প্রকৃতিতে সব কিছুই পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত, পরস্পরের উপর নির্ভরশীল৷ নেপালে মধুচাষের ক্ষেত্রেও যা দেখা যায়: পার্বত্য এলাকায় যেখানে আজও এশীয় মৌমাছিদের চল, নীচে তরাই অঞ্চলে ইউরোপীয় মৌমাছির আধিপত্য৷
বিজ্ঞাপন
ইউরোপীয় মৌমাছি পালনের সুবিধা বেশি – বেশিবার মধু তোলা যায়, ইউরোপীয় মৌমাছিদের রোগভোগও কম – কাজেই চাষিরা স্বভাবতই সেদিকে ঝোঁকেন৷ অপরদিকে এশীয় মৌমাছির ল্যাটিন নাম হল ‘আপিস সেরানা'৷ নেপালের পশ্চিমাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় সর্ষেফুলের পরাগ বহন করে আনে এই মৌমাছি৷ সর্ষেচাষের জন্য এলাকার চাষিরা এই মৌমাছিদের উপর নির্ভর করেন৷ ঐ সর্ষের তেলেই আবার রান্না হয় কিনা!
গাছের গুঁড়িতে গর্ত করে তাতে মৌমাছির চাক বসানোয় খরচ কম৷ নেপালে যুগ যুগ ধরে এভাবেই মৌমাছি পালা হয়৷ চাষিবউ দুর্গা বোহারা মৌমাছির চাক রাখেন৷ তিনি বলেন: ‘‘আমার কাছে মৌমাছিদের গুরুত্ব অনেক৷ ওরা আমাদের মধু দেয়৷ মধু আবার একটা ওষুধও বটে৷ এছাড়া আমরা মধু বেচে কিছু কিছু রোজগার করি৷''
প্রাণিজগতের রেকর্ডধারীদের কথা
প্রাণিজগতের বৈচিত্র্য নিয়ে ভাবলে অবাক হতে হয়৷ কেউ খুব ছোট, কেউ খুব বড়৷ প্রাণীদের চলন-বলনেও কত বৈচিত্র্য! কেউ দৌড়ায় ঝড়ের বেগে, কেউ লাফিয়ে চলে, কারো আবার বিচরণ আকাশের কাছাকাছি৷ ছবিতে দেখে নিন তাদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিতা : দ্য স্প্রিন্টার
ক্ষুধার্ত চিতার সামনে পড়লে আর রক্ষা নেই, ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে চিতা৷ নিঃশব্দে শিকারের কাছাকাছি গিয়ে এমন বেগে তাড়া করতে শুরু করলে ভয়ঙ্কর এই শিকারী প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার৷ একটাই আশার কথা- চিতা বেশিক্ষণ খুব দ্রুত দৌড়াতে পারেনা৷ তাই কয়েকশ মিটারের মধ্যে ধরতে না পারলে হরিণের মতো পছন্দের খাবার হাতছাড়া করার হতাশায়ও ভুগতে হয় চিতাকে৷
ছবি: Fotolia/stephane angue
গতির সঙ্গে কষ্টসহিষ্ণুতা
‘প্রংহর্ন’ অন্য হরিণদের মতোই ক্ষিপ্রগতির হলেও এক জায়গায় পৃথিবীর বাকি প্রাণীদের চেয়ে এগিয়ে৷ কিছু প্রাণী শুরুতে খুব দ্রুত ছুটতে পারলেও কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, ফলে গতিও কমে আসে দ্রুত৷ প্রংহর্ন সেরকম নয়৷ পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত অনায়াসে ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারে৷ ফলে চিতা, বাঘ, সিংহ বা অন্য যে-কোনো প্রাণীই শিকার করতে আসুক, শুরুর ঝড়টা সামলে নিলে প্রংহর্নকে আর কে পায়!
