শনিবার পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোট। তার আগের দিনও ব্যাপক সহিংসতা হলো। মৃত এক। প্রচুর বোমা উদ্ধার।
বিজ্ঞাপন
সহিংসতা ও বিতর্ক পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের শুরু থেকেই সঙ্গী। ভোটের আগের দিনেও ছবিটা বদলালো না। মুর্শিদাবাদের রানিনগরে খুন হলেন কংগ্রেস প্রার্থীর দাদা অরবিন্দ মণ্ডল, যিনি নিজেও একজন কংগ্রেস কর্মী।
অরবিন্দ বাড়ির সামনে দাওয়ায় বসেছিলেন, সেখানেই তাকে বেধড়ক মারা হয়। তার বুকে পেস মেকার ছিল। অরবিন্দের বুকে লাথি মারা হয়। তারপর তাকে বাঁচানো য়ায়নি। অভিযোগ, তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা এই কাজ করেছে। তৃণমূল অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তৃণমূল প্রার্থী উল্টে অভিয়োগ করেছেন, অরবিন্দ মণ্ডল তাকে মারতে গিয়েছিলেন।
এই ঘটনা যখন ঘটলো, যখন রাজ্যপাল আনন্দ বোস মুর্শিদাবাদে ছিলেন। ভোটে শান্তি আনার জন্য রাজ্যপাল এবার নিজেই অশান্ত জেলাগুলিতে ঘুরছেন। এর আগে উত্তরবঙ্গ গেছেন, ভাঙর, বাসন্তী গেছেন, এবার মুর্শিদাবাদও গেলেন। তিনি রাজভবনে একটা পিসরুমও খুলেছেন। কেউ সহিংসতার কোনো অভিযোগ করলে তা পাঠানো হচ্ছে নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য সরকারের কাছে।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পর্বের শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত খবরের শিরোনামে ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজার এলাকা। মনোনয়নের দিনগুলিতে ভাঙড়-২ নম্বর বিডিওর চেহারা শাসক-বিরোধীদের যুদ্ধক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয়েছিল।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বোমা, গুলি, গাড়ি পোড়ানো
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে প্রতি দিনই বোমাবাজি, গুলি, ইটবৃষ্টি, পুলিশের উপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এলাকা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
দোকানে আগুন
মনোনয়ন জমা দেওয়ার দিন অশান্তির আঁচ পেয়ে অনেকেই দোকান বন্ধ করে চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু দুষ্কৃতিরা বন্ধ দোকানেও আগুন লাগিয়ে দেয় বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বন্ধ দোকান লুট
বিজয়গঞ্জ বাজারে পান-বিড়ির দোকান চালান মেহেতাব আলি। তার বন্ধ দোকানেও লুটপাট চালানো হয়ে বলে জানান তিনি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ছড়িয়ে আছে সহিংসতার চিহ্ন
মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও এলাকায় ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে বোমা, কার্তুজের বাক্স, বন্দুকের অংশ। পড়ে আছে পোড়া গাড়িগুলি। দেখেই বোঝা যায়, কী হয়েছে ভাঙড়ে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সহিংসতার শীর্যে ভাঙড়
পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পর্বকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিনে অশান্ত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা। তবে অশান্তিতে শীর্ষে উঠে এসেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়। ছবিতে উদ্ধার হওয়া বোমা ও কার্তুজের প্যাকেট।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মৃত তিন
এই অশান্তিতে তিন জনের প্রাণ গিয়েছে বলে স্থানীয়দের দাবি। তাঁদের মধ্যে এক জন ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ) কর্মী, অন্য দু’জন শাসক তৃণমূলের কর্মী বলে দাবি করা হয়েছে। মতান্তরে দুইজন আইএসএফ এবং একজন তৃণমূল কর্মী মারা গেছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
এই সেই বিডিও অফিস
এখানেই মনোনয়নপত্র জমা দিতে হচ্ছিল। কিন্তু অভিযোগ, এই অফিস-চত্বরের মধ্যে ও বাইরের জায়গা শাসক দলের কর্মীরা শাসন করেছে। কাউকে ঢুকতে দেয়নি। ফলে অনেক বিরোধী প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ব্যবস্থা ছিল, তাও অভিযোগের অন্ত নেই
সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল, পুলিশ ছিল, তাও মনোনয়ন জমা দিতে পারেননি বলে বিরোধীদের অভিযোগ। ফলে অনেক জায়গায় তৃণমূল কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া জিতে গেছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
