সারা বছর প্রায় সব খাবার পাওয়া যায়৷ ফলে কমছে আকর্ষণ, বাড়ছে তাচ্ছিল্য৷ বর্তমান এই খাদ্য সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে অস্ট্রিয়ার এক ফটোগ্রাফার এমন এক পথ বেছে নিয়েছেন, যার পরিচয় পেলে খাবার হজম করা কঠিন হতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
ছিল খাদ্য, এখন অবশ্য আর খাবার যোগ্য নয়৷ এমন ছবি দেখলে কিছু মানুষের গা গুলিয়ে উঠবে৷ বাকিদের কাছে এর সৌন্দর্য কম নয়৷ কারো আবার দুটোই মনে হতে পারে৷ অস্ট্রিয়ার ফটোগ্রাফার ক্লাউস পিশলার-এর ছবি এমনই বিরক্তিকর৷ তিনি বলেন, ‘‘লুকানো বস্তু আমাকে আকর্ষণ করে৷ যা আমাদের চোখের আড়ালে থাকে ফটোগ্রাফার হিসেবে তাই আমাকে প্রেরণা দেয়৷ মানুষ এ সব দূরে সরিয়ে রাখে অথবা প্রতিদিন দেখেও দেখে না৷''
ক্লাউস পিশলার অবশ্য আবর্জনার স্তূপ খোঁজেন না, তিনি অন্য ধরনের ছবি তোলেন৷ যেমন ছবির মতো সুন্দর বাসি তরমুজ৷ অথবা পচতে থাকা সালাদ যেন তুলি দিয়ে আঁকা৷ কখনো বা ভুলে যাওয়া সসেজ কেমন যেন নাটকীয় ভঙ্গিমায়৷
ক্লাউস যা বাজার করেন, তা ছবির স্বার্থে পচানো হয়৷ ভোক্তা হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের অলীক রূপ তুলে ধরেন তিনি৷ যেমন শীতকালে স্ট্রবেরি অথবা বিশ্বের অন্য প্রান্ত থেকে আনা সবুজ পেপে৷ তিনি বলেন, ‘‘শুরুর দিকে আমি খোলা মনে ভাবতাম৷ যেমন একটি কমলা লেবু, স্পেনের কোনো প্লান্টেশনে বেড়ে উঠেছে৷ তারপর সেটি তুলে দূরে কোথাও পাঠানো হয়৷ তারপর আমরা সেটি ফেলে দেই৷ খুবই দুঃখজনক দৃষ্টান্ত৷''
খাবার যেখানে প্রাণনাশক!
এতকাল বলা হয়েছে, মানবদেহে আর্সেনিক প্রবেশের অন্যতম উপায় পানীয় জল৷ এবার গবেষকরা জানিয়েছেন এক নতুন তথ্য৷ ভাতের মাধ্যমেও নাকি শরীরে ছড়াতে পারে আর্সেনিক, যা শরীরে ক্যান্সারের মতো রোগের কারণ হতে পারে৷
ছবি: FARJANA K. GODHULY/AFP/Getty Images
আর্সেনিক দূষণ
বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলে আর্সেনিকের উপস্থিতি ধরা পড়েছে অনেক আগেই৷ পানীয় জলের মাধ্যমে এই আর্সেনিক শরীরে প্রবেশ করে বলেও জানা গেছে বিভিন্ন গবেষণায়৷ এবার ‘‘প্লোস ওয়ান’’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র বলছে, ভাতের মাধ্যমেও শরীরে ছড়াতে পারে আর্সেনিক বিষ৷ ভূগর্ভস্থ পানিতে থাকা আর্সেনিক যে চালের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে, তা নিয়ে এটাই এখন অবধি সবচেয়ে বড় গবেষণা৷
ছবি: FARJANA K. GODHULY/AFP/Getty Images
সহজে মানুষের নাগালে
ভূগর্ভস্থ পানিতে প্রাকৃতিকভাবেই আর্সেনিক বিষের মিশ্রন ঘটে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সত্তরের দশকে ‘সবার জন্য পানি’ সংক্রান্ত এক প্রকল্পের আওতায় অনেক অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়৷ ফলে মাটির নীচের আর্সেনিকযুক্ত পানি সহজে সাধারণ মানুষের নাগালে চলে আসে৷
ছবি: MUFTY MUNIR/AFP/Getty Images
ভাত বেশি খেলে সমস্যা
‘‘প্লোস ওয়ান’’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রটি তৈরি করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা ১৮,৪৭০ জন স্বেচ্ছাসেবীর দেওয়া নমুনা পরীক্ষা করেছেন৷ তারা সবাই আর্সেনিক-দূষিত এলাকায় বসবাস করছেন৷ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে যারা বেশি করে ভাত খান তাদের প্রস্রাবে আর্সেনিকের মাত্রা বেশি৷ অপেক্ষাকৃত কম ভাত খাওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে এই তুলনা করেছেন গবেষকরা৷
ছবি: Suhail Waheed
মানবদেহের ক্ষতির কারণ
ব্রিটেনের লিচেস্টারে অবস্থিত ডি মোন্টফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিসিন বিশেষজ্ঞ পারভেজ হারিস বলেন, ‘‘গবেষণায় পানিতে আর্সেনিক দূষণ এবং ‘ফুড চেইনে’ তার প্রভাবের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে৷ একইসঙ্গে এটাও পরিষ্কার যে চালের মাধ্যমে পরিবাহিত আর্সেনিক মানবদেহের ক্ষতির কারণ হতে পারে৷ বিশেষ করে চামড়ায় ক্ষতের সঙ্গে এটির সম্পর্ক পাওয়া গেছে৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
