একের পর এক বিধায়ক কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করছেন তৃণমূলের অন্দরে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে অন্তর্কলহে জেরবার শাসকদল।
বিজ্ঞাপন
উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গ-- পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোটের আগে শাসকদলের ভিতরে অন্তর্কলহ চরমে। একের পর এক বিধায়ক দলের হাইকম্যান্ডের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন। প্রকাশ্যে দলের নিন্দা করছেন।
গত বিধানসভা ভোটের সময় দলিত সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে হুগলির বলাগড়ে টিকিট দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মনোরঞ্জন সম্প্রতি সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট দিয়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দলের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে তিনি অব্যাহতি চান। এক, জেলার পঞ্চায়েত নির্বাচন কমিটির সদস্যপদ এবং দুই, দলের রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদ। সরাসরি কোনো কারণ না দেখালেও ব্যক্তিগত স্তরে পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই নিয়ে তার রোষ গোপন করেননি মনোরঞ্জন।
বলাগড়ের এই বিধায়ক লিখেছেন, নিজের বিধায়ক পদও তিনি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আপাতত তার রোজগারের অন্য কোনো রাস্তা না থাকায় এখনই এই পদ তার পক্ষে ছাড়া সম্ভব হবে না। তবে তিনি একইসঙ্গে জানিয়েছেন, দলীয় রাজনীতির এই মঞ্চ তার জন্য নয়। কিছুদিন আগে মনোরঞ্জনের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে পঞ্চায়েত ভোটে টিকিট বিলি করার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের অন্দরেই। বিষয়টি নিয়ে ব্লক স্তরের এক নেতাকে পাল্টা আক্রমণ করেছিলেন মনোরঞ্জন।
রাজ্যজুড়েই সহিংসতা হয়েছে। অভিযোগের আঙুল তৃণমূলের দিকে। ভাঙড়, চোপড়া, বাঁকুড়া-সহ রজ্যের বহু জায়গায় রক্ত ঝড়েছে মনোনয়নপর্বে। অভিযোগ, বিভিন্ন জায়গায় মনোননপত্র জমা দিতে দেয়া হয়নি বিরোধী প্রার্থীদের। বিজেপি-র এই প্রার্থী সহিংসতার শিকার। বাঁশ, রড দিয়ে মারা হয়েছে তাকে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
আহত মানুষেরা
আরেকজন আহত মানুষ। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় মনোনয়ন ঘিরে এতটাই সংঘর্ষ হয়েছে যে, প্রচুর মানুষ আহত। ভাঙড়ে মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা ও গুলি চলেছে। চোপড়ায় সিপিএমের মিছিলের উপর লাঠি, রড, বন্দুক নিয়ে আক্রমণ করা হয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
দীনেশ মণ্ডলের দাবি
দীনেশ মণ্ডল জানিয়েছেন, তার স্ত্রী সোনামণি মণ্ডল মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেছিলেন। সেখানেই ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা তাদের আক্রমণ করে। তার বুকে একের পর এক ঘুষি মারা হয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
উত্তম বাগ মার খেয়েছেন
উত্তম বাগের স্ত্রী ঝুমা বাগ বিজেপি-র হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। মনোনয়নপত্র পেশ করতে যেতেই শুরু হয় ব্যাপক মার। রীতিমতো আহত উত্তম। রাজ্যের ৫০ শতাংশ পঞ্চায়েত আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। তাই প্রার্থীর সঙ্গে তার স্বামী বা পরিবারের সদস্যরাও মনোনয়ন পেশের সময় যান।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মার অতীন্দ্র হালদারকে
অতীন্দ্র হালদার ডায়মন্ড হারবার দুই নম্বর ব্লকের প্রার্থী ছিলেন। তাকে বিডিও অফিসে ঢুকতে দেয়া হয়নি। বেধড়ক মারা হয়েছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিমান বসুর নেতৃত্বে
চোপড়ায় সিপিএম ও কংগ্রেস প্রার্থীরা মিছিল করে মনোনয়নপত্র দিতে যাচ্ছিলেন। সেসময় তাদের মিছিলে হামলা হয়। একজন মাথায় গুলি লেগে মারা যান। গুরুতর আহত দুইজন। এরপর বিমান বসুর নেতৃত্বে সিপিএম ও কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অফিসে যান। নির্বাচন কমিশনারকে স্মারকলিপি দেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পুলিশের সঙ্গে বিরোধ
নেতারা ভিতরে গিয়েছিলেন স্মারকলিপি জমা দিতে। বাইরে রাস্তায় বসে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, বাম ও কংগ্রেস কর্মীরা। পুলিশ তাদের সরাতে যায়। শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি। পুলিশ ব্যারিকেড দেয়। কর্মীরা সেই ব্যারিকেড ফেলে দিয়ে এগোতে চায়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কি
সিপিএমের এই নারী কর্মী পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কি জুড়ে দেন। তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, চোপড়ায় গুলিতে আমাদের সহকর্মীরা মারা যাচ্ছেন, ভাঙড়ে সহযোগী দলের কর্মীরা মারা যাচ্ছেন। আপনারা কোথায় ছিলেন?
