দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিশ্বের নানা প্রান্তের মানু্ষ৷ বাংলা ইন্টারনেট কমিউনিটিতেও শোকের ছায়া৷ এই মহানায়কের স্মরণে মন্তব্য করছেন অনেকে৷
বিজ্ঞাপন
‘‘বহুরাত জাগার জন্য অনেক সুন্দর ভোর দেখেছি৷ আজ ভোর শুধু দুঃখ নয় গর্ব ডেকে আনল৷ যদি বেঁচে থাকি এর পরের সব প্রজন্মকে বলতে পারব৷ আমি নেলসন ম্যান্ডেলাকে দেখেছি,'' ফেসবুকে গভীর রাতে লিখেছেন ইরেশ জাকের৷ এই অভিনেতার স্ট্যাটাসে মন্তব্য করেছেন অনেকে৷ সেখানে নিরব তাহসান লিখেছেন, ‘‘অসাধারণ একজন নেতাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল৷ যারা শত বর্ষে আসে না৷''
নেলসন ম্যান্ডেলা: স্বাধীনতার কণ্ঠ
নেলসন ম্যান্ডেলার হাসিমাখা এই মুখের কথা দক্ষিণ আফ্রিকার বেশিরভাগ মানুষেরই মনে থাকবে৷ যাঁকে সবাই ভালোবেসে ‘মাদিবা’ নামেই ডাকতেন৷
ছবি: Getty Images
বিদায়, নেলসন ম্যান্ডেলা
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জেকব জুমা বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় রাতে টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে জানান নেলসন ম্যান্ডেলা আর নেই৷ দীর্ঘদিনের অসুস্থতার ফলে এই দুঃসংবাদের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা সহ গোটা বিশ্ব প্রস্তুত থাকলেও এই মুহূর্ত কারো কাছেই কাম্য ছিল না৷
ছবি: Getty Images
প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ
১৯৯৪ সালের ১০ মে নতুন ইতিহাসের জন্ম হয়৷ গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন৷ ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন৷
ছবি: AP
গান্ধী থেকে অনুপ্রেরণা
অহিংস আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধীর জীবন একসময় নেলসন ম্যান্ডেলার জন্য বড় প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল৷ তাইতো ২৭ বছরের কারাজীবন শেষে যখন তিনি বাইরে বেরিয়ে আসেন তখন ম্যান্ডেলা সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে অহিংস আন্দোলনকেই বেছে নিয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AP/DW
যুগান্তকারী এক পরিবর্তন
নেলসন ম্যান্ডেলার হাসিমাখা এই মুখের কথা দক্ষিণ আফ্রিকার বেশিরভাগ মানুষেরই মনে থাকবে৷ যাঁকে সবাই ভালোবেসে ‘মাদিবা’ নামেই ডাকতেন৷ আর যাঁর অবদান বিশ্বের ইতিহাসে এনে দিয়েছে যুগান্তকারী এক পরিবর্তন৷ ম্যান্ডেলা তাঁর জীবনের প্রায় তিন দশক কাটিয়েছেন কারাগারে৷
ছবি: Reuters/Mark Wessels
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আইনজীবী
১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ প্রদেশে জন্ম নেন নেলসন রোলিলালা ম্যান্ডেলা৷ উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর তিনি আইন পড়ার সিদ্ধান্ত নেন৷ ছাত্র হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি, বিশেষ করে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে শিক্ষাজীবন থেকেই সংগ্রাম চালিয়েছেন ম্যান্ডেলা৷ ১৯৫২ সালে তিনি জোহানেসবার্গে অলিভার টাম্বোকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আইনচর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন৷
ছবি: AP
বর্ণবিদ্বেষ