দোকানপাট এবার খুলছে
গত কয়েকদিন বন্ধই ছিল দোকানপাট থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য। রাস্তায় বেরোতে ভয় পাচ্ছিলেন এলাকার সাধারণ মানুষ। তবে বৃহস্পতিবার মনোনয়ন পর্ব শেষ হওয়ার পর শুক্রবার থেকে ভাঙড়ের পরিস্থিতিতে সামান্য বদল এসেছে বলছে স্থানীয় মানুষ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
রাজ্যপাল ভাঙড়ে
শুক্রবার দুপুরে ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজার পৌঁছান পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। তার পর যান ভাঙড় ২ নং ব্লক অফিসে। সেখানে কথা বলেন আধিকারিকদের সঙ্গে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সাধারণ মানুষের সঙ্গে
রাজ্যপাল কথা বলেন স্থানীয়দের সঙ্গেও। বোঝার চেষ্টা করেন অশান্তির কারণ। পরে রাজভবনে একটা হেলপলাইন নম্বর খোলা হয়েছে। সেখানে মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারলে ফোন করে জানানো যাচ্ছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
রাজ্যপালের বৈঠক
এরপর রাজ্যপাল পৌঁছান ভাঙড় কলেজে। কলেজে জেলা প্রশাসনের আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। কলেজের বাইরে আইএসএফ কর্মীরা রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মনোনয়ন দিতে পারেনি
বহু আইএসএফ কর্মীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। তারা মনোনয়নপত্র হাতে নিয়ে জমায়েত করেন কলেজের ক্যাম্পাসে। রাজ্যপালের বেরনোর অপেক্ষা করতে থাকেন তারা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
14 ছবি1 | 14
মুর্শিদাবাদ পৌঁছে মৃত তৃণমূল নেতার বাড়িতেও গেছেন রাজ্যপাল। নবগ্রামে তৃণমূল প্রার্থী মোজাম্মেল শেখকে পিটিয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছিল। রাজ্যপাল আনন্দ বোস তার বাড়ি গিয়ে পরিবারের মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন।
জেলায় জেলায় ঝামেলা
কোচবিহারের দিনহাটায় চারজন বিজেপি কর্মীকে গুলি করে মারার চেষ্টা হয়। তারা প্রাণে বাঁচলেও তাদের গায়ে গুলি লেগেছে। অভিযোগ, তৃণমূল কর্মীরাই এই কাজ করেছে। তৃণমূল তা অস্বীকার করেছে।
বিজেপি কর্মী বিজয় বর্মণের বাড়ির সামনে কর্মীরা বসেছিলেন। তখন বাইকে করে কয়েকজন এসে গুলি চালায়। বোমা ছোড়ে। তাতেই চারজন আহত হন। দুইজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
বীরভূমের দুবরাজপুরে দুইশটি বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। মুর্শিদাবাদেও বোমা উদ্ধার হয়েছে। এই জেলায় বোমা বাঁধতে গিয়ে দুইজন আহত হয়েছেন। জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জে তৃণমূলের অফিসে আগুন দেয়া হয়েছে। বাসন্তীতে বিজেপি কর্মীর বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়েছে। নদীয়ার ফুলিয়ায় বিজেপি প্রার্থীর বাড়ির সামনে থান, গীতা ও ধুপ রেখে দেয়া নিয়ে চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে।
বগটুইয়ে মুসলিম নারী প্রার্থী দিলো সব দল
বগটুই গ্রাম৷ ২০২২ সালে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল ১০ জনকে৷ সেখানে পঞ্চায়েতে সব দলের প্রার্থী মুসলিম নারী৷
ছবি: Satyajit Shaw/DW
তৃণমূলের প্রার্থী রুবিনা বিবি
গতবছর তৃণমূলের নেতা ভাদু শেখকে খুন করা হয়। তার জেরে বেশ কয়েকটা বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ১০ জন মারা যান। বীরভূমের সেই বগটুই গ্রামে তৃণমূল প্রার্থী হলেন রুবিনা বিবি। গ্রামে ঘুরলেই দেখা যাবে তার পোস্টার ও তৃণমূলের পতাকা-সহ কর্মীদের।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রুবিনার স্বামীর যা বললেন
রুবিনার স্বামী হীরালাল শেখের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, বগটুইকে তিনি আদর্শ গ্রাম হিসাবে গড়ে তুলবেন। আমরা সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি ও করব। আর তৃণমূলের নেতারা জানাচ্ছেন, তারা সবসময় নিহত মানুষের পরিবারের পাশে আছেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিজেপি-র প্রার্থী মেরিনা বিবি