জটিল পরিস্থিতি
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ৪১৭টি গ্রামে পরিচালিত এক গবেষণায় সেখানকার মানুষের প্রস্রাবের নালীর কোষের জেনেটিকে ক্ষতির নমুনা পাওয়া গেছে৷ এরফলে একটি কোষ থেকে আরেকটি কোষে ডিএনএ কোড সঠিকভাবে স্থানান্তর হতে পারছে না৷ এধরনের জটিলতা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় বলে মনে করেন গবেষকরা৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
ক্যান্সারের ঝুঁকি
এর আগে প্রকাশিত আরেক গবেষণা থেকে জানা যায়, দীর্ঘ সময় ধরে স্বল্প পরিমাণে আর্সেনিক নিয়মিত শরীরে প্রবেশ করলে মূত্রাশয়, কিডনি, ফুসফুস অথবা চামড়ায় ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে৷
ছবি: Fotolia/Schlierner
ভাত কম খান
বায়োমেডিসিন বিশেষজ্ঞ পারভেজ হারিস বলেন, ‘‘আড়াইহাজার এবং আর্সেনিক দূষণের শিকার অন্যান্য অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে যারা প্রতিদিন গড়ে ১ দশমিক ছয় কেজির বেশি ভাত খান, তাদের প্রতি আমাদের পরামর্শ হচ্ছে আপনারা ক্যালোরির উৎস হিসেবে ভাতের উপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে দিন৷ এক্ষেত্রে বিকল্প হতে পারে গম এবং কম আর্সেনিক দূষণযুক্ত এলাকায় উৎপাদিত চাল৷ সিলেট অঞ্চলের চালে আর্সেনিকের মাত্রা কম৷’’
ছবি: FARJANA K. GODHULY/AFP/Getty Images
অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য
গবেষকরা বলছেন, তাদের এই গবেষণা আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকিতে থাকা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে৷ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে কম্বোডিয়া, চীন, ভারত এবং ভিয়েতনামে আর্সেনিক নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
8 ছবি1 | 8
মন দিয়ে বাজার করার পর ক্লাউস সেগুলি পচানোর নির্দিষ্ট জায়গায় রাখেন৷ তাঁর ফ্ল্যাটে মাসের পর মাস ধরে পচতে থাকে সেগুলি৷ যেমন মিশর থেকে আনা স্ট্রবেরির সপ্তাহ দুয়েক সময় লাগে৷ অন্য খাদ্য পচতে আরও অনেক সময় লাগে৷ অন্যদের বমি পাবে – এমন অবস্থা তাঁর কাছে কিন্তু খুবই আনন্দের বিষয়৷ তিনি বলেন, ‘‘নিজের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে ভেবেছিলাম এমন পচা খাবার-দাবারের মধ্যেই বসবাস করবো৷ নিজের আস্তানার মধ্যেই সচেতনভাবে এটা করতে হবে, যাতে আমার কাজের প্রক্রিয়ায় গভীরতা আসে৷ যাতে আমি পরীক্ষা করে দেখতে পারি, আমি এটা পারি কি না৷''
ক্লাউস পিশলার একটি স্টুডিও খাড়া করে সেই পচা খাদ্যকে স্পটলাইটের সামনে নিয়ে আসেন৷ সাধারণত এ সব আবর্জনার পাত্রে স্থান পায়৷ কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে ছত্রাকের প্রতিটি সূক্ষ্ম ফারাক ফুটিয়ে তোলা হয়৷ ঠিক যেন এক বিজ্ঞাপন৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রত্যেকেই শীতকালে একবার না একবার স্ট্রবেরি খেয়েছে৷ কার্বন নির্গমন থেকে শুরু করে দীর্ঘ পরিবহন – কত কাঠখড় পুড়িয়ে অসময়ে এমন ফল আমাদের হাতে এলে একটু বিবেক দংশন হওয়াই স্বাভাবিক৷''
ছাতা ধরা বিস্কিট, ডালিম অথবা আনারস৷ ক্লাউস পিশলার তাদের মায়াবী করে তোলেন৷ কারণ অনেকের কাছেই খাদ্যের চেয়ে তার মোড়ক আর সাজসজ্জাই বেশি জরুরি৷ তবে ক্লাউস-এর মনে এখনো আশা রয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, মানুষ আবার খাদ্যের সঙ্গে স্বাভাবিক, স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়৷ বিশাল আকারের খাদ্য উৎপাদন, দীর্ঘ পরিবহন – এ সব থেকে দূরে থাকতে চায়৷ প্লেটে যা পৌঁছয়, তা ভালো করে দেখতে চায়৷''
এমন গা-গুলানো বস্তুগুলি প্রায় প্রাচীন ছবির মতো দেখতে৷ শেষ পর্যন্ত অবশ্য সুন্দর ছত্রাককেও বিদায় নিতে হয়, কারণ এমন ‘সুন্দরী মডেল'-দেরও ফেলে দেন ক্লাউস পিশলার৷