ঢাকার সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের সামনে থেকে অপসারণ করা ন্যায়বিচারের ভাস্কর্যটি সুপ্রিম কোর্টেরই বর্ধিত ভবন অ্যানেক্স ভবনের সামনে স্থাপন করা হয়েছে৷ শনিবার রাতে ভাস্কর্যটি আবারো দাঁড়িয়ে যাওয়ায় নাখোশ হেফাজতে ইসলাম৷
বিজ্ঞাপন
গত বছরের শেষের দিকে সুপ্রিম কোর্টের সামনে ন্যায়বিচারের প্রতীক ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হলে তার বিরোধিতা শুরু করে হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ইসলামপন্থি সংগঠন৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাদের সেই বিরোধিতাকে কার্যত সমর্থন করে ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার পক্ষে মতামত দেন৷ ইসলামপন্থি গোষ্ঠীগুলো ভাস্কর্যটিকে ‘গ্রিকদেবীর মূর্তি’ হিসেবে বিবেচনা করে এটিকে ‘অনৈসলামিক’ আখ্যা দেয়, যদিও ভাস্কর মৃণাল হক জানান যে, একহাতে তলোয়ার ও অন্যহাতে দাড়িপাল্লা ধরা শাড়ি পরা ভাস্কর্যটি তিনি বাঙালি নারীর আদলে তৈরি করেছেন৷
ভাস্কর্যটি নিয়ে নানা আলোচনার মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে এটি হঠাৎ করে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলা হয়৷ ভাস্কর্য সরানোর তীব্র প্রতিবাদ করেন বাংলাদেশের মুক্তমনা এবং ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীগুলো৷ সুশীল সমাজের একাংশ ইসলামপন্থিদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করা হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করেন৷ তাঁরা আরো দাবি করেন যে, হাসিনা সরকার আগামী বছরের নির্বাচনে ইসলামপন্থিদের ভোট পেতে এটা করেছে৷
রাতের আঁধারে সরানো হলো ভাস্কর্য
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে স্থাপিত ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে৷ ভাস্কর্যটি সরানোর প্রতিবাদে ঢাকায় বিক্ষোভ করেছেন একদল প্রতিবাদকারী৷
ছবি: bdnews24.com
ন্যায়বিচারের প্রতীক
রোমান যুগের ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘লেডি জাস্টিসের’ আদলে তৈরি এক হাতে তলোয়ার ও অন্য হাতে দাঁড়িপাল্লা ধরা ভাস্কর্যটি ঢাকার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয় গতবছরের শেষের দিকে৷ এরপর হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ইসলামি সংগঠন ভাস্কর্যটিকে ‘অনৈসলামিক’ আখ্যা দিয়ে সেটিকে সরিয়ে ফেলার দাবি তোলে৷
ছবি: bdnews24.com
গ্রিক দেবী, নাকি বাঙালি নারী?
ইসলামপন্থি নেতারা এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভাস্কর্যটিকে গ্রিক দেবীর বলে জানালেও ভাস্কর মৃণাল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন যে, ‘‘গ্রিক দেবী ঠিক নয়, বলাও ঠিক হবে না৷ এটা গ্রিক ভাস্কর্য নয়, একটা বাঙালি মেয়ে, শাড়ি-ব্লাউজ পরা৷ গ্রিক হলে সেখানে অন্য পোশাক থাকতো৷ ভুল জিনিস মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়৷’’
ছবি: bdnews24.com
রাতের বেলা অপসারণ
ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলা নিয়ে আলোচনার মাঝেই বৃহস্পতিবার হঠাৎ সেটিকে সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ নেয়া হয়৷ রাত সাড়ে এগারোটা থেকে ভোর চারটার মধ্যে সেটিকে সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে নামিয়ে ফেলা হয়৷ এ সময় সংশ্লিষ্ট এলাকায় বাতির সংখ্যা কমিয়ে অনেকটা রাতের আঁধারে মুর্তি সরানোর কাজ পরিচালনা করা হয়৷
ছবি: bdnews24.com
নতুন ঠিকানা অ্যানেক্স ভবন?
