আবারও নৌকাডুবি, আবারও প্রাণহানি৷ এবারের মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে উত্তরবঙ্গের করতোয়া নদীতে৷ অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে মাঝনদীতে নৌকা ডুবে গেলে অন্তত ৬৯ জন মানুষের মৃত্যু হয়, যার অধিকাংশই শিশু৷
বিজ্ঞাপন
এবারও হয়েছে তদন্ত কমিটি আর মৃতদেহ সৎকারেও স্বজনদের দেয়া হয়েছে কিছু অর্থ৷ তবে কিছুদিনের মাঝেই আমরা ঘটনাটি ভুলে যাবো৷ এরপর আবার একটি ঘটনা ঘটবে, আবার অকালে মৃত্যু হবে মানুষের৷ এযেন এক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
নদীমাতৃক বাংলাদেশে প্রায়ই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে বিভিন্ন স্থানে৷ অনেক ক্ষেত্রেই কয়েকজন মারা যায় বলে সেটা আমরা আমলে নেই না৷ সেসব ঘটনা খুব বেশি মিডিয়াতেও আসে না৷ সেসব ঘটনার তদন্ত হয় না বা মৃতের পরিবারকে কোনরুপ আর্থিক সাহায্যও দেয়া হয় না৷ তবে মৃতের সংখ্যা কিছুটা বেশি হলেই সেটা নিয়ে অনেক আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ যেমনটি হয়েছে করতোয়ায় দুর্ঘটনা ফলে৷
অসচেতনতায় মৃত্যু
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হাদিউজ্জামানের মতে, নৌ ও সড়কপথে দুর্ঘটনার ৬০ ভাগই হয় যাত্রীসহ সবপক্ষের অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে৷ ছবিঘরে দেখুন কিছু উদাহরণ৷
ছবি: bdnews24.com/M. Zaman Ovi
সড়ক ও নৌপথে মৃত্যুর সংখ্যা ও কারণ
বাংলাদেশে গত দশ বছরে নৌ দুর্ঘটনায় প্রায় দেড় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ আর সড়কপথে দুর্ঘটনায় বছরে গড়ে ছয় হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়৷ বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হাদিউজ্জামানের মতে, নৌ ও সড়কপথে দুর্ঘটনার ৬০ ভাগই হয় যাত্রীসহ সবপক্ষের অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে৷
ছবি: bdnews24.com/M. Zaman Ovi
অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে ওঠার পরিণতি
২০০৩ সালের ৮ জুলাই অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামালের কারণে এমভি নাসরিন-১ লঞ্চের তলা ফেটে ডুবে যায়৷ এতে সরকারি হিসেবে ১১০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয় এবং ১৯৯ জনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ তবে বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা অনেক বেশি (কারও মতে আটশর অধিক) বলে দাবি করা হয়৷ (ছবিটি প্রতীকী)
ছবি: AP Photo/picture alliance
নৌকা উলটে ৬৯ জনের মৃত্যু
পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীতে গত রোববার নৌকাডুবে ৬৯ জন মারা যান৷ যাত্রীরা মহালয়া উপলক্ষে বোদা উপজেলার বরদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন৷ নৌকায় সর্বোচ্চ ২০ জনের ধারণক্ষমতা থাকলেও উঠেছিলেন ১৫০ জনের বেশি৷ তখন সেখানে পুলিশ ছিল৷ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ছিলেন৷ যারা তীরে ছিলেন তারাও সাবধান করছিলেন৷ পুলিশও দুই-একবার তাদের নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু তবুও নৌকাটি ছেড়ে যায় এবং মাঝ নদীতে ডুবে যায়৷
ছবি: Firoz Al Sabah
পিনাক-৬ লঞ্চ দুর্ঘটনা
ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট মাদারীপুরের কাওড়াকান্দি থেকে মাওয়া ঘাটে যাওয়ার পথে এমএল পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ ডুবে যায়৷ ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল৷ নিখোঁজ ৬৪ যাত্রীর সন্ধান মেলেনি৷ পরে লঞ্চটি তোলা সম্ভব হয়নি, এবং এর ধ্বংসাবশেষও খুঁজে পাওয়া যায়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এমভি কোকো লঞ্চ দুর্ঘটনা
২০০৯ সালের ২৬ নভেম্বর ভোলার লালমোহনের নাজিরপুরে এমভি কোকো-৪ লঞ্চ ডুবে ৮১ জন যাত্রী প্রাণ হারিয়েছিলেন৷ অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে এই দুর্ঘটনাটি ঘটে৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
রেলক্রসিংয়ে মৃত্যু
গত আড়াই বছরে রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় ২১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে গত জুলাইতে জানায় ‘রোড সেফটি ফাউন্ডেশন৷’ দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে যানবাহনের চালক ও সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসচেতনতা ও অধৈর্য মানসিকতাকে দায়ী করেছে তারা৷ বাকি কারণগুলো হচ্ছে রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান ও গেটবারের ব্যবস্থা না থাকা, গেটম্যানদের দায়িত্বে অবহেলা, লোকবলের সংকট ও দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া ইত্যাদি৷
