সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন এমানুয়েল মাক্রোঁ৷ ইউরোপে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লো৷ জনমোহিনী ‘পপুলিজম'-এর গ্রাস থেকে রক্ষা পেলো আরও একটি দেশ৷
ছবি: Reuters/B. Tessier
বিজ্ঞাপন
ট্রাম্প ও ব্রেক্সিটের ফলে ‘অঘটন' আজ অনেক বাস্তব আশঙ্কা হয়ে উঠেছে৷ তাই জনমত সমীক্ষায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্বে এমানুয়েল মাক্রোঁ বেশ বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও ফল প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত কেউ নিশ্চিত হতে পারছিলেন না৷ তার উপর রবিবার দিনের শেষেও যখন দেখা গেল, ভোটগ্রহণের হার প্রথম পর্বের তুলনায় কম – তখন উত্তেজনা বাড়ছিল৷ অনেকের মনে আশঙ্কা জাগছিল, উগ্র দক্ষিণপন্থি প্রার্থী মারিন ল্য পেন তাঁর সমর্থকদের ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে যেতে উৎসাহ দিতে পারলেও মাক্রোঁ-সমর্থকরা হয়তো বিশাল সংখ্যায় ভোট দিতে যাচ্ছেন না৷
কিন্তু স্থানীয় সময় রাত ৮ টার পর যখন ফলাফলের পূর্বাভাষ প্রকাশিত হলো, তখন হাঁফ ছেঁড়ে বাঁচলো গোটা দেশ বা আরও ভালো করে বললে, গোটা ইউরোপ৷ সাম্প্রতিক কালে ফ্রান্সের কোনো নির্বাচন নিয়ে এমন মাত্রায় আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি৷ মূল স্রোতের রাজনৈতিক দলগুলিকে পেছনে ফেলে দুই প্রান্তিক প্রার্থীর মধ্যে কে শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেন, তার উপর ফ্রান্স তথা ইউরোপের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছিল৷ বিপুল ব্যবধানে মাক্রোঁর জয়ের ফলে সব উৎকণ্ঠা দূর হলো৷
জয়ের পর ৩৯ বছর বয়স্ক এমানুয়েল মাক্রোঁ ফ্রান্সের সমাজে তীব্র বিভাজনের কথা স্বীকার করে নেন৷ তিনি বলেন, তিনি মানুষের ক্রোধ, উৎকণ্ঠা, সংশয় সম্পর্কে সচেতন৷ তিনি মন দিয়ে সেই কণ্ঠ শুনবেন বলে জানিয়েছেন৷ মাক্রোঁ মনে করেন, ইউরোপের নাগরিক ও ইউরোপের মধ্যে সংযোগ আবার গড়ে তোলাই তাঁর বৃহত্তর দায়িত্ব৷
ফ্রান্সের নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হবার পর ইউরোপ, তথা গোটা বিশ্ব থেকে অভিনন্দনবার্তা আসতে শুরু করেছে৷ ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জঁ ক্লোদ ইয়ুংকার মাক্রোঁর উদ্দেশ্যে বলেন, তিনি যেভাবে শক্তিশালী ও প্রগতিশীল ইউরোপের ধারণা তুলে ধরেছেন, তাতে তিনি (ইয়ুংকার) খুবই আনন্দিত৷ জার্মান চ্যান্সেলার আঙ্গেলা ম্যার্কেল টেলিফোনে মাক্রোঁকে অভিনন্দন জানান৷ ইউরোপের চালিকাশক্তি হিসেবে ফ্রান্স ও জার্মানির সহযোগিতার বিষয়ে তিনি অত্যন্ত আশাবাদী৷ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাঁর অভিনন্দনবার্তায় ফ্রান্সের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার করার কথা বলেন৷
পুঁজিবাজারেও ফ্রান্সের নির্বাচনের ফলাফলের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে৷ মাক্রোঁর জয়ের ফলে অনেক অনিশ্চয়তা দূর হওয়ায় ইউরো এলাকায় প্রবৃদ্ধির আশা অনেক বেড়ে গেছে৷
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্বে শুধু দুই প্রার্থীর মোকাবিলা হচ্ছে না, দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন ভবিষ্যতের স্বপ্নের মধ্যে সংঘাত ঘটছে৷ ফলাফলের প্রভাব ফ্রান্সের সীমা ছাড়িয়ে ইউরোপ তথা গোটা বিশ্বের উপর পড়তে পারে৷
ছবি: Reuters/R. Pratta
মুক্ত, উদার, ইউরোপপন্থি
মধ্যপন্থি প্রার্থী এমানুয়েল মাক্রোঁ ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেই ফ্রান্সের অবস্থান আরও মজবুত করতে চান৷ দেশের জর্জরিত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে তিনি কোম্পানিগুলির উপর করের হার কমানো এবং বিপুল রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছেন৷
ছবি: Reuters/P. Wojazer
ইউরোপের সামনে চ্যালেঞ্জ
মারিন ল্য পেন যেভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তথা অভিন্ন মুদ্রা ইউরো ত্যাগ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন, তা গোটা ইউরোপে স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি৷ চূড়ান্ত নির্বাচনের আগে তিনি এ বিষয়ে কিছুটা সুর নরম করলেও এমন ইউরোপ-বিদ্বেষ নিয়ে দুশ্চিন্তার বড় কারণ থেকে যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/K. Zihnioglu
অভিন্ন মুদ্রার সংকটের আশঙ্কা
ইউরোপের দক্ষিণের কয়েকটি দেশে আর্থিক ও অর্থনৈতিক সংকটের পর ইউরো এলাকায় স্থিতিশীলতা আনতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷ ইউরোপের চালিকা শক্তি হিসেবে জার্মানি ও ফ্রান্স এই কাঠামোর মূল ভিত্তি৷ ল্য পেন ক্ষমতায় এলে ইউরো এলাকায় চরম অরাজকতার আশঙ্কা রয়েছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/Schönberger
রাশিয়ার ‘কালো ছায়া’
গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের জোরালো অভিযোগ নিয়ে যখন তদন্ত চলছে, তখন ইউরোপেও রাশিয়ার ‘কালো ছায়া’র বিষয়টি বারবার উঠে আসছে৷ মারিন ল্য পেন মস্কোর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি গোপন করেন না৷ এমনকি রাশিয়া থেকে আর্থিক সাহায্যও পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Klimentyev
অভিবাসন নিয়ে মতপার্থক্য
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের পর শরণার্থীদের ঢল নিয়ে ইউরোপের রাজনীতি উত্তাল হয়ে উঠেছিল৷ তার সুযোগ নিয়ে মারিন ল্য পেন বিদেশি, শরণার্থী ও অভিবাসীদের ক্ষেত্রে কঠোর নীতির অঙ্গীকার করেছেন৷ ফ্রান্সের সীমা আর উন্মুক্ত রাখতে চান না তিনি৷ অন্যদিকে মাক্রোঁ শরণার্থীদের প্রতি উদার নীতিতে বিশ্বাসী৷
ছবি: picture-alliance/AA/NnoMan Cadoret
জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ফ্রান্সের কাঠামো ঢেলে সাজাতে চান মারিন ল্য পেন৷ সামরিক জোট ন্যাটোয় ফ্রান্সের ভূমিকা থেকে শুরু করে আরও পুলিশ নিয়োগ করতে চান তিনি৷ বিদেশি বংশোদ্ভূত অপরাধীদের বহিষ্কারের পরিকল্পনাও আছে তাঁর৷ মাক্রোঁ নিরাপত্তা জোরদার করতে চাইলেও নাগরিক অধিকার খর্ব করার বিরোধী৷