ন্যাটোর সম্প্রসারণ এবং ভেটোয় ঠুঁটো-জগন্নাথ জাতিসংঘ
১৮ মার্চ ২০২২ইউক্রেনে ভ্লাদিমির পুটিনের আক্রমণটাইবা কেন ঠেকানো গেল না? প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা একটু জটিল হলেও দ্বিতীয়টার উত্তর খুব সোজা৷ এক কথায় সেটার উত্তর- ভেটো৷
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার যে ব্রত নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ বা জাতিসংঘ, তার ক্ষমতা-কাঠামোর সবচেয়ে বড় দুর্বলতার নাম এই ভেটো৷ কাগজে-কলমে জাতিসংঘের সবচেয়ে শক্তিশালী অঙ্গ সংগঠন নিরাপত্তা পরিষদ৷ বিশ্বজুড়ে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এর কাজ৷ কিন্তু কাজটা যে তারা সব সময় সঠিকভাবে করতে পারছে না, তার অন্যতম কারণ এই ভেটো ক্ষমতা৷ যে কারণে আসলে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশের কোনো একটির ইচ্ছের বাইরে যাওয়ার আসলে কোনো সুযোগ নেই৷ কারণ, এই নিয়মটাই এমন যে, ওই পাঁচটি বৃহৎ রাষ্ট্রের কেউ না চাইলে, বাকি সবাই একমত হলেও নিরাপত্তা পরিষদে কোনো সিদ্ধান্তই নেয়া সম্ভব নয়৷
১৯৪৬ সালে চালু হওয়ার পর থেকে ভেটো প্রয়োগের ইতিহাস খুঁজে দেখলেই এর একটা পরিষ্কার ছবি দেখতে পাওয়া যায়৷ এখন পর্যন্ত এই ক্ষমতার ব্যবহার করা হয়েছে মোট ২৬৩ বার; তার মধ্যে রাশিয়া একাই ১২০ বার ভেটো দিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে, যার সর্বশেষ ঘটনাটি গত ২৫ ফেব্রুয়ারির৷ ইউক্রেনে সেনা অভিযানের নিন্দা এবং অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বানে উত্থাপিত প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে গেছে পুটিন সরকারের ভেটোর কারণে৷ অর্থাৎ, শুধুমাত্র রাশিয়ার আপত্তির মুখে খোদ রাশিয়ারই একটা অন্যায়ের প্রতিবাদটাও করতে পারলো না নিরাপত্তা পরিষদ! যদিও পরে সাধারণ পরিষদে এ নিয়ে একটি নিন্দা প্রস্তাব পাশ হয়েছে বিপুল ভোটে, কিন্তু মনে রাখা দরকার, সাধারণ পরিষদের আসলে বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা নেই৷ তাই বাস্তবে রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকানোর কোনো উদ্যোগও নেয়া সম্ভব হয়নি৷
এমন ঘটনা আসলে নিয়মিতই ঘটে আসছে৷ বিশেষ করে গত কয়েক বছরে সিরিয়া পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের অনেকগুলো উদ্যোগ ভেস্তে গেছে রাশিয়া ও চীনের ভেটোর কারণে৷ অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া সম্ভব হয়নি প্রতিবারই যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়ায়৷
আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বাস্তবতায় ভেটো ক্ষমতার কিছুটা যৌক্তিকতা হয়ত ছিল; বিজয়ী পক্ষ হিসেবে ওই সুবিধাটুকু নিয়েছিল রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, পরে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায় চীন আর যুক্তরাজ্যের প্রস্তাবে ফ্রান্সকেও দেয়া হয় এই ক্ষমতা৷ কিন্তু একুশ শতকের বাস্তবতায় এই ক্ষমতা অব্যাহত রাখার আর তেমন কোনো যৌক্তিকতা নেই৷ বরং জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে এটা৷ আফগানিস্তানে বা ইরাকে মার্কিন সেনা অভিযান ঠেকাতে, ফিলিস্তিনের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ইসরাইলি সেনাদের বর্বরতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বন্ধ করতে কিংবা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিগত সহিংসতা থামাতে গিয়ে জাতিসংঘ যে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি, তার কারণ এই সকল ক্ষেত্রে অভিযুক্ত পক্ষের সঙ্গে কোনো কোনো বৃহৎ শক্তির স্বার্থের সংশ্লিষ্টতা থাকায় তারা একক ক্ষমতায় ঠেকিয়ে দিয়েছে৷
