একটা ঘটনা মনে পড়ছে, আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি৷ স্কুলে পৌঁছাতে একটু দেরি হয়ে গেছে৷ স্কুলে যাওয়ার পথে একটা বরই গাছ ছিল৷ বরই পাড়তে গিয়েই মূলত আমাদের দেরি হয়ে যায়৷ খুব রাগি শিক্ষক ছিলেন নারায়ণ স্যার৷ আমাদের ছয়জনকে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে দুই হাতে ডাস্টারের দু'টি করে বাড়ি দিলেন৷ এতটাই ব্যাথা পেলাম যে, হাত লাল হয়ে গেল, ব্যথাও করছিল৷ বাড়িতে ফিরে আমার এক বন্ধুর জ্বরও এসেছিল৷ কিন্তু আমরা কেউ বাড়ির কাউকে এই ঘটনা বলিনি৷ কারণ দোষ আমাদেরই ছিল৷ শিক্ষকের শাস্তি আমরা মেনে নিয়েছিলাম৷ পরে স্কুলে যেতে আর কোনদিন দেরি হয়নি৷ তবে বরই পাড়াও আমরা বন্ধ করিনি৷ এরপর থেকে আমরা যেটা করতাম স্কুল থেকে ফেরার পথে বরই পাড়তাম৷ কখনও আমড়া, কখনও তেঁতুল এমন অনেক ফল ছিল যেগুলো আমাদের স্কুলে যাওয়ার পথেই পড়ত৷ এই গাছগুলো যাদের ছিল তারা যে জানত না, তা নয়৷ ধরা পড়লেও খুব একটা কিছু বলেনি৷ অনেক সময় তারা পেড়েও দিয়েছেন আমাদের৷
এই ঘটনাটা বললাম এই কারণে যে, তখনকার সময় শিক্ষকেরা আদর করতেন, মারতেনও৷ অভিভাবকেরা শিক্ষকের শাস্তিকে যৌক্তিক মনে করতেন৷ শিক্ষকেরাও সেই দাবি নিয়ে শাসন করতেন৷ আমার ঘটনাটা ১৯৮৮ সালের৷ ৩৪ বছর পর এখন আমার মেয়ে স্কুলে যায়৷ বাসার পাশেই একটা বেসরকারি স্কুলে পড়ে সে৷ ওর স্কুলে শিক্ষিকারা আদর করে, কিন্তু মারধর তো দূরের কথা, শাসনই করে না৷ ফলে আমার মেয়ে শাসন বিষয়টা একেবারেই বোঝে না৷ একটা ধমক দিলেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে৷ একদিন ওর স্কুলের একজন শিক্ষিকার সঙ্গে এই বিষয়টা নিয়েই কথা বলছিলাম৷ তিনি বললেন, এখনকার বাচ্চারা অনেক বেশি সেনসেটিভ৷ বকা দিলেই বাড়িতে গিয়ে বলে দেয়৷ এতে অভিভাবকেরা মন খারাপ করেন৷ অনেক অভিভাবক কৈফিয়ত চান৷ ফলে আমাদের অনেক বেশি সচেতন থাকতে হয় বাচ্চাদের পড়াতে গিয়ে৷ শাসনের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা? জবাবে ওই শিক্ষক বললেন, অবশ্যই আছে৷
এখনকার শিক্ষার্থীরা তো বরই বা তেঁতুল পেড়ে খাওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারবে না৷ কতদিন টিফিনের সময় মাঠে খেলতে গিয়ে দেরি হওয়ার কারণে মান্নান স্যারের বেতের বাড়ি এখনও মনে পড়ে৷ অথচ আমার মেয়ে তো জানেই না বেত কি?
আমার ছোটবেলার আরেকটা ঘটনা বলি, আমাদের স্কুলে তখনও শহীদ মিনার হয়নি৷ শিক্ষকেরাই আমাদের সহযোগিতা করলেন, কলা গাছ দিয়ে বানানো হল শহীদ মিনার৷ বাড়ি ফিরে সন্ধ্যার পর আমরা কয়েক বন্ধু মিলে ফুল চুরির করার জন্য নেমে পড়লাম৷ গ্রামের বেশ কয়েকটি বাড়ি ঘুরে চালন ভর্তি গাঁদা ফুল তুলে এনে মালা বানাতে শুরু করলাম৷ ভোরে সূর্য উঠার আগেই খালি পায়ে সবাই মিলে চলে যেতাম স্কুলে৷ সেখান থেকে মিছিল করে ফুল দেওয়ার পর বাড়ি ফিরতাম৷ কিন্তু আমার মেয়ের স্কুল একুশে ফেব্রুয়ারি বন্ধ থাকে৷ শোভাযাত্রা বা মিছিলের কোন ব্যবস্থা নেই৷ একজন শিক্ষক জানালেন, প্রতিদিন সকালে স্কুল করতে করতে ওরা ক্লান্ত৷ ফলে একদিন ছুটি পেলে ওরা ঘুম থেকে উঠতে চায় না৷ এ কারণে ভাষা শহীদদের নিয়ে ওদের কোন আগ্রহই তৈরি হচ্ছে না৷ বই পড়ে দু'এক লাইন জানলেও অন্তর থেকে অনুধাবন করতে পারছে না৷
আমাদের প্রতিদিন স্কুলে গেলে লাইনে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে হতো৷ আমাদের মধ্যে পালাক্রমে একজনকে সামনে গিয়ে এটা পরিচালনা করতে হতো৷ এর আগে আমাদের শপথ করানো হতো, মিথ্যা কথা বলব না, অভিভাবকদের মান্য করব, ভালো হয়ে চলব এমন অনেক কিছু৷ এই শপথের চল তো এখন উঠেই গেছে৷ সরকারি স্কুলগুলোতে জাতীয় সঙ্গীতের চল থাকলেও অনেক বেসরকারি স্কুলে জাতীয় সঙ্গীতও গাওয়া হয় না৷