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রাস্তায় বসে প্রতিবাদ
সিপিএমের এই বয়স্ক মানুষটি রাস্তায় বসে পতাকা হাতে নিয়ে প্রতিবাদ দেখালেন। দলের সহকর্মীদের সুরক্ষার জন্য। সহিংসতা বন্ধের দাবিতে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
আইএসএফ নেতার দাবি
ভাঙড়ে মনোনয়ন জমা দেয়া নিয়ে তৃণমূল ও আইএসএফের মধ্যে ব্যাপক গোলমাল হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে পুলিশি নিরাপত্তায় শেষ পর্যন্ত আইএসএফ প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। আইএসএফ নেতা নওসাদ সিদ্দিকি এসেছিলেন নির্বাচন কমিশনে, গ্রামবাসী ও কর্মীদের নিরাপত্তার দাবি নিয়ে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিজেপি নারী মোর্চার প্রতিবাদ
পঞ্চায়েত নির্বাচনে সহিংসতার প্রতিবাদে বিজেপি নারী মোর্চার সদস্যরা রাস্তায় বসে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
প্রতিবাদে কংগ্রেসও
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সামনে কংগ্রেস কর্মীরাও প্রতিবাদ জানান। চোপড়া, ভাঙড়, মুর্শিদাবাদে কংগ্রেস কর্মীরাও সহিংসতার শিকার হয়েছেন, একজন মারা গেছেন বলে অভিযোগ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
দাঙ্গাবিরোধী পুলিশ
বিরোধীদের প্রতিবাদ সামলাতে নামানো হয়েছিল দাঙ্গাবিরোধী পুলিশও। অথচ, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় যখন সহিংসতা হয়েছে, তখন উপযুক্ত সংখ্য়ায় পুলিশ ছিল না বা থাকলেও তারা নীরব দর্শক ছিল বলে অভিযোগ বিরোধী দলগুলির।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
13 ছবি1 | 13
শুধু মনোরঞ্জন ব্যাপারী নন, উত্তরবঙ্গের অন্যতম নেতা ইসলামপুরের বিধায়ক আব্দুল করমি চৌধুরী কার্যত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রীকে। মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি বলেছেন, পঞ্চায়েত ভোটে প্রশাসন যেন নিরপেক্ষ থাকে। পঞ্চায়েত ভোটে যাদের টিকিট দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে বেজায় ক্ষুব্ধ তিনি।
আব্দুল করিমের পথেই হাঁটছেন মুর্শিদাবাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ভরতপুরের বিধায়ক হুমায়ুন কবীর। জেলার সাংগঠনিক সভাপতি শাওনী সিংহ রায়ের অপসারণ চেয়েছেন তিনি। বহরমপুরে দলের দলীয় কার্যালয় ঘেরাওয়ের হুমকি দিয়েছেন হুমায়ুন। নির্দল প্রার্থীদের সমর্থনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
বস্তুত, তৃণমূলের এই নেতারা যে অভিযোগগুলি সামনে আনছেন, রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি সেই অভিযোগ সাধারণত শাসকদলের বিরুদ্ধে করে থাকে। তৃণমূলের রাজ্য নেতৃত্ব অবশ্য বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। দলের মুখপাত্র তাপস রায় জানিয়েছেন, ''সব নেতারই পছন্দের প্রার্থী থাকে। দল সমস্ত দিক খতিয়ে প্রার্থী তালিকা তৈরি করে। তা নিয়ে সমায়িক ক্ষোভ-বিক্ষোভ হয়। কিন্তু বিষয়টি বেশি দূর গড়াবে না।''
অধীরের অবস্থান বিক্ষোভ
মুর্শিদাবাদের বড়ঞায় বিডিও অফিসের সামনে অবস্থান বিক্ষোভে বসেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি এবং লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা অধীর চৌধুরী। অভিযোগ, পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে কংগ্রেস প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাদের চিহ্ন চিহ্নিতকরণের ফর্ম নিয়ে বিডিও অফিসে যাচ্ছিলেন স্থানীয় কংগ্রেস নেতা। দুষ্কৃতীরা তার হাত থেকে ফর্মের ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ফলে ওই ফর্ম জমা দেওয়া যায়নি। এর অর্থ ওই প্রার্থীরা দলীয় প্রতীকে লড়তে পারবেন না। অধীরের অভিযোগ, ওই দুষ্কৃতীরা তৃণমূল আশ্রিত। বিডিও এবিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না বলেও অভিযোগ করেছেন অধীর। এই পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার রাত থেকে টানা অবস্থান চালাচ্ছেন লোকসভার নেতা। পাশাপাশি লোকসভার স্পিকারকেও এবিষয়ে চিঠি দিয়েছেন তিনি।