুটি জাহাজ ধ্বংস হয়েছে বলে জানিয়েছে ওরিক্স৷ আর ইউক্রেন হারিয়েছে ৭৯টি ট্যাঙ্ক, প্রায় ২০০টি সাঁজোয়া যান, ১২টি জেট ও ১৩টি জাহাজ৷