নারী মুক্তিযোদ্ধা
১৮ জুলাই ২০১২১৯৪৫ সালের ২০শে ডিসেম্বর বরিশালের গৌরনদী থানায় জন্ম রমা দাসের৷ বাবা নগেন্দ্রনাথ দাস এবং মা অঞ্জলী দাস৷ ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় মাস্টার্স পড়ছিলেন রমা দাস৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই তাঁর লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়৷ ফলে প্রায় প্রতিদিনই কলাভবন, কার্জন হল, শহীদ মিনার চত্বরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন চত্বরের মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতেন তিনি৷ ফেব্রুয়ারি ও মাচের্র দিনগুলোতে তাঁরা দলবেঁধে বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিতেন৷ এছাড়া পোস্টার, ব্যানার ও দেয়াল লিখনে অংশ নিতেন৷
ডিডাব্লিউ এর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে রমা দাস জানান, ‘‘আমার বাবা সেসময় ডাকবিভাগে ঝালকাঠি সদরে কর্মরত ছিলেন৷ আমাদের মৌখিক পরীক্ষার তারিখ পাল্টে যায়৷ ফলে আমি ২১শে মার্চ ঝালকাঠি চলে আসি৷ কিন্তু কিছুদিন পরই ঝালকাঠিতে হামলা চালায় পাক হানাদার বাহিনী৷ ঝালকাঠিতে প্রায় সর্বত্রই আগুন ধরিয়ে দেয় তারা৷ তখন আমরা আশ্রয়ের জন্য কামারকাঠি গ্রামের মামার বাড়ি চলে যায়৷ এরপর কয়েক মাস ধরে এখান থেকে ওখানে পালিয়ে বেড়াতে হয়৷ কিন্তু পাশাপাশি পেয়ারাবাগানে ক্যাপ্টেন বেগ এর নেতৃত্বে মাদ্রা প্রশিক্ষণ শিবিরে আমরা অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি৷ এরপর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে আমি ভারত চলে যাই৷ পেয়ারাবাগান থেকে বাগদা সীমান্তে পৌঁছতে আমাদের সাত দিন সময় লাগে৷ ভারত গিয়ে প্রথমে টালিগঞ্জে মামার বাড়িতে উঠি৷ এসময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানগুলো শুনে আমিও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হই৷ এদিকে, যুদ্ধ শুরুর কয়েকদিন আগে আমার স্বামীর সাথে বিয়ের জন্য পারিবারিকভাবে আশীর্বাদের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছিল৷ আমি খবর পাই যে, তিনি ৯ নম্বর সেক্টরের অধীন বশিরহাটের হাসনাবাদের অন্তর্গত টাকি ক্যাম্পে রয়েছেন৷ তখন আমি আমার ছোট ভাইকে নিয়ে টাকি ক্যাম্পে চলে যাই৷ সেখানে গিয়ে ক্যাপ্টেন বেগ এবং পরে সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের সাথে দেখা করি৷ মেজর জলিল আমাকে ঐ সেক্টরের মহিলা মুক্তিবাহিনীর প্রধান করে দিলেন৷ তখন আমাদের একটি দোতলা ভবনের উপরে বিশেষ জায়গা দেয়া হলো৷ আমরা সেখানে ৪০ থেকে ৪৫ জন মেয়ে নিয়ে নারীদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে তুলি৷ সেখানে যশোর সেনানিবাসে কর্মরত সুবেদার মেজর মাজেদ এসে আমাদের প্রশিক্ষণ দিতেন৷ সেখানে আমরা অস্ত্র চালনা এবং বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছি৷ আমরা ঐ শিবির থেকে খুলনা, সাতক্ষীরার আশাশুনি, কালিগঞ্জ, ভোমরা, দেবহাটাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে গোয়েন্দাগিরি করতে যেতাম৷ একদিন তো আমরা প্রায় ধরা পড়েই গিয়েছিলাম৷ বহুকষ্টে আত্মগোপন করে পালিয়ে এসেছিলাম৷''
এছাড়া দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে আত্মনিয়োগ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে কথিকা পাঠ করতেন রমা দাস৷ এরপর দেশ স্বাধীন হলেও খুলনায় মেজর জলিলের নেতৃত্বে গঠিত শিবিরে থেকে বিভিন্ন কাজ করেছেন তিনি৷ সেখানে প্রায় দেড়মাস অবস্থান করে মুক্তিবাহিনীতে থাকা মেয়েদের আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ করে তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন৷ শেষ পর্যন্ত দু'টি মেয়েকে সাথে করে ঝালকাঠিতে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান৷ এমনকি তাদের একজনের পিতামাতা কিংবা স্বজনদের খোঁজ না পাওয়ায় প্রায় এক বছর নিজ বাড়িতে রেখেছিলেন৷ পরে তাঁকে সেলাই মেশিন কিনে দিয়ে কাজ শিখিয়ে আত্মনির্ভরশীল করেছেন রমা দাস৷
যুদ্ধ শেষ হলে কালিঘাটে কোন উৎসব ছাড়াই মালাবদল করে মন্ত্র পড়ে অধ্যাপক পার্থ শারথি দাসের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন রমা৷ কিন্তু বিয়ের পরেও তাঁর কাঁধে থাকা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেননি তিনি৷ দেশে ফিরে দেখেন তাঁদের ঘর-বাড়ি সবকিছুই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে৷ ঝালকাঠিতে ফিরে তিনি তাঁর আগের কর্মস্থল হরচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন৷ ২০০৩ সালে শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নিয়েছেন রমা দাস৷ তবে পেশাগত দায়িত্ব থেকে মুক্ত হলেও সমাজসেবামূলক কাজের মধ্যে এখনও ডুবে থাকেন তিনি৷ সম্প্রতি আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে ঝালকাঠির পাঁচ নারী মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়৷ সেখানে রমা দাসও জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে সম্মাননা পদক গ্রহণ করেন৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: জাহিদুল হক