বর্ণবিদ্বেষ – সোজা কথায় বললে কৃষ্ণাঙ্গ এবং শেতাঙ্গদের মধ্যকার মৌলিক বিভাজন – শিশু এবং তরুণকালে ম্যান্ডেলার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে৷ ফলে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন তিনি৷ কোসা ভাষায় ম্যান্ডেলার বাবা তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘‘রোলিলালা৷’’ এই নামের অর্থ হচ্ছে, ‘‘যিনি শাখা ভেঙে দেন’’, কথ্যভাষায় ‘‘সমস্যা সৃষ্টিকারী৷’’
ছবি: AP
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
১৯৬৪: বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট ম্যান্ডেলা এবং অন্যদের শুনানি চলছিল আদালতে৷ কিন্তু পুলিশ সেই আদালতের বাইরে অবস্থানরতদের সরিয়ে দেয়৷ তথাকথিত ‘রিভোনিয়া ট্রায়াল’ এ ম্যান্ডেলাকে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়৷
ছবি: AP
দীর্ঘ কারাজীবন
রবেন দ্বীপের কারাগারে একটি পাঁচ বর্গমিটার ঘরে ১৮ বছর কাটিয়েছেন ম্যান্ডেলা৷ তাঁর পরিচয় নম্বর ছিল ৪৬৬৬৪৷ জেল থেকে মুক্তির পর ম্যান্ডেলা বলেন, ‘‘আমি একটি নম্বর হিসেবে পরিচিত ছিলাম৷’’
ছবি: cc-by-sa- Paul Mannix
গোটা বিশ্বের আগ্রহ
১৯৮৮ সালে লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে নেলসন ম্যান্ডেলার জন্য একটি দাতব্য সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়৷ সেই অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি সংগীতশিল্পীরা ম্যান্ডেলার সত্তরতম জন্মদিন উদযাপন করেছেন এবং বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷ দশঘণ্টার সেই কনসার্টে হাজির হয়েছিলেন সত্তর হাজার মানুষ, যা ষাটটির বেশি দেশে সম্প্রচার হয়েছিল৷
ছবি: AP
অবশেষে মুক্তি
১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি - সাতাশ বছর পর - কারাগার থেকে মুক্তি পান ম্যান্ডেলা৷ ছবিতে মুষ্টিবদ্ধ হাত উচিয়ে ম্যান্ডেলা এবং তাঁর তৎকালীন স্ত্রী উইনি দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বিরুদ্ধে নিজেদের বিজয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছেন৷
ছবি: AP
রাজনীতিতে ফেরা
১৯৯০ সালের মে মাসে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি)-র হাল ধরেন ম্যান্ডেলা এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রিডেরিক উইলিয়াম ডি ক্লার্ক (বামে) সঙ্গে আলোচনায় নেতৃত্ব দেন৷ এই আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বর্ণবিদ্বেষ মুছে ফেলার উপায় বের করা৷ ১৯৯৩ সালে তিনি এবং ক্লার্ক নোবেল শান্তি পুরস্কার জয় করেন৷
ছবি: AP
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট
১৯৯৪ সালের ১০ মে দিনটি ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে৷ সে বছরের এপ্রিলে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়লাভের পর সেদিন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ম্যান্ডেলা৷ ১৯৯৯ সাল অবধি এই দায়িত্বে ছিলেন তিনি৷ পরবর্তীতে তাঁর কাছ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাবো এমবেকি৷
ছবি: AP
‘‘রেইনবো নেশন’’ কি ব্যর্থ হয়েছে?
২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বড় শহরগুলোর অনেক বস্তিতে বিদেশি বিদ্বেষ এবং সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে৷ এ সময় অনেক অভিবাসী প্রাণ হারায়৷ ফলে যে প্রশ্নটি দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে যে ‘‘রেইনবো নেশন’’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ম্যান্ডেলা, বিশেষ করে যেখানে সবার মিলে মিশে থাকার কথা, সেটি কি ব্যর্থ হয়েছে?
