২৫শে এপ্রিল ছিল নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি৷ যেসব স্থাপনা ধ্বংস হয়েছিল সেগুলোর কিছুর সংস্কার শুরু হয়েছে৷ কিন্তু ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়া লাখো মানুষ নড়বড়ে শরণার্থী শিবিরে থাকছে,যাদের ঘরে ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ৷
বিজ্ঞাপন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৫ সালে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অন্তত ৯ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল৷ কিন্তু ঐ ঘটনার পর বর্ষা মৌসুমে হিমালয় কন্যার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায়ই ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে চলেছে৷
ক্ষণস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে এখনও আশ্রয় নেয়া আড়াই হাজার পরিবার স্থায়ী আবাসনের আশায় দিন কাটাচ্ছেন৷ কারণ, কর্তৃপক্ষ বলছেন, যেসব গ্রামে তারা ছিলেন, সেখানে ফিরে যাওয়া নিরাপদ নয়৷
এদের মধ্যে একজন সুবি তামাং, যিনি ঐ ভূমিকম্পের ফলে ভূমিধসে তাঁর বাড়ি-ঘর এবং তিন বছরের নাতনীকে হারিয়েছেন৷ ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ঐ ভূমিকম্পের পর গত দুই বছরে তামাং এবং তার পরিবার এমন একটি জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন যেখানে অন্য ১০০টি পরিবারের সঙ্গে বাস করতে হয় এবং প্রতি মাসে ভাড়াও দিতে হয়৷ সেখান থেকে তাদের আগের বাড়িতে হেঁটে যেতে পুরো একদিন সময় লাগে৷ সেই বাড়ি অবশ্য এখনো ধ্বংসস্তূপ৷
কাঠমাণ্ডুর উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশে প্রত্যন্ত এই জেলাতে টিনের তৈরি এই বাসস্থানগুলো তেমন একটা মজবুত নয়৷ তাই তীব্র শীতে প্রচণ্ড কষ্ট হয় তাদের৷ ৪৮ বছর বয়সি তামাং স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে জানালেন, কীভাবে তাদের গ্রামে পাথর ধসে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছিল৷ সংবাদ সংস্থা এএফপিকে তিনি জানালেন, ‘‘এই ভূমিকম্প আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে৷ ভূমিধসে সব তলিয়ে গেছে, কিছুই অবশিষ্ট নেই৷ সেখানে যাওয়ার কোনো সড়ক নেই৷ থাকার মতো কোনো ঘর নেই৷ কৃষিকাজ করার মতো জমিও নেই৷''
ধুঁকছে নেপাল, বাংলাদেশও শঙ্কায়
মঙ্গলবার আবার ভূমিকম্প হলো নেপালে৷ ক্ষয়ক্ষতি বেশি না হলেও বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের কিছু অংশেও লেগেছে ভূমিকম্পের ধাক্কা৷ এ নিয়েই আজকের ছবিঘর৷
ছবি: Reuters/U.S. Marine Corps/H. Vidana
অসহায় মানুষ
মঙ্গলবার রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে আনুমানিক ৭৬ কিলোমিটার দূরে, মাউন্ট এভারেস্টের কাছের অঞ্চলের মাটি, ঘর-বাড়ি কেঁপে উঠতেই সবার মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে৷ রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৩ মাত্রার এ ভূমিকম্পে কমপক্ষে ৪২ জন প্রাণ হারায়৷
ভূমিকম্প শুরু হতেই ঘরবাড়ি ছেড়ে সবাই চলে আসেন খোলা আকাশের নীচে৷ অনেকেরই আর নিজের ঘরে ফেরা হয়নি৷ নিমিষে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর ঠিকানা এখন অস্থায়ী শিবির৷
ছবি: DW/A. Francis
চাপা পড়া মানুষ
