ন্যাটোর সদস্যপদ পেতে চায় ইউক্রেন, ট্রাম্প কি রাজি?
৪ ডিসেম্বর ২০২৪
ইউক্রেনের দাবি, যে এলাকাগুলি রাশিয়ার দখলে নয়, কেবল সেই এলাকাগুলিকে ধরে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া হোক। বাস্তবে তা সম্ভব।
বিজ্ঞাপন
ন্যাটোর সংবিধানের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একটি সদস্য দেশ আক্রান্ত হলে অন্য সদস্য দেশগুলির কাছ থেকে সাহায্য আশা করতে পারে। একইভাবে অন্য দেশগুলির কাছ থেকে অস্ত্র সাহায্যও প্রত্যাশা করতে পারে দেশটি। তবে কীভাবে এবং কতটা সাহায্য করা হবে, তা নির্ণয় করার ক্ষমতা থাকবে সাহায্যকারী দেশটির হাতে।
আর ঠিক এই সুবিধাটিই খাতায় কলমে পেতে চাইছে ইউক্রেন। রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হওয়ার পর অ্যামেরিকা-সহ একাধিক পশ্চিমা দেশের কাছ থেকে সাহায্য পাচ্ছে ইউক্রেন। কিন্তু ন্যাটোর সদস্য হলে সাহায্যের গ্যারান্টি পাওয়া সম্ভব। এবার সেই রাস্তায় হাঁটতে চায় ইউক্রেন। ইতিমধ্যেই এবিষয়ে তাদের দাবি জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
প্রশ্ন হলো, ইউক্রেনের এই দাবি কি ন্যাটোর সদস্য দেশগুলি মেনে নেবে? ন্যাটোর সদস্যপদ পেতে হলে ৩২ টি দেশেরই সম্মতি প্রয়োজন।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর ন্যাটো
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর ৩২টি পশ্চিমা রাষ্ট্রের সামরিক জোট ন্যাটোর অবস্থান নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন, আবার ফিরে আসছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের পরিস্থিতি।
ছবি: Gints Ivuskans/Getty Images/AFP
ন্যাটোয় ঢুকবে ইউক্রেন?
ন্যাটোতে ইউক্রেনের সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা চলছে বেশ কয়েকবছর ধরেই। কিন্তু দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্যপদের জন্য আবেদন করে রাশিয়ার আক্রমণের পর, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। ইউক্রেনের প্রতি ন্যাটোভুক্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও সদস্যপদ প্রাপ্তি এখনও অনেক দূরের পথ। অনেক দেশই মনে করে এমন পদক্ষেপ রাশিয়াকে আরো উসকে দিতে পারে। তাছাড়া দেশটির বিভিন্ন নীতি এখনও ন্যাটোর মানে পৌঁছায়নি বলেও মনে করে অনেক দেশ।
ছবি: Artur Widak/NurPhoto/picture alliance
ন্যাটোর নতুন সদস্য
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর দীর্ঘদিন ধরে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলা দুই স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটোয় যোগ দিয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সবচেয়ে দীর্ঘ সীমান্ত ফিনল্যান্ডের। সোভিয়েত ইউনিয়নের ফিনল্যান্ড আগ্রাসনের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে, এমন ক্রমবর্ধমান আশঙ্কা থেকেই মূলত নিরপেক্ষতা নীতি ভেঙে ২০২৩ সালের এপ্রিলে ন্যাটোতে যোগ দেয় দেশটি। সুইডেন জোটে যোগ দেয় ২০২৪ সালের মার্চে।
ছবি: Pond5 Images/IMAGO
পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর উপস্থিতি
রাশিয়ার সম্ভাব্য আগ্রাসনের আশঙ্কায় রয়েছে পূর্ব ইউরোপের নানা দেশ। পূর্ব ইউরোপের আটটি দেশে ন্যাটোর উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। ন্যাটো জানিয়েছে, এর মাধ্যমে জোটটি আবারও স্পষ্ট করছে, 'জোটের এক সদস্যের ওপর আক্রমণের মানে সবাইকে আক্রমণ'। পূর্ব ইউরোপের যেসব দেশে ন্যাটোর সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে সেগুলো হচ্ছে বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং লাটভিয়া।
ছবি: U.S. Army/Zuma/imago images
বাল্টিকে সবচেয়ে বড় মহড়া
বাল্টিক সাগর এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে ১৯৭১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সামরিক মহড়া করে আসছে ন্যাটো। এই মহড়াকে সংক্ষেপে বলা হয় বাল্টোপস। ২০২৪ সালের ৭ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বাল্টোপসের ৫৩তম সংস্করণ ন্যাটোর ইতিহাসে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া। ২০টি দেশ থেকে আসা নয় হাজার সৈন্য অংশ নেন এতে। ৩০টি যুদ্ধজাহাজ ছাড়াও স্থল ও আকাশপথেও মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ছবি: Getty Images/AFP/P. Malukas
নড়বড়ে মার্কিন অবস্থান
২০১৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ডনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন সময়ে ইউরোপে ন্যাটোর সহযোগীদের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। ন্যাটোর চুক্তি অনুসারে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের জিডিপির দুই শতাংশ ন্যাটোর প্রতিরক্ষা বাজেট হিসাবে দেয়ার কথা। বেশিরভাগ দেশই তা না করায় যুক্তরাষ্ট্রকেই জোটের প্রতিরক্ষা বাজেটের বড় অংশ বহন করতে হয়। এ নিয়ে সমালোচনা করায় জোটের অংশীদারদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল।