এই ক্ষমতা আছে বলেই পুটিন সাহস করেছেন ইউক্রেন আক্রমণের, কারণ, তিনি জানতেন, অন্তত জাতিসংঘ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারবে না৷
কিন্তু কেউই কি নিতে পারবে না অমন ব্যবস্থা? কার্যত এরকম ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ আছে অন্য একটি সংগঠনের৷ সেটা ন্যাটো৷ নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গ্যানাইজেশন নামে এই সংস্থাটিকে নিয়েও কিন্তু কিছু প্রশ্ন তোলাই যায়৷ ন্যাটো যখন গঠিত হয়েছিল, তখনকার বিশ্ব পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতিতে আকাশ-পাতাল তফাৎ৷ স্নায়ুযুদ্ধের সেই যুগে পূর্ব আর পশ্চিমের দুনিয়া বিভক্ত ছিল দুটি সামরিক শিবিরে৷ তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ন্যাটোর প্রতিদ্বন্দ্বী একটি পক্ষ ছিল, যারা ওয়ারশ' প্যাক্ট নামে আরেকটি সামরিক চুক্তিতে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আলাদা একটি জোট গড়ে তুলেছিল৷ নব্বই দশকের শুরুতে প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তারপর একে একে পূর্ব-ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোয় ভাঙনের সূত্র ধরে অনেক আগেই অকার্যকর হয়ে গেছে ওয়ারশ' জোট৷ কিন্তু ন্যাটো জোট বহাল তবিয়তে টিকে আছে শুধু নয়, নিজেদের এলাকা, মানে আটলান্টিকের উত্তর ছেড়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে সারা ইউরোপে৷ আজকের এই ইউক্রেন সংকটের মূলেও কিন্তু রয়েছে তাদের এই সম্প্রসারণ৷ ভাঙনের আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ন্যাটোর আলোচনা হয়েছিল বলে জানা যায়, যেখানে উল্লেখ ছিল বার্লিনের পূর্ব দিকে তারা আর অগ্রসর হবে না৷ কিন্তু সে কথা তারা রাখেনি৷ রাশিয়ানদের যুক্তি, তাদের প্রতিবেশী দেশগুলোকে এই চুক্তির অংশীদার করে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে এসে তাদের নাকের ডগায় সামরিক ঘাঁটি তৈরি করছে ন্যাটো, যা তাদের দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ৷ ইউক্রেনে ন্যাটোর ঘাঁটি তৈরি নিয়েই তাদের যত আপত্তি, এবং এই আপত্তির কথা তারা অনেক দিন ধরেই বলে আসছে৷ সেই আপত্তি একেবারে উড়িয়ে দেয়ারও কোনো সুযোগ নেই, কারণ, দৃশ্যত ন্যাটো জোটের এই এলাকায় সামরিক উপস্থিতির পেছনে আসলেই প্রত্যক্ষ কোনো কারণ নেই৷ যে চুক্তি হয়েছিল আটলান্টিক তীরবর্তী দেশগুলোকে সম্ভাব্য শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার প্রস্তুতিতে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে, স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে তো আসলে সেই চুক্তির প্রয়োজনীয়তা দৃশ্যত নেই, কারণ এখন আর ‘প্রতিপক্ষ' কোনো জোটেরই অস্তিত্ব নেই৷ তাহলে কেন ন্যাটোর এই সম্প্রসারণ?
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে সমর্থন করার কোনো সুযোগ নেই, কিন্তু এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই, রাশিয়াকে এই আক্রমণে যাওয়ার অজুহাত তৈরি করে দিয়েছে কৃষ্ণসাগর তীরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন এই জোটের সামরিক উপস্থিতিই!
শুধু ইউক্রেন সংকটই নয়, আসলে এরকম আরো অনেক সংকটেরই হয়ত জন্ম দেবে ন্যাটোর সম্প্রসারণ৷ আর তেমনটা হলে যদি বিশ্ব শান্তি হুমকির মুখে দাঁড়ায়, তখন সেটা ঠেকানোর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সকল সদস্যের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই৷ যতদিন ভেটো নামের বিশেষ অধিকার ভোগ করবে রাশিয়ার মতো উচ্চাভিলাষী বৃহৎ শক্তি, ততদিন জাতিসংঘ ঠুঁটো-জগন্নাথ হয়েই থাকবে৷