আমরা শিক্ষকদের ভয় পেতাম৷ আবার মান্যও করতাম৷ দেখতাম আমাদের অভিভাবকেরাও শিক্ষকদের মান্য করতেন৷ সম্মান দিয়ে কথা বলছেন৷ ফলে আমাদের কাছে শিক্ষকদের অবস্থান ছিল অনেক উপরে৷ এখন আমরা দেখি, নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠ বস করানো হয়৷ শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের ক্লাসের কথা রেকর্ড করে আন্দোলন হয় এবং তাকে জেলেও যেতে হয়৷ দশম শ্রেণীর ছাত্রদের মধ্যে এই ধরনের ষড়যন্ত্রের মানষিকতার কথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না৷ আবার আন্তবিদ্যালয় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ফলাফল নির্ধারণ নিয়ে বাগিবতণ্ডার একপর্যায়ে বগুড়ার নন্দীগ্রামের বাঁশো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি রাশেদ আলী পিটিয়েছেন নিশিন্দারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারুনুর রশিদকে৷ সর্বশেষ গত ১০ এপ্রিল অনৈতিক ভর্তি বাণিজ্য করতে না পেরে নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক মাহবুবুর রহমানকে মারধর ও লাঞ্ছিত করেন ম্যানিজিং কমিটির অভিভাবক প্রতিনিধি সরকার আলম৷ একই কারণে আরেক অভিভাবক প্রতিনিধি ওয়াহিদ সাদত বাবু তার দাড়ি টেনে ছিড়ে দেন৷ এভাবেই এখন শিক্ষকদের সঙ্গে ব্যবহার করছেন অভিভাবক এবং অভিভাবক প্রতিনিধিরা৷ ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে কি বার্তা যাচ্ছে? অভিভাবকদের কাছ থেকে কি শিখছে তারা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক গত বুধবার বলছিলেন, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নৈতিক শিক্ষাটা হারিয়ে যাচ্ছে৷ এর জন্য শুধু শিক্ষকদের দায়ী করলে হবে না৷ আমাদের পরিবার, সমাজ থেকে কি নৈতিক শিক্ষাটা দেওয়া হচ্ছে? উত্তর আসবে না৷ ফলে কোথাও যদি সুশিক্ষা দেওয়া না হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের কাছে এই বার্তাটা যাবে কিভাবে? বিষয়টা কিন্তু আসলেই ভাবনার৷ আমাদের সন্তানেরা ঢাকা শহরের যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ছে সেখানে নেই কোন খেলার মাঠ৷ বিশেষ দিবসে তাদের স্কুলে ডাকা হচ্ছে না৷ সেখানে হচ্ছে না কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও৷ ফলে শিক্ষাটা সে পাবে কিভাবে? তৌহিদুল হক মনে করেন, এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি৷ চেষ্টা করলে অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব৷ কিন্তু চেষ্টাটা করবে কে? সে প্রশ্নের কোন উত্তর নেই৷
আমরা যখন স্কুলে পড়েছি, স্কুলের রুম থেকে শুরু করে মাঠ পরিষ্কার করার ভার ছিল আমাদের উপর৷ মেয়েরা ঝাড়– দিয়ে পরিষ্কার করত, আর আমরা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাত দিয়ে ময়লা তুলে পরিষ্কার করতাম৷ সহপাঠী বান্ধবীদের আমরা বোনই মনে করতাম৷ কত খুনসুটি হতো আমাদের মধ্যে৷ কে হিন্দু, আর কে মুসলমান কোনদিন চিন্তাতেও আসেনি৷ আর এখন নতুন করে আরেকটা বিষয় এখন সামনে এসেছে, সেটা হল স্কুলের কিছু ছাত্র অন্য ধর্মের শিক্ষককে সহ্য করতে পারছে না! কেন এমন হচ্ছে? আমরা যখন স্কুলের পড়েছি, মান্নান স্যার আমাকে মারলে কি আমার বাবা গিয়ে তার কাছে প্রতিবাদ করতেন? নাকি নারায়ণ স্যার মারলে বলতেন, ‘ঠিক আছে’? এমন তো ছিল না৷ শিক্ষক তো শিক্ষকই৷ তিনি যে ধর্মের হোন না কেন৷ তাহলে কেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন একটা মনোভাব তৈরি হলো? সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমনটা হওয়ার মূল কারণ পারিবারিক শিক্ষা৷ একটা শিশু পরিবার থেকে যে ধরনের শিক্ষা পায় সেটাই তার মানসিকতার মধ্যে ঢুকে যায়৷ স্কুলেও সে ওই চর্চাটাই করে৷ আমাদের মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ই এমন পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