ন্যায়বিচারের প্রতীক ভাস্কর্যটি সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে সরিয়ে হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে প্রতিস্থাপনের কথা শোনা যাচ্ছিল৷ তবে সেটা প্রতিস্থাপনের বদলে শুক্রবার ভোর রাত পাঁচটার দিকে একটি পিকআপ ভ্যানে করে নিয়ে অ্যানেক্স ভবনের ভেতর পানির পাম্পের পাশে ফেলে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম৷
ছবি: bdnews24.com
প্রতিবাদ, বিক্ষোভ
এদিকে, বৃহস্পিতবার রাতে ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার খবর প্রকাশের পরপরই সুপ্রিমকোর্টের সামনে জড়ো হন কয়েকশ’ প্রতিবাদকারী৷ মূলত বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা ‘আপোশ, না রাজপথ?-রাজপথ, রাজপথ’, ‘হেফাজতের আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘মৌলবাদের আস্তানা, ভেঙে দাও জ্বালিয়ে দাও’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে ভাস্কর্য অপসারণ ঠেকানোর চেষ্টা করেন৷
ছবি: bdnews24.com
বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও পুলিশ
শুক্রবার ঢাকায় প্রতিবাদকারীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ৷ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদুনে গ্যাস, জলকামান এবং রাবার বুলেট ব্যবহার করা হয়৷ কয়েকজন প্রতিবাদকারীকে পুলিশ আটক করেছে বলেও জানা গেছে৷
ছবি: bdnews24.com
ভাস্কর্য পুনঃস্থাপনের দাবি
ন্যায়বিচারের প্রতীক ভাস্কর্যটি পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রতিবাদকারীরা৷ শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের তরফ থেকেও প্রতিবাদ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
7 ছবি1 | 7
অন্যদিকে, হেফাজতে ইসলাম ‘মূর্তি’ সরিয়ে ফেলায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান, যদিও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দাবি করেন যে, সরকার নয়, বরং সুপ্রিম কোর্টই এটি সরিয়ে ফেলেছে৷ তবে হেফাজতের আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি, কেননা, শনিবার রাতে ভাস্কর্যটি সুপ্রিম কোর্টেরই আরেকাংশ অ্যানেক্স ভবনের সামনে স্থাপন করা হয়েছে৷ এই পুনঃস্থাপনে নাখোশ হয়ে হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী বলেছেন যে, ‘‘জাতির ধর্মীয় বিশ্বাস ও আবেগের সাথে তামাশা’ করা হয়েছে৷ তিনি আরো বলেন, ‘‘ভাস্কর্য অপসারণ নিয়ে ‘মধ্যপন্থার’ কোনো সুযোগ নেই, বরং এটিকে চিরতরে দেশ থেকে অপসারণ করতে হবে৷’’ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে একথা বলেন তিনি৷
এদিকে, ভাস্কর্য পুনঃস্থাপনের বিষয়ে জানতে চাইলে মৃণাল হক জানিয়েছেন, তাঁকে ভাস্কর্যটি সরাতে বলা হয়েছে৷ ‘‘এখন সেটিকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিসীমার বাইরে সুপ্রিম কোর্টের পেছনে স্থাপন করা হয়েছে,’’ বলেন তিনি৷
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ হলেও গত কয়েকবছর ধরে উগ্রপন্থি ইসলামিস্টদের প্রভাব বাড়ছে৷ গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন ব্লগার, বিদেশি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ উগপ্রন্থিদের হাতে নিহত হয়েছেন৷ আল-কায়দা এবং ‘ইসলামিক স্টেটের’ মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশে নিজেদের অবস্থান বাড়ানোর কথা বলেছে, যদিও সরকার মনে করে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর কোনো অস্তিত্ব সে দেশে নেই৷
এআই/এসিবি (এএফপি, ডিপিএ)
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...