পঞ্চগড়ে পুলিশের সামনেই আহমদিয়াদের বাড়িঘরে আগুন
৪ মার্চ ২০২৩শুক্রবার হামলার পর রাতে আহমদিয়াদের ধর্মীয় জমায়েত ‘‘সালনা জলসা'' বন্ধ করে দিয়েছে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন৷ জুমার নামাজের পর সংঘর্ষে দুইজন নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে৷
শুক্রবার আহমদিয়া মুসলিম জামায়াত সালনা জলসা বিরোধীরা শহরের উপকন্ঠে অবস্থিত আহম্মদ নগরে দেড় শতাধিক বাড়িতে হামলা এবং আগুন দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন আহমদিয়া জামায়াতের মুখপাত্র আহমদ তবশির চৌধুরী৷ তারা শহরে ছয়-সাতটি দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও পুড়িয়ে দিয়েছে৷ ক্ষতিগ্রস্তরা পরিবার পরিজন নিয়ে আহমদিয়া জামায়াতের কমপ্লেক্স এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানান তিনি৷ বেলা আড়াইটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এই হামলা এবং আগুনের ঘটনা ঘটে৷
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘পুলিশের কাছ থেকে আমরা তেমন সহযোগিতা পাইনি৷ কয়েকদিন ধরেই সালনা জলসা বিরোধীরা হুমকি দিয়ে আসছিলো৷ পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷ আর শুক্রবার হামলার সময় পুলিশ থাকলেও তারা ছিলো নির্বিকার৷''
স্থানীয় পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, পঞ্চগড় কওমী মাদ্রাসা পরিষদ, জাতীয় ওলামা মাশায়েখ পরিষদ, বাংলাদেশ আইম্মাহ পরিষদ ও সম্মিলিত খতমে নবুয়ত পরিষদ সালনা জলসার বিরোধিতা করে আসছিলো৷ তারা এটা বন্ধের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপিও দেয়৷ বৃহস্পতিবার তারা এই দাবিতে সকাল ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত তেতুলিয়া ঢাকা মহাসড়ক অবরোধও করে৷ শুক্রবার জুমার নামাজের পর শহরের বিভিন্ন মসজিদ থেকে একযোগে বের হয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ লিপ্ত হয় এবং শহর থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বসতি আহম্মদ নগরে হামলা চালায়৷
এই সংঘাতে যে দুইজন নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে আরিফুর রহমান শহরের চৌরঙ্গি মোড়ে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিতে মারা যান৷ আর জাহিদ হাসানকে আহমদিয়া বিরোধীরা আহম্মদ নগর এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করে৷
সালনা জলসা হলো আহমদিয়া মুসলিম জাময়াতের বাৎসরিক ধর্মীয় সমাবেশ৷ শুক্রবার থেকে তিন দিন এটা হওয়ার কথা ছিল৷ আহম্মদ নগরে তাদের দেয়াল ঘেরা মসজিদ এবং ধর্মীয় কমপ্লেক্স আছে৷ এখানেই কেন্দ্রীয় সালনা জলসা হয়৷ সারাদেশ থেকে ওই সম্প্রদায়ের লোকজন সালনায় যোগ দিতে সেখানে গিয়েছিলেন৷
বাংলাদেশ আইম্মাহ পরিষদের সহাসচিব মাওলানা এনামুল হক মুসা দাবি করেন, ‘‘আমরা আগেই এই সালনা জলসা বন্ধের দাবি জানিয়েছিলাম৷ প্রশাসন সেটা বন্ধ করে দিলে পঞ্চগড়ের এই ঘটনা ঘটতনা৷''
তার কথা, ‘‘শুক্রবার জুমার নমাজের পর পঞ্চগড়ে তৌহিদী জনতা প্রতিবাদ মিছিল বের করে হামলার শিকার হয়েছে৷ কিন্তু আহমদিয়াদের বাড়িঘরে কারা হামলা চালিয়েছে তা আমরা জানিনা৷ এরসঙ্গে আমাদের কেউ জড়িত না৷ কারা জড়িত সরকার তা তদন্ত করে বের করে বিচারের ব্যবস্থা করুক৷''
হামলা ও আগুনের শিকার যারা