ছবি: Getty Images
দ্রুততম পাখি
সব পাখি কিন্তু ওড়ে না৷ কোনো কোনো পাখি ডানা না মেলে দু পায়ে ছুটতেই বেশি ভালোবাসে৷ বিশালদেহী উটপাখি তো উড়তেই পারেনা৷ তবে দৌড়ায় অবিশ্বাস্য গতিতে৷ ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার গতিতে ছোটে বলে তারা যে শুধু পাখিজগতের দ্রুততম সদস্য তা-ই নয়, অন্তত আধঘণ্টা পর্যন্ত ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটারের বেগ ধরে রাখতে পারে বলে তাদের কষ্টসহিষ্ণুতারও প্রশংসা করতে হয় আলাদাভাবে৷
ছবি: AP
‘শকুন হইতে সাবধান’
১৯৭৩ সালে একটা বিমান প্রায় বিধ্বস্ত হতে বসেছিল শকুনের কবলে পড়ে৷ ১১ হাজার ২০০ মিটার অর্থাৎ ৩৬ হাজার ৭৪৫ ফুট ওপর দিয়ে উড়ছিল বিমানটি৷ এক রুপেল শকুন উড়তে উড়তে সেখানে গিয়ে হাজির এবং বিমানের সঙ্গে ধাক্কা৷ পাখি সাধারণত ১০০ থেকে ২,০০০ মিটার উঁচুতে ওড়ে৷ শুধু অভিবাসী পাখিরাই প্রবল শীতে মৃত্যুর আশঙ্কা থেকে বাঁচতে যখন দেশান্তরী হয়, বিশেষ করে যখন হিমালয়ের ওপর দিয়ে উড়তে হয়, তখন বড় জোর ৯,০০০ মিটার উঁচুতে ওঠে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সবচেয়ে উঁচুতে লাফ
বিশাল আকৃতির বুনো বেড়াল শ্রেণির এই প্রাণী একেবারে জায়গায় দাঁড়িয়ে সাড়ে পাঁচ মিটার, অর্থাৎ ১৮ ফুট ওপরের মগডাল থেকে শিকার ধরে আনতে পারে৷ স্থলচর আর কোনো প্রাণী লাফিয়ে এত উঁচুতে উঠতে পারেনা৷ ৫০ কেজি ওজনের শরীর নিয়ে পুমা কী করে যে এত উঁচুতে লাফিয়ে উঠতে পারে, কে জানে! প্রাণীকুলে ডলফিনই শুধু পুমার চেয়ে বেশি, ৭ মিটার উঁচুতে উঠতে পারে লাফিয়ে৷ তবে জলচর ডলফিন লাফের আগে অনেকটা পথ সাঁতরে গতি বাড়িয়ে নেয়৷
ছবি: Bas Lammers
সবচেয়ে ছোট পাখি
সবচেয়ে ছোট পাখির নাম হামিং বার্ড৷ সাধারণ জ্ঞানের বই পড়ে এটা নিশ্চয়ই অনেক আগেই জেনে গেছেন সবাই৷ সবচেয়ে ছোট হামিং বার্ডের শরীর দুই ইঞ্চি বা ৬ সেন্টিমিটারের মতো৷ ওজন অন্য পাখির পালকের সমান, মাত্র ২ গ্রাম! খুব ছোট পাখি, খুব ছোট ডানাও তাদের৷ তাই উড়তে হয় অনেক কষ্ট করে৷ ওড়ার সময় সেকেন্ডে ৪০ থেকে ৫০ বার ডানা ঝাপটায় হামিং বার্ড৷
ছবি: Fabian Schmidt
সবচেয়ে গভীরে
ডাইভ দিয়ে সমুদ্রের পানির ৩,০০০ মিটার গভীরে চলে যায় তিমি৷ একঘণ্টা শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ করে থাকতেও পারে সেখানে৷ আর কোনো স্তন্যপায়ী প্রানী পানির এত গভীর তলদেশে যেতে পারে না৷ এতক্ষণ ধরে তিমির মতো শ্বাস বন্ধ রাখাটা অন্য কোনো প্রাণীর পক্ষে সম্ভব নয়৷ তিমি নাকি ডাইভ দেয়ার সময়ই মস্তিস্ক আর হৃৎপিণ্ডে রক্ত পাঠিয়ে দেয়৷ আর এভাবেই দম বন্ধ করে ঘণ্টা পার করার জাদু দেখায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই প্রাণী৷
ছবি: 2010 Universum Film GmbH / Richard Herrmann
খরতাপে নির্বিকার
‘অরিক্স’ হরিণ ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তপ্ত হাওয়া গায়ে মেখে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায়৷ মানুষ হলে অমন তাপে মৃত্যু নির্ঘাত৷ অরিক্সের দেহের রক্ত শীততাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷ তাছাড়া তৃষ্ণা খুব কম পায় বলে অন্য প্রাণীদের মতো গরমে ঘন ঘন পানি পান করারও দরকার পড়েনা৷ সপ্তাহে একবার পানি পান করলেই সুস্থ থাকে অরিক্স৷ এমন হলে কারো গায়ে তাপ দুর্ভোগ হয় কী করে!