ছবি: AP
ক্রীড়াপ্রেমী ম্যান্ডেলা
যুব বয়সে নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন একজন বক্সার৷ খেলাধুলা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ছিল এরকম – খেলায় শ্রেণি, ধর্ম বা বর্ণের কোনো ভূমিকা নেই৷ ক্রীড়াপ্রেমি ম্যান্ডেলা কারাগারে থাকার সময়ও নিজেকে ফিট রেখেছেন৷ সেখানে তিনি নিয়মিত ব্যায়াম করতেন৷
ছবি: Getty Images
শেষবার জনসম্মুখে
২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ আর সেসময়ই ম্যান্ডেলাকে শেষবারের মতো জনসম্মুখে দেখা গিয়েছিল৷ উপরের ছবিটি ২০০৪ সালের ১৫ মে তারিখের৷ কারণ ঐ বছরই দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচিত হয়৷
ছবি: AP
ম্যান্ডেলার সঙ্গে ড. ইউনূস
২০০৯ সালে ম্যান্ডেলার ৯১তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে আয়োজিত উৎসবে বক্তব্য রেখেছিলেন বাংলাদেশের নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷ ম্যান্ডেলার মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীকে লেখা চিঠিতে ইউনূস ঐ ঘটনাটিকে তাঁর জীবনের অন্যতম সুখকর ঘটনা বলে মন্তব্য করেছেন৷
ছবি: AP
জীবনের শেষ দিনগুলো
ম্যান্ডেলা তাঁর জীবনের শেষ কয়েকটি বছর মানুষের সামনে আসেননি৷ সে সময়টুকু তিনি পরিবারের সাথে কাটিয়েছেন৷ ছবিতে ২০১১ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার ৯৩তম জন্মদিনে তাঁকে নাতি-পুতিদের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
17 ছবি1 | 17
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত সাংবাদিক গোধূলি খান লিখেছেন, ‘‘নেলসন ম্যান্ডেলা তুমি অমর কবিতার অন্ত্যমিল, তোমার চোখেতে দেখি স্বপ্ন-মিছিল৷'' আবিদ মাহমুদ লিখেছেন, ‘‘ম্যান্ডেলা দাদু বড়ই ভালো লোক ছিলেন৷ আমাগের দেশে তাঁর মতন একটা মানুষ থাকলি আমরা এতদিন সভ্য জাতি হয়ে যাইতাম৷ (বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছু বাঙ্গালীকে অসভ্য করিয়া তুলিয়াছে, যাহার দায়ভার পুরা বাঙালী জাতির উপর পড়িতেছে)৷''
কিংবদন্তি নেতা ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মুনির হাসান ফেসবুকে একটি কবিতা প্রকাশ করেছেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘এই কাল কাল মানুষের দেশে/এই কাল মাটিতে/নেলসন মান্ডেলা, তুমি/অমর কবিতার অন্ত্যমিল/তোমাকে সালাম৷''
সাংবাদিক অঞ্জন রায় ম্যান্ডেলাকে সরাসরি দেখেছেন৷ সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘মানুষ হিসেবে আমি গর্বিত৷ আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নেলসন ম্যান্ডেলা এবং ইয়াসির আরাফাত – মানব সভ্যতার এই তিন মহানায়ককে নিজের দুচোখে দেখেছি৷ নিজের দু’হাতে স্পর্শ করেছি৷''
কমিউনিটি বাংলা ব্লগ সামহয়্যার ইন ব্লগে এইচ আর খান লিখেছেন, ‘‘অবশেষে জীবনের কাছে হার মানলেন বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা৷'' একই ব্লগ সাইটে মঞ্জুর চৌধুরী লিখেছেন, ‘‘নেলসন ম্যান্ডেলা আজ দেহত্যাগ করলেন৷ একটি মহামানবের যুগের অবসান ঘটলো৷ এখন আরেক মহামানবের আগমনের প্রতীক্ষার পালা৷''
ব্লগার স্মরনিকা ধর ম্যান্ডেলাকে স্মরণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিত নিয়েও করেন তীর্যক মন্তব্য৷ তাঁর লেখার শিরোনাম, ‘‘নেলসন, তোমার জন্যে নয় আমার শোকপাত্র৷'' এই ব্লগার মনে করেন, ‘‘ম্যান্ডেলা ৯৫ বছরের জীবনে যা কিছুই করেছেন তা তাঁকে ৯৫ শতাব্দী বাঁচিয়ে রাখতে যথেষ্ট৷''
উল্লেখ্য, ৫ ডিসেম্বর, জোহানেসবার্গে নিজ বাসভবনে স্থানীয় সময় রাত সাড়ে আটটায় মৃত্যু বরণ করেন নেলসন ম্যান্ডেলা৷ তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর৷