মীর হাসান আলী সুমন একজন বড় ব্যবসায়ী৷ আহম্মদ নগরে তার একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি আছে৷ তার পুরো বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান৷ তার গাড়িটিও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷
তিনি বলেন, ‘‘আমরা একটু দূরে একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে প্রাণে রক্ষা পাই৷ যারা আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন তারা আমাদের সম্প্রদায়ের নয় (তারা সুন্নি মুসলমান)৷ এখন তাদেরও হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘বিকেল তিনটা থেকে রাত সাতটা পর্যন্ত নির্বিচারে বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়৷ হামলাকারীরা লুটপাটও চালায়৷ আমার ঘরের টিভি, ফ্রিজ সব নিয়ে গেছে৷ শুধু আমার বাড়ি নয়, কমপক্ষে ১৫০-১৬০টি বাড়িতে হামলা ও আগুন দেয়া হয়েছে৷ আমরা পুলিশের সহায়তা চেয়েও পাইনি৷ তারা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেন৷''
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘শনিবার সকালেও হামলা ও লুটপাটের চেষ্টা করে৷ আর শুক্রবারের হামলার আগের দিনও তারা ভাঙচুর করে৷ এখন পুলিশ ও বিজিবির টহল আছে৷ কিন্তু একমাস আগে থেকে তারা হুমকি দিলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷''
হামলার শিকার নিয়াজ আহমেদ জানান, তার দুইটি টিনশেড পাকা বাড়িই পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ তারা ভাই বোনেরা সবাই মিলে ওই দুইটি বাড়িতে বসবাস করতেন৷
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছু নেই৷ আমরা এখন মসজিদ কমপ্লেক্সে আশ্রয় নিয়েছি৷ আমাদের প্রতিবেশিদের সঙ্গে আমাদের কখনো কোনো ঝামেলা হয়নি৷ যারা হামলা ও আগুন দিয়েছে তারা বাইরের লোক৷''
তার বাড়িতে ঢুকে প্রথমে লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয় এরপর আগুন দেয়া হয় বলে অভিযোগ করেন নিয়াজ আহমেদ৷
তিনি বলেন, ‘‘বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ধর্মান্ধরা আমাদের এলাকায় একের পর এক বাড়ি ভাঙচুর করে, আগুন দেয়৷ দূরে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকলেও আমাদের রক্ষায় এগিয়ে আসেনি৷''
তিনি বলেন, ‘‘দেড় শতাধিক বাড়িতে ভাঙচুর এবং আগুন দেয়া হয়েছে৷ পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে গেছে৷''
এই বিষয়ে জানতে জেলা পুলিশের এসপির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি৷ তবে ঘটনাস্থল সদর থানার ডিউটি অফিসার সাব-ইন্সপেক্টর মো. ফেরদৌস আলম বলেন, ‘‘শুক্রবারের ঘটনা নিয়ে একাধিক মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে৷ ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত ১২ জনকে আটক করা হয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এখন পরিস্থিতি শান্ত আছে৷ এলাকায় বিজিবি ও পুলিশ মোতায়েন আছে৷''
তবে হামলার সময় পুলিশের নিস্ক্রিয়তার ব্যাপারে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি৷
এদিকে, আহমদিয়া জামায়াতের মুখপাত্র আহমেদ তাবশির চৌধুরী বলেন, ‘‘২০১৯ সালেও ধর্মান্ধরা এই পঞ্চগড়ের আহম্মদ নগরে ৪০টিরও বেশি বাড়িঘরে আগুন ও হামলা চালায়৷ তার বিচার হয়নি৷ বিচার হলে হয়তো এবারের ঘটনা ঘটতো না৷''