শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অবশেষে টনক নড়েছে সরকার ও পরিবহণ মালিকদের৷ সড়কের পরিস্থিতি উন্নয়নে নানা উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে৷ তার একটি, ঢাকায় বৃহস্পতিবার থেকেই মজুরির ভিত্তিতে বাস চালাবেন চালক-হেলপাররা৷
বিজ্ঞাপন
বুধবার মালিকপক্ষের এক বৈঠকের পর এ সিদ্ধান্তের কথা সাংবাদিকদের জানানো হয়৷ মতিঝিলে মালিক সমিতির কার্যালয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘‘চালকরা বাস চালিয়ে সারাদিনের আয় মালিকের হাতে তুলে দেবেন৷ আর মালিক তাঁর বাসের চালক-শ্রমিকদের নির্ধারিত হারে মজুরি দেবেন৷''
স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার থেকেই এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার কথা জানান পরিবহণ মালিকরা৷ যেসব পরিবহণ এই সিদ্ধান্ত মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানান তাঁরা৷
এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘‘কালকের পর কেউ চুক্তিতে গাড়ি চালালে আমরা তাদের নিবন্ধন বাতিলের জন্য সুপারিশ করব৷ আর সে মালিক যদি আমাদের সদস্য হয়, তাহলে ওই মালিককে আমাদের সমিতি থেকে বহিষ্কার করা হবে৷''
কী থাকছে নতুন সড়ক পরিবহণ আইনে?
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহাণির ঘটনায় সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রেখে বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শিক্ষাগত যোগ্যতা
আগের আইনে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না৷ নতুন আইনের খসড়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য চালকের কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি পাসের শর্ত রাখা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Abdullah
সহকারী হতেও শিক্ষাগত যোগ্যতা
আগের অধ্যাদেশে সহকারীদের লাইসেন্সের কথা থাকলেও তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত ছিল না৷ নতুন আইনে চালকের সহকারীরও থাকতে হবে পঞ্চম শ্রেণি পাসের সার্টিফকেট৷ সহকারী হতে বাধ্যতামূলকভাবে লাইসেন্সের বিধান তো থাকছেই৷
ছবি: bdnews24.com
ন্যূনতম বয়স
ব্যক্তিগত গাড়ি চালনার জন্য চালকের বয়স আগের মতই অন্তত ১৮ বছর রাখা হয়েছে৷ তবে পেশাদার চালকদের বয়স হতে হবে কমপক্ষে ২১ বছর৷
ছবি: DW
বাড়ছে সাজা
নতুন আইনের খসড়ায় চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে অনধিক ছ’মাসের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে৷ আগের আইনে এই অপরাধের জন্য তিন মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান ছিল৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
সাজা হবে সহকারীরও
চালকের সহকারীর লাইসেন্স না থাকলে এক মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে নতুন আইনের খসড়ায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
নিষিদ্ধ মোবাইল ফোন
নতুন আইন পাস হলে গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না চালক৷ এ আইন ভাঙলে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার
ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে- এমন অপরাধের ক্ষেত্রে চালককে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে পুলিশকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিধি অমান্যে পয়েন্ট কাটা
প্রস্তাবিত আইনে লাইসেন্সে থাকবে মোট ১২ পয়েন্ট৷ বিভিন্ন বিধি অমান্যে কাটা যাবে এই পয়েন্ট৷ পয়েন্ট শূন্য হলে বাতিল হবে চালকের লাইসেন্স৷
ছবি: DW/M. Mamun
দুর্ঘটনার সাজা দণ্ডবিধিতে
পেনাল কোডে যা কিছু থাকুক না কেন অবহেলাজনিত কারণে গুরুতরভাবে আহত বা প্রাণহানি হলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে৷ তদন্তে দুর্ঘটনা যদি উদ্দেশ্যমূলক হিসেবে প্রমাণিত হয় তাহলে তা দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় (নরহত্যা, সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড) যাবে৷ আর চালকের কারণে প্রাণহানি হয়ে থাকলে ৩০৪ (বি) ধারা অনুযায়ী সাজা দেওয়া হবে৷ তদন্ত কর্মকর্তাই ঠিক করবেন- অপরাধ কোন ধারায় যাবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
এনায়েত উল্লাহ'র এনা পরিবহণের চালকদের বিরুদ্ধেও বেপরোয়া চালনার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে৷ এই সিদ্ধান্ত কতটা কাজে আসবে বা কতটা বাস্তবায়ন করা যাবে এমন প্রশ্নে জবাবে মালিকপক্ষ বলেন, অটোরিক্সার মতো দৈনিক চুক্তির ভিত্তিতে চালকের হাতে বাস দিলে তাদের নির্দিষ্ট অংকের অর্থ মালিকের হাতে দিনশেষে তুলে দিতেই হয়৷ তাই বেশি ট্রিপ মারতে তারা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান৷ এটি সড়কে দুর্ঘটনার একটি অন্যতম কারণ৷
‘‘প্রতিটি রাস্তায় কোম্পানির চেকার থাকবে৷ তাছাড়া মালিক সমিতি কৌশল ব্যবহার করবে৷'' বলেন এনায়েত উল্লাহ৷
ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর এ বিষয়ে কথা বলেছে কয়েকজন বাসচালকের সঙ্গে৷ তাদের প্রতিবেদনে দেখা যায়, কয়েকটি পরিবহণ মজুরির ভিত্তিতে বাস চালালেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দৈনিক জমার পদ্ধতি চলে আসছিল এতদিন৷
ওয়েলকাম পরিবহণের এক চালক বিডিনিউজকে জানান, তাদের পরিবহণের বাস মজুরির ভিত্তিতে চলে৷ প্রতি ট্রিপের জন্য তিনি পান সাড়ে তিনশ টাকা৷ আবার মোহাম্মদপুর-মতিঝিল রুটের আরেকটি বাসের বাসচালক জানান, চুক্তিতে মালিককে দৈনিক আড়াই হাজার টাকা জমা দিতে হয়৷
এদিকে, সংবাদ সম্মেলনে মালিকপক্ষ আরো জানান যে, রাজধানীতে বাস চলাচলে আবার ‘কাউন্টার সার্ভিস' চালু করা হবে৷ কাউন্টারের জায়গা চেয়ে সিটি কর্পোরেশনে চিঠি পাঠানো হবে৷
এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘‘কাল থেকে রাজধানীর সড়কে কোনো ফিটনেসবিহীন বাস চলতে দেয়া হবে না৷ এজন্য সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে৷ টার্মিনাল থেকে বাস ছেড়ে যাওয়ার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে৷''
পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজটি করতে প্রতিটি টার্মিনালে মালিক ও শ্রমিক পক্ষের নেতাদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হবে৷ ওই কমিটি বাস ছাড়ার আগে চালকের লাইসেন্স, গাড়ির কাগজপত্র এবং গাড়িটি চলাচলের উপযোগী কিনা তা দেখবে৷ যদি কোনো গলদ থাকে, তাহলে সেই বাস চলতে দেয়া হবে না৷
ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের ভাইরাল স্লোগান
এই দাবিতে বাংলাদেশের সড়ক এখন ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের দখলে৷ কীভাবে ট্রাফিক কন্ট্রোল করা যায়, কিভাবে চাইলেই ‘আইন সবার জন্য সমান’ প্রমাণ করা যায়, হাতেকলমে শেখাচ্ছে শিশুরা৷ দেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব এ আন্দোলনে আছে নতুন স্লোগানও৷
ছবি: Facebook/H. Torikul
‘বিচার চাই’
সড়কে বেপরোয়া গাড়ি চালনার প্রতিবাদে সড়কের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে খোদ শিক্ষার্থীরাই৷ তাঁদের লাইসেন্স পরীক্ষা কার্যক্রম থেকে রেহাই পাচ্ছে না সাংবাদিক, পুলিশ এমনকি মন্ত্রীর গাড়িও৷
ছবি: Facebook/H. Torikul
‘ঠিক করুন বিচারব্যবস্থা’
দিনের পর দিন চলছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি৷ লাইসেন্স ছাড়াই সড়কে দেদারসে চলছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি৷ ইন্টারনেটের স্পিড বাড়ছে, কিন্তু তার চেয়েও দ্রুত বাড়ছে বেপরোয়া গাড়ির গতি৷ শিশুদের মুখে তাই বিচারের গতিও বাড়ানোর আহ্বান৷
ছবি: Facebook/D. Shawon
‘নিরাপদ জীবন চাই’
পোস্টার হাতে সড়কে অবস্থান নিয়েছে ২০১২ সালে নিহত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনির একমাত্র ছেলে মাহির সারোয়ার মেঘও৷ সড়কে নিহতদের বিচারের পাশাপাশি নিজের বাবা-মায়ের হত্যাকাণ্ডের বিচারও চায় মেঘ৷
ছবি: Facebook
‘সোহাগের বদলে শাসন!’
কথায় আছে, ‘শাসন করা তারেই সাজে, সোহাগ করে যে’৷ সবাইকে সে কথাটাই মনে করিয়ে দিচ্ছে শিশুটি৷ শিশুদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে কার্যকর উদ্যোগ না নিলেও বিক্ষোভকারীদের ওপর লাঠিচার্জ ঠিকই করেছে পুলিশ৷ এই কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে শিশুটি৷
ছবি: Facebook/A. Rahee
‘ডিজিটালের আগে নিরাপত্তা’
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার৷ বিভিন্ন কার্যক্রমে এসেছে সাফল্যও৷ কিন্তু জীবনের নিরাপত্তাই যদি না থাকে, তাহলে সে সুফল উপভোগ করবে কে? এই ক্ষুদে শিক্ষার্থীর মনে এটিই আজকের মূল প্রশ্ন৷
ছবি: Facebook
‘ক্ষমা চেয়ে লাভ কি!’
দুর্ঘটনা ঘটলেই গৎবাঁধা বুলি৷ ‘আমরা দেখছি’, ‘বিচার হবে’, ‘ক্ষমা চাই’৷ কিন্তু তাতে কী অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটছে? বছরের পর বছর ধরে একি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে৷ ছাত্রদের দাবি, ‘ক্ষমা চেয়ে কি হবে? ভাঙা গাড়ি সরবে কবে?’৷
ছবি: Facebook/R. Romio
6 ছবি1 | 6
এছাড়া, পুরোনো রংচটা, লক্কড়ঝক্কড় বাস মেরামতের জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে বলে জানায় মালিকপক্ষ৷
উল্লেখ্য, গত ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়৷ আরো কয়েকজন গুরুতর আহত হন৷ এতে ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে৷ রাজধানী থেকে তাদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে৷
শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতেরাস্তায় নেমে সব গাড়ির চালকের লাইসেন্স, গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করা শুরু করলে অনেক সরকারি ও দায়িত্বশীল পর্যায়ের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গাড়ির কাগজপত্রেও অনিয়ম পাওয়া যায়৷