ছবি: Nicholas Kamm/AFP
ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা
নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবার জিততে পারেন ডনাল্ড ট্রাম্প। ন্যাটোর সদস্যদের নিয়ে তার সাম্প্রতিক মন্তব্য ভাবিয়ে তুলেছে অনেককে। ফেব্রুয়ারিতে প্রচারণায় তিনি বলেছেন, কোনো দেশ বাজেট বরাদ্দ না করলে তাদের আক্রমণে তিনি রাশিয়াকে 'উৎসাহিত' করবেন। এই মন্তব্যকে 'ভয়াবহ এবং অনাকাঙ্খিত' বলে নিন্দা জানিয়েছে হোয়াইট হাউজ। এসব মন্তব্যে 'ন্যাটোর সদস্যরা ঝুঁকিতে পড়ছে' বলে মন্তব্য করেছেন ইয়েন্স স্টোলটেনবার্গ।
ছবি: picture-alliance/dpa/E. Vucci
শীর্ষে সম্ভাব্য পরিবর্তন
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলনে জোটের নতুন প্রধান নিয়োগ দেয়া হতে পারে। বর্তমান প্রধান নরওয়ের ইয়েন্স স্টোলটেনবার্গের মেয়াদ বেশ কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে। তবে এবার সে পদে বিদায়ী ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটে বেশ এগিয়ে রয়েছেন। হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, রোমানিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ তাকে সরাসরি সমর্থনও জানিয়েছে। ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নানা বিষয়ে সহজে বোঝাপড়ার করার ইতিহাস রয়েছে তার।
ছবি: NATO
ইউরোপিয়ান সেনাবাহিনী
ট্রাম্পের আগের মেয়াদে ন্যাটোর সদস্যদের মধ্যে ইউরোপের নিরাপত্তা বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব সংকটে পড়েছিল। এরপরই ইউরোপের রাজনীতিতে জোরেসোরে উচ্চারিত হতে থাকে ন্যাটোর বিকল্প একটি ইউরোপীয় সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তাব। এই প্রস্তাবের মূলে ছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ। তবে এখনও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরা এ নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনায় পৌঁছাতে পারেননি।
ছবি: FABRICE COFFRINI/AFP
8 ছবি1 | 8
ইউক্রেনের দাবি
জেলেনস্কি বলেছেন, রাশিয়া ইউক্রেনের যে অংশগুলি দখল করে রেখেছে, বিশেষ করে ক্রাইমিয়া-- সেই এলাকাগুলিকে ন্যাটো থেকে বাদ দেওয়া হবে। কেবলমাত্র স্বাধীন ইউক্রেনের অংশকেই ন্যাটোর অংশ করা হোক। বাস্তবে কি তা সম্ভব? বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সম্ভব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ন্যাটো তৈরি হয়, তখন জার্মানি দুই ভাগে বিভক্ত। কেবলমাত্র পশ্চিম জার্মানিকেই ন্যাটোর অংশ করা হয়েছিল। পূর্ব জার্মানি ছিল সোভিয়েত অ্যালায়েন্সের অংশ। এখানেই শেষ নয়, দক্ষিণ প্রশান্ত সাগরে যুক্তরাজ্যের বেশ কিছু দ্বীপ আছে, ক্যারিবিয়ান আইসল্যান্ডে বেশ কিছু অঞ্চল ফ্রান্সের দখলে, কিন্তু ওই এলাকাগুলি ন্যাটোর আওতাভুক্ত নয়। কেবলমাত্র ফ্রান্সের এবং যুক্তরাজ্যের মূল ভূখণ্ড ন্যাটোর অংশ। ফলে জেলেনস্কি যে ২৭ শতাংশ জমি ছেড়ে ইউক্রেনকে ন্যাটোর অংশ করার দাবি তুলেছেন, তা বাস্তবে অসম্ভব নয়।
রিজার্ভ সৈন্য বাড়ানোর রূপরেখা প্রকাশ করেছে জার্মানি
02:45
যারা মানতে নারাজ
প্রশ্ন হলো পশ্চিমা দেশগুলি এবং অ্যামেরিকা কি ইউক্রেনকে এখনই সদস্য করতে আগ্রহী। ইউক্রেন সফরে গেছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলফ শলৎস। তিনি সরাসরি এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। জার্মানির বক্তব্য, এই সময়ে দাঁড়িয়ে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ দিলে বাকি ৩২টি দেশও সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়বে। এই মুহূর্তে তা কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না। তবে ন্যাটোর সাবেক প্রধান জেনস স্টলটেনবার্গ মনে করেন, ইউক্রেনকে সদস্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতেই পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হলে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাওয়া সম্ভব।
ট্রাম্প কী চান
অ্যামেরিকার আগামী প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প কী চান, তা সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এবিষয়ে ট্রাম্প এখনো পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেনননি। তবে নির্বাচনি জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন। কোন প্রক্রিয়ায় তা সম্ভব হবে, সে কথা তিনি বলেননি।
ইউক্রেনযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে জো বাইডেন প্রশাসন লাগাতার ইউক্রেনকে সাহায্য করে গেছে। ট্রাম্পও কি একইভাবে সাহায্য চালিয়ে যাবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ন্যাটোর বর্তমান প্রধান অবশ্য বলেছেন, শান্তি আলোচনার সময় এটা নয়। রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি স্থাপন কীভাবে সম্ভব, সে কথা না ভেবে এখন উচিত ইউক্রেন।