বাইরে আসতে যাঁদের দেরি হয়েছে, তাঁদের অনেকেই আটকে পড়েন ভেঙা পড়া অট্টালিকার ইট-শুড়কির নীচে৷ চাপা পড়া একজনকে উদ্ধারের চেষ্টা করছেন নেপালের এক সেনাসদস্য৷
ছবি: Getty Images/J. Gratzer
পানির জন্য হাহাকার
এপ্রিলের সেই ভয়ংকর ভূমিকম্পে যে অঞ্চলগুলোর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল, ভক্তপুর তাদের একটি৷ যাঁরা বেঁচে গেছেন, এখন বেঁচে থাকার অন্যরকম এক লড়াইয়ে শামিল তাঁরা৷ ক্ষুধা নিবারণ করতে পারলেও, তৃষ্ণা মেটানোর জন্য পানি পাচ্ছেন না৷ পানিবাহী ট্রাক এলেই তাঁরা দল বেঁধে ছুটে যান ট্রাকের দিকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Irham
এভারেস্ট আছে, শেরপা নেই
প্রতি বছর মে মাসের এই সময়টায় বিশ্বের নানা প্রান্তের পর্বতারোহীরা এভারেস্টের শৃঙ্গে উঠতে ছুটে যান নেপালে৷ কিন্তু ২৫শে এপ্রিলের ভূমিকম্পে এভারেস্টে ১৮ জন পর্বতারোহী মারা যাওয়ায় এভারেস্টে পর্বতারোহন আপাতত বন্ধ৷ বেসক্যাম্পগুলোতে তাই কোনো শেরপার দেখা নেই৷
ছবি: picture alliance/ZUMA Press
বাংলাদেশেও আতঙ্ক
গত এপ্রিল মাসের মতো এবারের ভূমিকম্পের ধাক্কাও বাংলাদেশ টের পেয়েছে৷ দেয়াল ধসে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে৷ ছবির এই নারী কাঁদছেন স্বজন হারানোর বেদনায়৷
ছবি: Reuters
7 ছবি1 | 7
তবে তামাং ভাগ্যবানদের একজন, কারণ, তাদের গ্রামটি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ সরকারি সংস্থা এনআরএ দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পাওয়া চারশ' কোটি মার্কিন ডলার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত কাঠামোর সংস্কারে ব্যয় করছে৷ কোন এলাকা ও স্থাপনার সংস্কার করা হবে সেগুলো এতদিন ধরে চিহ্নিত করেছেন তারা৷
তাই নতুন জায়গায় শরণার্থীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছে কর্তৃপক্ষ৷ তবে কবে থেকে এই পুনর্বাসন শুরু হবে তা জানায়নি তারা৷ এনআরএ কর্মকর্তা দূর্বা শর্মা জানালেন, ‘‘প্রয়োজনের ভিত্তিতে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলবে৷ যাদের প্রয়োজনটা বেশি তাদের প্রাধান্য দেয়া হবে৷ কেবল বাসস্থান নয়, স্কুলও নির্মাণ করা হবে৷''
ধ্বংসস্তূপে প্রাণের আভাস
ধ্বংস আর বিনাশের মধ্যে ত্রাণকর্মীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন, যখন এক কিশোরকে ভূমিকম্পের পাঁচদিন পরে উদ্ধার করা সম্ভব হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images/R. Schmidt
পাঁচ দিন পরে উদ্ধার
ভূমিকম্পে চাপা পড়া মানুষদের কারোকে জীবন্ত অবস্থায় খুঁজে পাওয়ার আশা যখন ফুরোতে চলেছে, তখনই কাঠমান্ডুতে উল্লাস! বিপজ্জনক পরিবেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খোঁজের পর ১৮ বছর বয়সি পেম্বা তামাংকে কাঠমান্ডুর ভেঙে পড়া হিল্টন হোটেলের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়, নেপালে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের ঠিক পাঁচ দিন পরে৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
বাঁধ ভাঙা আনন্দ
নেপালের সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের পুলিশ অফিসার এল বি বাসনেট-কে কাঁধে তুলে নিয়ে উল্লাস! বাসনেট তাঁর হেডল্যাম্পের আলোয় ১৮ বছর বয়সি পেম্বাকে আবিষ্কার করেন এবং টেনে বার করেন৷ পেম্বা নাকি প্রথম দর্শনে তাঁকে ধন্যবাদও জানিয়েছে বলে বাসনেট পরে জানান৷
