নেপাল প্রধানমন্ত্রী ওলির পদত্যাগ, উদ্ধারে সেনাবাহিনী
৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী তরুণদের বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে ১৯ জন বিক্ষোভকারী নিহত এবং শত শত আহত হওয়ার পর পদত্যাগ করলেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি।
পুলিশের গুলিতে ১৯ জন বিক্ষোভকারী নিহত এবং শত শত আহত৷ছবি: Safal Prakash Shrestha/ZUMA/picture alliance
বিজ্ঞাপন
বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবন, নেতাদের বাসভবনসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অফিস ভাঙচুর করার পর এবং অন্যান্য শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর এই ঘোষণা আসে। জেনারেশন জেড বা জেন-জি নামে পরিচিত তরুণদের বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।
নেপালি কংগ্রেস দলের সমর্থনে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ওলি বিক্ষোভে প্রাণহানির পর থেকে ব্যাপক চাপের মুখে পড়েছিলেন। বিক্ষোভকারী এবং অধিকার গোষ্ঠীগুলো নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের অনুমোদন দেওয়ার জন্য তার প্রশাসনকেই দায়ী করেছে।
অলির পদত্যাগকে অনেকেই তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। ২০১৫-১৬, ২০১৮-২১, ২০২১ সালে সংক্ষিপ্ত সময় এবং আবার ২০২৪ সালের জুলাই থেকে পদত্যাগ করার আগ পর্যন্ত চারবার নেপালের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন কেপি শর্মা ওলি।
জাতীয়তাবাদী নীতির জন্য পরিচিত ওলি স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও শিগগিরই তার বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার অভিযোগ উঠতে শুরু করে।
মন্ত্রীদের সরিয়ে নিতে সেনাবাহিনী
এর আগে প্রধানমন্ত্রী ওলির বাসভবনসহ বিভিন্ন মন্ত্রীর বাসভবনে হামলা চালান বিক্ষোভকারীরা। নিরাপত্তার স্বার্থে নেপালি সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে তাদের বাসভবন থেকে উদ্ধার করে। বেশ কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সামরিক ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পার্লামেন্ট ভবনের সুরক্ষার জন্যও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
নেপালের গণমাধ্যম নেপালি টাইমস জানিয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা, তার স্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরজু রানা দেউবার ওপরও তাদের বাসভবনে হামলা করেছে বিক্ষোভকারীরা।
প্রধানমন্ত্রী ওলির পদত্যাগের পরও কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভ শান্ত হয়নি বলে জানাচ্ছে দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যম।
বিক্ষোভে নেপালের প্রধানমন্ত্রী ওলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার পর, সবার দৃষ্টি এখন কাঠমান্ডুর মেয়র বলেন্দ্র শাহের দিকেছবি: Diwakar Rai/DW
কারাগার ঘেরাও করে রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি
নাকখু কারাগারের বাইরে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি- আরএসপি এর চেয়ারপারসন রবি লামিছানেকে কারাগারের বাইরে আনা হয়েছিল বলে জানিয়েছে দেশটির আরেকটি গণমাধ্যম দ্য হিমালয়ান টাইমস।
সোশ্যাল মিডিয়ায় আরএসপির কেন্দ্রীয় সদস্য ক্রান্তিশিখা ধিতালের শেয়ার করা একটি ভিডিওতে দেখা যায় কারাগারের সামনে জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছেন লামিছানে।
অন্যান্য বন্দিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তাকে মুক্তি দেওয়া হয়ে থাকতে পারে বলেও জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি।
সমবায় সঞ্চয়ে অনিয়মের এক মামলায় লামিছানেকে আটক করা হয়েছিল।
ভুল স্বীকার ও পদত্যাগের কিছু উদাহরণ
দায় স্বীকার ও ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভুল স্বীকার করে পদত্যাগের উদাহরণ সারা বিশ্বে কিন্তু কম নেই৷ ছবিঘরে দেখুন দায় স্বীকার ও পদত্যাগের বড় কিছু উদাহরণ৷
ছবি: Michele Spatarii/AP Photo/picture alliance
রিচার্ড নিক্সন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৯৭৪)
অ্যামেরিকার ইতিহাসে একমাত্র প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন, যিনি পদত্যাগ করেন৷ ১৯৭২ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদর দফতরে পাঁচজন ধরা পড়ে। নিক্সন সেই তথ্য গোপনের চেষ্টা করেন। ১৯৭৪ সালে কংগ্রেসে তার বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরুর সম্ভাবনা দেখা দিলে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে তিনি গোপন টেপের কিছু অংশ প্রকাশ করতে বাধ্য হন৷ তাতে তিনি যে তদন্তে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন তা স্পষ্ট হয়।
ছবি: Harvey Georges/AP Photo/picture alliance
জন প্রোফুমো, যুক্তরাজ্য (১৯৬৩)