ছবি: picture-alliance/zb
সেরা কান
প্রাণীকুলে সেরা কান বাঁদুরের৷ নিশাচর এই প্রাণী তার বড় বড় কান শব্দের উৎসের দিকে ঘোরালে যেন দীর্ঘ এক চোঙ চলে যায় সেখানে, টেনে নিয়ে আসে শব্দকে৷ ঘুটঘুটে অন্ধকারেও বাঁদুরের তাই পোকামাকড় ধরে খেতে কোনো অসুবিধা হয়না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
লাফের আসল চ্যাম্পিয়ন
মাছিদেরও আছে অসাধারণ এক ক্ষমতা৷ শরীরের উচ্চতার চেয়ে ২০০ গুণ উঁচুতে লাফিয়ে উঠতে পারে তারা৷ ফ্রগহপার তো আরেক কাঠি সরেস৷ নিজের শরীরের উচ্চতার চেয়ে ৪০০ গুণ বেশি উঁচুতে এক লাফে হেসেখেলে উঠে যায় তারা!
ছবি: picture-alliance/dpa
10 ছবি1 | 10
ইউরোপ বনাম এশিয়া
এশীয় মৌমাছি ছাড়া নেপালের চিউরি গাছগুলো বাঁচতেই পারতো না৷ বর্ষাকালে পাহাড়ের ধস রোখার জন্য এই চিউরি গাছগুলো বিশেষ উপকারী৷ প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভরতপুর শহর হল নেপালের তরাই অঞ্চলের পঞ্চম বৃহত্তম শহর৷ তরাই হল দক্ষিণ নেপালের নীচু জলাভূমি অঞ্চল৷
এখানেও গ্রামাঞ্চলে মৌমাছির কমতি নেই, তবে এগুলো এশীয় মৌমাছি নয়: এরা হল আপিস মেলিফেরা, ইউরোপীয় মৌমাছি৷ নব্বই-এর দশকে এই ইউরোপীয় মৌমাছি নেপালে চালু করা হয়; সে যাবৎ তরাই অঞ্চলে ইউরোপীয় মৌমাছি এশীয় মৌমাছিকে বিতাড়ন করেছে৷
জীববিজ্ঞানী উমা পরতাপ স্থানীয় মৌমাছিদের সুরক্ষার জন্য সর্বসাধ্য করছেন৷ নেপালের মধুচাষিদের সংগঠন ফেডারেশন অফ নেপাল বি-কিপার্স-এর প্রতিনিধি ঠাকুর দাওয়াদি বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন: ‘‘ইউরোপীয় মৌমাছি থেকে আমরা বছরে নয় থেকে দশবার মধু পেতে পারি৷ কোথাও যথেষ্ট খাদ্য না থাকলে ইউরোপীয় মৌমাছিদের অন্যত্র নিয়ে যাওয়া যায়৷ কাজেই মধুচাষিরা ইউরোপীয় মৌমাছিদেরই পছন্দ করেন৷''
ইউরোপীয় মৌমাছি কী ভাবে এশীয় মৌমাছির বিকল্প হয়ে দাঁড়াল, তার আরো অনেক কারণ আছে: যেমন মৌমাছির সংক্রামক রোগ৷ ইসিমড কেন্দ্রের বায়োলজিস্ট উমা পরতাপ জানান: ‘‘শুরুতে ইউরোপীয় মৌমাছি থেকে এশীয় মৌমাছিদের মধ্যে নানা ধরনের রোগ ছড়ায়, প্রধানত ব্রুট গোত্রীয় রোগগুলি, যেমন ফাউল ব্রুট৷ এই সব রোগ এশীয় মৌমাছিদের পক্ষে বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি করেছে৷''