ছবি: Reuters/N, Chitrakar
আবহাওয়ার দুর্যোগ
ব্যাপক বৃষ্টির ফলে নেপালের সর্বাধিক বিপর্যস্ত এলাকাগুলিতে ত্রাণ পাঠানোয় ব্যাঘাত ঘটছে৷ এমনকি হেলিকপ্টারও সেই সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছতে পারছে না৷ এই আবহাওয়ায় সে সব জায়গায় পৌঁছতে পাঁচ দিন লেগে যেতে পারে বলে ত্রাণকর্মীরা জানিয়েছেন৷
ছবি: AFP/Getty Images/S. Hussain
বাস তুলে ত্রাণ শিবিরে
কাঠমান্ডুর হাজার হাজার মানুষের মতো গৌতম পরিবারের সদস্যরাও বাড়ি ছেড়ে ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন৷ গৌতমদের গোটা আবাসিক এলাকাটি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷
ছবি: DW/A.Singh Choudary
ধৈর্য ফুরিয়ে আসছে
ত্রাণ যে ধীরগতিতে ভূমিকম্প নিপীড়িতদের কাছে পৌঁছচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষ রুষ্ট৷ সরকারি কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন যে, মানুষের প্রত্যাশা মেটানো সম্ভব হয়নি৷ মানুষজন যাতে কাঠমান্ডু ছেড়ে নিজেদের গাঁয়ে ফিরতে পারেন, সেজন্য পর্যাপ্ত বাস দেওয়া হয়নি বলে রাজধানীতে সরকারি কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়েছে৷
ছবি: Reuters/N. Chitrakar
ধ্বংসলীলা
ভূমিকম্পের নিহতের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে, আহতের সংখ্যা দশ হাজারের বেশি৷ সাত দশমিক আট শক্তির ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কাঠমান্ডুর প্রায় ৮০ কিলোমিটার পশ্চিমে, এবং মাত্র দশ কিলোমিটার গভীরতায়, যার ফলে ধ্বংসের মাত্রা বেড়েছে৷ নেপালের ৭৫টি জেলার মধ্যে অন্তত ৩০টি জেলা থেকে ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গিয়েছে৷ অর্থনৈতিক ক্ষতি কোটি কোটি ডলার ছাড়াবে৷
ছবি: Reuters/IFRC/Palani Mohan
বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষতি
কাঠমান্ডু উপত্যকাকে বলা হয় নেপালের সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র: এখানে সাতটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট আছে৷ তাদের মধ্যে পড়ে সুবিখ্যাত স্বয়ম্ভুনাথ স্তূপ৷
ছবি: Reuters/N. Chitrakar
মাউন্ট এভারেস্টে পর্বতারোহণ আবার শুরু হচ্ছে
আগামী সপ্তাহেই আবার মাউন্ট এভারেস্টে আরোহণ শুরু হবে বলে জানিয়েছে নেপালের পর্যটন মন্ত্রণালয়৷ শনিবারের ভূমিকম্পে এভারেস্টে ওঠার পথে ধস নেমে প্রাণ হারিয়েছেন ১৮ জন পর্বতারোহী ও শেরপা, আহত হয়েছেন আরো ৬০ জন৷ চীন কিন্তু এভারেস্টের নর্থ ফেস এবং তিব্বতের যাবতীয় পর্বতে চড়া এ বছরের মতো নিষিদ্ধ করেছে৷
ছবি: AFP/Getty Images/R. Schmidt
8 ছবি1 | 8
যেসব মানুষ বাড়ি-ঘর হারিয়েছেন, তাদের বলা হয়েছিল প্রত্যেকে ৩ লাখ রূপি করে দেয়া হবে৷ কিন্তু এখনো কোনো অর্থ না পেয়ে তারা অধৈর্য্য হয়ে পড়েছেন৷ ৬৪ বছরের কৃষক বীরবল তামাং ভূমিধসে বাড়ি-ঘর গৃহপালিত পশু সব হারিয়েছেন৷ তবে আবার সব ফিরে পাবেন সেই আশায় প্রতিটা ক্ষণ গোনেন৷ এএফপিকে তিনি জানালেন, ‘‘প্রায়ই আমাদের গ্রামে যন্ত্রপাতি ইত্যাদি নিয়ে হাজির হন কিছু মানুষ এবং যাওয়ার সময় বলেন, এখনও এলাকাটি বিপজ্জনক৷ তারা এটাও বলেছিল আমাদের জায়গা-জমি দেবে৷ কিন্তু আমরা কিছুই জানি না আদৌ কিছু পাব কিনা৷''