ষাটের দশকে যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে ঝড় তুলেছিল ব্রিটিশ সেক্রেটারি অফ স্টেট অফ ওয়ার জন প্রোফুমোর সঙ্গে ১৯ বছর বয়সি মডেল ক্রিস্টিন কিলারের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক৷ এ বিষয়ে সংসদে মিথ্যা তথ্য দিলেও পরে তদন্তে সত্য প্রকাশ পায় ও পদত্যাগ করেন প্রোফুমো৷ এই ঘটনাটি জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বড় প্রশ্ন তুলেছিল, কারণ, ক্রিস্টিন কিলার তখন সোভিয়েত নৌবাহিনীর সদস্য ইয়েভগেনি ইভানোভের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
ছবি: Douglas Miller/Getty Images
কার্ল-থিওডর ৎসু গুটেনবের্গ, জার্মানি (২০১১)
পিএইচডি থিসিসে নকল করে তৎকালীন জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গুটেনবার্গ পদত্যাগ করেন। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রকাশ পায়। তিনি স্বীকার করেন, তার থিসিসের অনেক অংশ অনুমতি ছাড়া অন্য লেখকদের কাজ থেকে নেওয়া হয়েছে এবং যথাযথভাবে সূত্রও উল্লেখ করা হয়নি। এই কেলেঙ্কারির ফলে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় তার ডক্টরেট ডিগ্রি বাতিল করে দেয় এবং গুটেনবার্গ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পদ ছাড়ার ঘোষণা দেন।
ছবি: Achim Scheidemann/dpa/picture alliance
ইউকিয়ো হাটোয়ামা, জাপান (২০১০)
তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী হাটোয়ামা প্রতিশ্রুতি দেন যে, ওকিনাওয়া দ্বীপ থেকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি সরিয়ে নেবেন। প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতা এবং সরকারের অদক্ষতা সমালোচনার মুখে পড়ে। একই সময় দুর্নীতির অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে। অবশেষে ২০১০ সালের জুনে তিনি জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতা ও দুর্নীতির দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করেন৷
ছবি: picture alliance/dpa
চোই কিয়ুং-হোয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া (২০১৬)
চোই কিয়ং-হোয়ান ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থমন্ত্রী ও উপ-প্রধানমন্ত্রী। ২০১৬ সালে এই দুই পদ থেকে সরে দাঁড়ান। সেই সময় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক গেয়ুন-হেয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল৷ তদন্ত চলছিল তার প্রশাসনের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে। এই দুর্নীতি কেলেঙ্কারির প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক চাপ এবং তদন্তের সম্ভাবনাই চোই কিয়ং-হোয়ানকে পদত্যাগে বাধ্য করে।
ছবি: Yonhap/picture alliance
জেকব জুমা, সাউথ আফ্রিকা (২০১৮)
তার নিজের দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি) একাধিক দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগের কারণে তাকে পদত্যাগ করতে বলে৷ ২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত ভাষণে তিনি সাউথ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়ার ঘোষণা দেন৷ তিনি বলেন, যদিও তিনি দলের সিদ্ধান্তের সাথে একমত নন, তবুও দেশের শান্তি ও দলীয় ঐক্য রক্ষার জন্য পদত্যাগ করছেন।
ছবি: Michele Spatarii/AP Photo/picture alliance
ডেভিড গ্যারেট, নিউজিল্যান্ড (২০১০)
১৯৮৪ সালে মারা যাওয়া এক শিশুর পরিচয় ব্যবহার করে জাল পাসপোর্ট করিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের সংসদ সদস্য ডেভিড গ্যারেট৷ ২০১০ সালে এই খবর প্রকাশিত হলে তিনি প্রথমে তার দল অ্যাক্ট পার্টি ও সংসদ সদস্যের পদ ত্যাগ করেন৷ পদত্যাগের সময় জানান, পুরো ঘটনার জন্য তিনি গভীরভাবে অনুতপ্ত৷
ছবি: K. Steinkamp/McPHOTO/blickwinkel/picture alliance
7 ছবি1 | 7
কাঠমান্ডুর মেয়রের পক্ষে সমর্থন বাড়ছে
বিক্ষোভে নেপালের প্রধানমন্ত্রী ওলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার পর, সবার দৃষ্টি এখন কাঠমান্ডুর মেয়র বলেন্দ্র শাহের দিকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণায় পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকেই নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করছেন অনেকে।
বিক্ষোভের মধ্যেই, র্যাপার থেকে রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া শাহ বিক্ষোভকারীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন।
এক ফেসবুক পোস্টে কাঠমান্ডুর মেয়র বলেছিলেন, আয়োজকদের দ্বারা নির্ধারিত বয়সসীমার কারণে তিনি বিক্ষোভে সরাসরি উপস্থিত থাকতে পারেননি। তবে তিনি বিশ্বাস করেন যে তাদের দাবি শোনা প্রয়োজন। জেন-জি বিক্ষোভকারীরা ২৮ বছরের কম বয়সিদের তাদের বিক্ষোভে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এডিকে/এসিবি (রয়টার্স, এএফপি, কাঠমান্ডু পোস্ট, নেপালি টাইমস, দ্য হিমালয়ান টাইমস)