বগটুই গ্রামে বিজেপি প্রার্থী করেছে নিহত পরিবারের সদস্য মেরিনা বিবিকে। তিনি আবার ভাদু শেখের হত্যার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে ধৃত পলাশ শেখের মা। ভাদুর হত্যার পর মেরিনা বিবির বাড়িতেও আগুন দেয়া হয়। পরিবারের অনেকে মারা যান। তৃণমূল বলছে, সিবিআইয়ের হাত থেকে বাঁচতেই প্রার্থী হয়েছেন মেরিনা বিবি। মেরিনা বিবি ডিডাব্লিউকে বলেছেন, বগটুইতে মনোনয়নপত্র পেশ করতে কোনো অসুবিধা হয়নি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সীমা খাতুনও বিজেপি-র প্রার্থী
মেরিনা বিবি বিজেপি-র প্রার্থী হয়েছেন গ্রাম পঞ্চায়েতে। আর পঞ্চায়েত সমিতিতে বিজেপি-র প্রার্থী হলেন সীমা খাতুন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, নারী, বিশেষ করে বৃদ্ধা ও বাচ্চা মেয়েদের জন্য তিনি কাজ করতে চান। দুর্নীতি ছাড়া কাজ করে দেখাতে চান। সীমাও নিহতের পরিবারের সদস্য। প্রিয়জনকে হারাবার দুঃখ তাকে এখনো তাড়া করে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কী বলছেন সীমার স্বামী
সীমার স্বামীর নাম কিরণ। তিনি বলেছেন, এখানে আগে বিজেপি ছিল না। আমরাই বিজেপি-কে এনেছি। আমি চাইছি, সীমা জিতুক। আমার পিসি মেরিনা বিবি ও স্ত্রী সীমা খাতুন যাতে জেতে তার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সিপিএমের প্রার্থী গেনেহার বিবি
সিপিএম দাঁড় করিয়েছে গেনেহার বিবিকে। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেছেন, এখনো পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দিতে বা প্রচার করতে কোনো অসুবিধা হয়নি। পরে কী হবে, তা বলতে পারছেন না। তার আক্ষেপ, গ্রামটা পুরো শেষ হয়ে গেল। যারা মারলো এবং যাদের মারলো সবাই শাসক দলের। তাই তিনি সিপিএমের হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রেজাউল হকের কথা
গ্রামে আর হিংসা চান না রেজাউল। বগটুইয়ের এই বাসিন্দার দাবি, গ্রামে এখন শান্তি আছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে তিনি ভোটটা তৃণমূলকেই দিতে চান। কারণ, তৃণমূল গরিবদের অনেক সাহায্য করে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
নাসিমুদ্দিনের পছন্দ সিপিএম
বগটুইয়ের নাসিমুদ্দিন শেখ আবার সিপিএম প্রার্থীর জয় চাইছেন। তিনি জানিয়েছেন, তৃণমূল একের পর এক দুর্নীতিতে জড়িত বলে অভিযোগ উঠছে। সবই টিভিতে দেখছেন তিনি। তাছাড়া, গরিবেরও আর উন্নতি হলো কোথায়? তাই তার পছন্দ সিপিএম।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পোড়া বাড়ির জায়গায়
এখানে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। মানুষ আগুনে ঝলসে মারা গেছিলেন। এখন সেখানে নতুন বাড়ি উঠেছে। জীবন তো থেমে থাকে না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
এখনো পোড়ার চিহ্ন
তবে সেই পোড়ানোর চিহ্ন এখনো আছো। পোড়া বাঁশ, হাওয়াই চটি সেই ভয়ংকর দিনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পুলিশ আছে
বগটুইতে এখনো পুলিশ আছে। কোনোরকম ঝুঁকি নেয়া হয়নি। উত্তেজনা যাতে আর না হয়, হলেও সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ হস্তক্ষেপ করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বাধা দেয়া হয়নি
বগটুইতে অন্তত বিরোধীদের মনোনয়নপত্র পেশ করতে, প্রাচর করতে এখনো পর্যন্ত বাধা দেয়া হয়নি। এই কথাটা বারবার বলছেন সিপিএম, বিজেপি-র প্রার্থী ও কর্মীরাও।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
12 ছবি1 | 12
কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে
ভোটের আগের দিনও জানা য়ায়নি, সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকবে কিনা। এর আগে কমিশন ঠিক করেছিল, প্রতি বুথে একজন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান থাকবেন।
কিন্তু বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় বাহিনীর কোঅর্ডিনেটর বিএসএফের আইজি জানিয়ে দেন, বুথে একজন করে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানকে রাখা যাবে না। কারণ, এখন পশ্চিমবঙ্গের যা অবস্থা, তাতে একজন বুথে থাকলে তার প্রাণ নিয়ে আশঙ্কা থাকছে। কোনো কেন্দ্রে দুইটি বুথ থাকলে অন্তত পাঁচজন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানকে সেখানে ডিউটি দিতে হবে। স্পর্শকাতর কেন্দ্র হলে সংখ্যাটা আরো বেশি হবে।
ফলে সব কেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকবে কিনা, সেই প্রস্ন ভোটের আগের দিনও থাকছে।