ছবি: bdnews24
পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু
ইউনিসেফ বলছে বাংলাদেশে প্রতিবছর পানিতে ডুবে ১৪ হাজারের বেশি শিশু মারা যায়, যা ৫ বছরের কমবয়সি শিশুদের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ এক বিবৃতিতে বলেছে, তথ্যপ্রমাণ বলে, খুব সহজেই পানিতে ডুবে যাওয়া রোধ করা যায়৷ এজন্য কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছে তারা৷ এর মধ্যে একটি পরিবার ও কমিউনিটির মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা: বেপরোয়া গতি, হেলমেট না থাকা
প্রথম আলো বলছে, এবারের রোজার ঈদের ছুটির সময় সড়কে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাদের প্রায় ৪৮ শতাংশই মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী৷ এসব দুর্ঘটনার কারণ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মোটরসাইকেলচালক ছিলেন বেপরোয়া৷ একটি মোটরসাইকেলে চালকের বাইরে সর্বোচ্চ একজন আরোহী তোলার নিয়ম থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি৷ চালক ও আরোহীদের বেশির ভাগেরই হেলমেট ছিল না৷
ছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS
8 ছবি1 | 8
অতীতের অনেক ঘটনার মত এবারেও নৌকাটিতে ছিল অতিরিক্ত যাত্রী৷ উত্তাল করতোয়া নদীতে ধারন ক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী নিয়ে মাঝ নদীতে নৌকা ডুবে যায়৷ নৌকায় যাত্রীরা সবাই ছিল হিন্দু ধর্মের৷ দুর্গা পূজার মহালয়া উপলক্ষে তারা নদীর অন্য প্রান্তে একটি মন্দিরে বিশেষ পুজা-অর্চনায় যোগ দেয়ার উদ্দেশে যাচ্ছিল৷
এমন না যে প্রথমবারেরমত তারা পূজার উদ্দেশে নদীর ওপারে যাচ্ছিল৷ বরং প্রতি বছর তারা ঐ মন্দিরে গিয়ে পুজায় অংশ গ্রহণ করে থাকে৷ বৃষ্টি ও উত্তাল নদীর অবস্থা বিবেচনা করে স্থানীয় প্রশাসনের উচিত ছিল এদিকে ভালমত নজর দেয়া, পর্যাপ্ত নৌযানের ব্যবস্থার পাশাপাশি তীর্থযাত্রীদের নিরাপদে নদী পারাপার নিশ্চিত করা৷
গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, নদী পারাপারে প্রতিদিন সাধারণত কেবল একটি শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ট্রলার চলে আউলিয়া ঘাট থেকে৷ কিন্তু মহালয়ায় হাজারো লোকের সমাগম হবে, তার প্রস্তুতি হিসেবে তাদের পারাপারে ছয়টি ট্রলার দেয়ার আবেদন করা হয়েছিল সনাতন সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে৷ কিন্তু সেদিন বরাদ্দ ছিল তিনটি ট্রলার, ফলে মানুষের বাড়তি চাপ ছিল৷ এছাড়াও যে ট্রলারগুলো বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল, সেগুলো মাঝারি আকারের বালু বহনকারী নৌযান৷ এমন একটি নৌযানে সেদিন ১০০র বেশি মানুষ উঠে পড়েছিল, স্থানীয়দের কেউ কেউ মনে করেন ট্রলারে দেড়শো মানুষ ছিল৷ বসার জায়গা না পেয়ে অনেকে দাঁড়িয়েছিল৷
এছাড়াও দেশের অন্য অনেক নদীঘাটের মতো করতোয়ার ঐ ঘাটেও ছিল অনিয়ম, অব্যবস্থা৷ অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে নৌকা চলাচল করলেও দেখার কেউ ছিল না৷
সঠিক কোনো উপাত্ত না থাকলেও ধারনা করা হয়, প্রতিবছর কয়েকশ মানুষ নৌকাডুবিতে মারা যায়৷ এর অন্যতম কারণ হল ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী তোলা, বেপরোয়া চলাচল এবং প্রশাসনের নির্লিপ্ততা৷
একের পর এক এমন ঘটনা ঘটলেও এর প্রতিরোধে সরকার-প্রশাসনের তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যায় না৷ প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন আর মৃতের পরিবারকে কিছু নগদ অর্থ দিয়েই যেন তাদের দায়িত্ব শেষ করতে চায়৷ খাদ্যে ভেজাল বা দুর্ঘটনা কমাতে যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়, নৌকাডুবি রোধে সেরকম তৎপরতা দেখা যায় না৷ ফলে এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে৷
প্রতিটি মানুষের জীবন মূল্যবান৷ তাই প্রশাসনকে দায়িত্বশীল হতে হবে, নদীপথে মানুষের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করতে হবে৷ একই সাথে যাত্রীরাও হবে সচেতন৷ তাদের বুঝতে হবে, ধারনক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নৌকায় উঠলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে৷ তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল বন্ধ করতে হবে৷