1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘নো অ্যাপোলজি ইরা' বা দায় স্বীকার না করার যুগ

১১ জুলাই ২০২৫

একবিংশ শতাব্দী থেকেই পশ্চিমা রাজনীতি বিশ্লেষকদের মুখে এই শব্দবন্ধটা ঘুরতে শুরু করেছে। রাজনৈতিকভাবে আমরা কি নো অ্যাপোলজি যুগের মধ্যে আছি?

যৌনকর্মীকে টাকা দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়া, নারীদের নিয়ে অবমাননাকর কথা বলা, ক্ষমতার অপব্যবহার, সহিংসতা উসকে দেয়ার জন্য ট্রাম্প কখনো অনুশোচনা প্রকাশ করেননি, বরং এটাকে পাত্তা না দিয়েই এগিয়ে গিয়েছেন। এর ফলে তার ভোট কি কমেছে?ছবি: Will Oliver/Pool/CNP/picture alliance

২০০৫ সাল থেকে জার্মানির চ্যান্সেলর থাকা আঙ্গেলা ম্যার্কেল যখন ঘোষণা দিলেন যে তিনি আর নির্বাচনে দাঁড়াবেন না, তখন ২০২১ সালের নির্বাচনে তার দল মধ্য-ডানপন্থি সিডিইউ থেকে চ্যান্সেলর প্রার্থী করা হয়েছিল জার্মানির সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য নর্থ-রাইন ওয়েস্টফালিয়ার মুখ্যমন্ত্রী আরমিন লাশেটকে।

সেই নির্বাচনের প্রচারণা চলাকালীন ২০২১ সালের জুলাই মাসে ভয়াবহ এক আকস্মিক বন্যায় আরভাইলারে অন্তত ১৯০ জন মারা যান। বন্যাক্রান্ত এলাকা ঘুরে তৎকালীন (এবং বর্তমান) প্রেসিডেন্ট ফ্রাংক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন একটু দূরে পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন লাশেট। এক পর্যায়ে সফরে থাকা অন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি হেসে ওঠেন। বন্যায় হতাহতদের প্রতি যখন প্রেসিডেন্ট সমবেদনা জানাচ্ছেন, তখন চ্যান্সেলর প্রার্থী লাশেটের এমন হাসিঠাট্টা করা নিয়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়।

সমালোচনার মুখে সেদিনই এক্স পোস্টে (সাবেক টুইটার) এমন কাজের পক্ষে কোনো ধরনের যুক্তি না দিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চান লাশেট।

তিনি অবশ্য চ্যান্সেলর পদ থেকে সরে দাঁড়াননি। তবে এই ঘটনার রেশ নির্বাচনেও পড়েছিল। তার দল দ্বিতীয় অবস্থানে যাওয়ার পর সরকার গঠন করতে না পারার দায় নিয়ে তিনি দল থেকেও পদত্যাগ করেন।

এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের একটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো। ২০১৮ সাল, সেটিও জুলাই মাস। ঢাকায় বিমানবন্দর সড়কে বাস চাপায় ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। তৎকালীন নৌপরিবহণ মন্ত্রী শাজাহান খানকে সেদিনই এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা এ নিয়ে প্রশ্ন করেন। জবাবে হাসতে হাসতে মন্ত্রী বলেন, ‘‘যে অপরাধ করবে সে অপরাধের শাস্তি তাকে পেতে হবে৷''

এমন ঘটনা ইউরোপের রাজনীতিতে প্রায়শই ঘটে এবং ভোটররাও এমন ঘটনা দেখতে ও প্রত্যাশা করতে অভ্যস্ত। কিন্তু দিন দিন সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

"নো অ্যাপোলজি ইরা" শব্দবন্ধটি দিয়ে আধুনিক রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান একটি প্রবণতাকে বোঝায়। যেখানে পাবলিক ফিগাররা- বিশেষ করে রাজনীতিবিদরা - স্পষ্ট অন্যায় বা জনরোষের মুখেও ক্ষমা চাওয়া বা পদত্যাগ করা তো দূরের কথা, দায় স্বীকার করাটাকেও এড়িয়ে চলেছেন।

অথচ পশ্চিমা রাজনৈতিক রীতিনীতি অনুযায়ী একসময় জনসাধারণের কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং পদত্যাগসহ জবাবদিহিতার আওতায় থাকাটা অনেকটাই প্রত্যাশিত ছিল।

বিশেষ করে পৃথিবীর গণতন্ত্রের স্বঘোষিত রক্ষাকর্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প যুগ আসার পর থেকে রাজনৈতিক রীতিনীতির যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেটিও ধূলিস্যাৎ হতে বসেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

এর পেছনে বেশ কিছু কারণও খুঁজে বের করা হয়েছে নানা গবেষণায়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে পপুলিস্ট বা জনতুষ্টিমূলক রাজনীতির উত্থানের ফলে এখন বাগাড়ম্বরকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। দোষ স্বীকার করাকে একসময় রাজনৈতিক সততা হিসাবে দেখা হলেও এখন সেটিকে দেখা হয় দুর্বলতা হিসাবে। নীতির প্রতি আস্থার চেয়ে দলীয় আনুগত্যকেই বেশি গুরুত্ব দেয়ার ফলে নেতাদের অনেক অসদাচরণকে পাত্তা দেয়া হয় না, বা সেটার পক্ষে নানা যুক্তি দিয়ে স্বাভাবিক করে তোলা হয়।

এর পেছনে গণমাধ্যমেরও ভূমিকা রয়েছে। তথ্যপ্রবাহের যুগে খুব দ্রুতই মানুষের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংবাদের গুরুত্ব পরিবর্তন হয়। ফলে গুরুতর নানা ইস্যুও দ্রুতই অন্য নানা নতুন ইস্যুর নীচে ধামাচাপা পড়ে যায়।

কিভাবে দায় স্বীকার না করেই ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়? সেটিরও নানা পদ্ধতি বের করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অন্যতম হচ্ছে, অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়া। এক্ষেত্রে আমলা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা গণমাধ্যমের ওপর দায় দিয়ে দেয়া হয়। আরেকটি উপায় হচ্ছে, যদি-তবে যুক্ত করে দায় এড়িয়ে যাওয়া। যেমন, যদি এতে কেউ মনোক্ষুণ্ণ হয়ে থাকেন, তাহলে আমি দুঃখিত। অন্য একটি পদ্ধতিতে, মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে গণমাধ্যম কিভাবে বারবার আক্রমণ করছে, বিভ্রান্তি তৈরি করছে, ভুল ব্যাখ্যা করছে ইত্যাদি আলোচনা তুলে মোড় ঘুরিয়ে দেয়া।

এই পদ্ধতিগুলো অবশ্য শুধু পশ্চিমা নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তে অনুসরণ করা হয়ে থাকে।

ভোটের সংস্কৃতিতেও এক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আসায় পরিস্থিত আরো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রেও ডনাল্ড ট্রাম্পের কথা উল্লেখ করা যায়। শুরু থেকেই নানা কেলেঙ্কারিতে তার নাম জড়িয়েছে। এর মধ্যে যৌনকর্মীকে টাকা দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়া, নারীদের নিয়ে অবমাননাকর কথা বলা, ক্ষমতার অপব্যবহার, সহিংসতা উসকে দেয়া, নানা কিছুই রয়েছে।

কিন্তু ট্রাম্প কখনো এসবের জন্য অনুশোচনা তো প্রকাশ করেনইনি, বরং এটাকে পাত্তা না দিয়েই এগিয়ে গিয়েছেন। এর ফলে তার ভোট কি কমেছে? না, বরং দ্বিতীয় বার নির্বাচনে হারলেও তিনি সেটাকে 'কারসাজি করে হারিয়ে দেয়া হয়েছে' বলে পরাজয় অস্বীকার করেছেন। তার ভোটাররাও তার বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগই কানে তোলেননি। তৃতীয়বারে আবারও তিনি নির্বাচিত হয়ে এখনও আবার 'স্বপ্নের দেশ' এর প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।

এসব নিয়ে কথা বলায়, অনেক গণমাধ্যমও ট্রাম্পের রোষানলে পড়েছে। একদিকে কিছু গণমাধ্যম নিজেদের ইচ্ছামতো মনগড়া আর তুষ্টিমূলক সংবাদ পরিবেশন করছে, অন্য়দিকে সত্যিকারের তথ্য ও বিশ্লেষণ দিয়ে প্রচার করা সংবাদ বিপক্ষে যাওয়ায় অনেক গণমাধ্যম ট্রাম্পের ভাষায় 'ফেইক নিউজ' এ পরিণত হয়েছে।

এমন ঘটনা অন্য নানা দেশের রাজনীতিবিদদের ওপরেই প্রভাব ফেলে। বাগাড়ম্বর এবং জনতুষ্টিই যে ভোট পেতে যথেষ্ট, এমন উদাহরণ তৈরি হলে অকারণে সততার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে কেন একজন রাজনীতিবিদ তার দীর্ঘদিনের কষ্টে অর্জিত ক্যারিয়ারকে জলাঞ্জলি দিবেন?

গণমাধ্যমই বা কতদিন একদিকে সরকার, অন্যদিকে জনগণের একাংশের চাপ সামলে সত্যিকারের সাংবাদিকতার মাধ্যমে জবাবদিহিতার পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারবে? এই জনতুষ্টির চাপে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তো বটেই, গণমাধ্যমও যে এখন গণতন্ত্রে স্তম্ভ হওয়ার বদলে টিআরপি, ক্লিক আর ভিউয়ের দিকে ঝুঁকেছে, সেটা তো বাংলাদেশ, ভারতসহ নানা দেশেই উদাহরণেই স্পষ্ট।

করপোরেট বা রাজনৈতিক মালিকানার বাইরে বেরিয়ে স্বাধীন কিছু গণমাধ্যম পাঠকের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বটে। কিন্তু এই যুগে গণমাধ্যম টিকিয়ে রাখতে যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও প্রয়োজন, সেটা কি বেশিদিন তারা ধরে রাখতে পারবে?

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