সন্তানের চিকিৎসার জন্য নরওয়েতে ফিরতে চেয়েছিলেন এক নারী৷ তা রুখতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে জোট সরকার থেকে সরে দাঁড়িয়েছে ডানপন্থি দল প্রোগ্রেস পার্টি৷
বিজ্ঞাপন
নরওয়ের সংবিধানে আগাম নির্বাচনের বিধান নেই৷ নইলে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের অনেক আগেই পতন হতো ক্ষমতাসীন জোট সরকারের৷
সরকারের এমন অবস্থায় পড়ার কারণ ২০১৩ সালে নরওয়ে থেকে সিরিয়ায় চলে যাওয়া এক নারী৷ সম্প্রতি তিনি তার দুই সন্তানের একজনের চিকিৎসার জন্য আবার ফিরে আসতে চাইলে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে প্রোগ্রেস পার্টি৷ দলটির অভিযোগ, সিরিয়ায় গিয়ে সেই নারী এক আইএস যোদ্ধাকে বিয়ে করেছিলেন৷ এমন ‘জঙ্গি সমর্থক' নারীকে দেশে না ফেরানোর দাবিও তোলে তারা৷ দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রয়োজনে শিশুকে এনে সব রকমের সুযোগ-সুবিধা দেয়া যেতে পারে, তবে ‘জঙ্গি সমর্থক' প্রাপ্তবয়স্ক নারীকে ফিরতে দেয়া যাবে না৷
কিন্তু প্রোগ্রেস পার্টির এ দাবি মেনে নেয়নি রক্ষণশীল দল৷ সম্প্রতি ওই নারী সিরিয়ার কুর্দি নিয়ন্ত্রিত আল-হোল শরণার্থী শিবির থেকে নরওয়েতে ফিরে আসেন৷
সাবেক আইএস জঙ্গিদের যেভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ কয়েকদিন ধরে ইসলামিক স্টেটে যোগ দেয়া নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার পথ খুঁজছে৷ এদিকে, সিরিয়ার শাম্মার গোষ্ঠী ইতিমধ্যে সাবেক আইএস সদস্যদের গ্রহণ করা শুরু করেছে৷
ছবি: DW/B. Gerdziunas
কারা এই শাম্মার?
সিরিয়ার আরব গোষ্ঠী শাম্মারের সশস্ত্র বাহিনী ‘আল সানাদিদ’ এতদিন ধরে মার্কিনপন্থি সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স, এসডিএফ-এর সাথে যুক্ত ছিল৷ সম্প্রতি দল পালটে তারা কুর্দি নেতৃত্বাধীন নাগরিক গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছে৷ উল্লেখ্য, বর্তমান উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার বিশাল এলাকা শাম্মার গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে৷
ছবি: DW/B. Gerdziunas
একসাথে প্রার্থনা
শাম্মার নেতা শেখ হুমায়দি দাহাম আল-হাদির বাড়ির চত্বরে প্রতি শুক্রবার প্রার্থনাসভা হয়৷ সেখানে আশেপাশের গ্রামের মানুষজনের সাথে উপস্থিত থাকেন ইসলামিক স্টেটের সাবেক সৈনিকরাও৷
ছবি: DW/B. Gerdziunas
ঘরে বাইরে...
ইসলামিক স্টেটে যোগ দেয়া শাম্মার সদস্যরা শেখের আহ্বানে ফিরে এসেছে৷ শেখের নির্দেশেই প্রথমে তারা এসডিএফের কাছে আত্মসমর্পণ করে ও পরে বিচারের সম্মুখীন হয়৷ বিচারপর্ব শেষ হলে তবেই আবার শাম্মার গোষ্ঠীর সম্পূর্ণ সদস্যপদ ফিরে পাবেন প্রাক্তন জঙ্গিরা৷
ছবি: DW/B. Gerdziunas
ঘরে ফেরা নিয়ে বিতর্ক
শেখ যদিও অস্বীকার করেছেন যে শাম্মারের ঘরে জঙ্গিদের কোনো স্থান নেই, কিন্তু শাম্মার গোষ্ঠীর জনসংযোগকর্তা আবদুলহামিদ আল-আসকারের মতে, এমন ঘটনা আকছার ঘটছে৷ আল-সানাদিদে একাধিক প্রাক্তন আইএস সদস্য রয়েছেন বলে জানান তিনি৷ শেখ হুমায়দির মতে তাদেরও অবস্থান জঙ্গিবাদের বিপরীতেই৷ সে কারণেই বর্তমানে তারা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলি ও আইএস সৈনিকদের মধ্যে মধ্যস্থতা করছেন৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/S. Backhaus
কেন ঘরে ফিরছে সৈনিকরা?
শেখ হুমায়দির মতে, সিরিয়ার শাম্মার সদস্যরা নেতৃত্বের চাপে পড়ে আইএস-এ যোগদান করে৷ এখন নিজেদের গোষ্ঠীর কাছে ফিরে আসতে চাইছে তারা৷ এবং শাম্মার তাদের সেই সুযোগ দিচ্ছে বলেই এমনটা সম্ভব হচ্ছে৷
ছবি: DW/B. Gerdziunas
ফেরার পর...
সাবেক আইএস সৈনিকদের ঘরে ফেরার পরের জীবন মোটেও আরামের নয়৷ কড়া অনুশাসনের মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হয় তাদের৷ শোনা গেছে, ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধিরা এসে পর্যবেক্ষণ করে গেছেন প্রাক্তন জঙ্গিদের এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া৷
ছবি: DW/B. Gerdziunas
যুদ্ধক্ষেত্রে ফুটবল
ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যে সংযোগকারী একটি রেলপথ বেশ কয়েক বছর ধরে নিষ্ক্রিয়৷ শেখের মতে, রেলপথের বেশিরভাগ অংশই এখন কয়েকশ’ আইএস জঙ্গিদের দখলে৷ বাতিল হওয়া রেললাইনের পাশেই চলছে ফুটবল খেলা৷ ওপরের ছবিতে রয়েছে সেই দৃশ্য৷
ছবি: DW/B. Gerdziunas
7 ছবি1 | 7
সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রোগ্রেস পার্টির নেতা, বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী সিভ জেনসেন জানান, এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া সম্ভব নয়, তাই জোট থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে তার দল৷ দলকে জোটের অংশ করায় নিজের ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের (দলকে) আমি সরকারের অংশ করেছিলাম এবং এখন দলকে আমিই সরিয়ে নিচ্ছি৷''
প্রোগ্রেস পার্টি সরে দাঁড়ানোয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে রক্ষণশীল দল৷ আগাম নির্বাচনের বিধান না থাকায় তারপরও অবশ্য এখনই সরকারের পতন হচ্ছে না৷ প্রধানমন্ত্রী এরনা সোলবার্গ জানিয়েছেন, সংখ্যালঘু সরকারের চলতি দায়িত্বে তিনি থেকে যেতে চান৷
সিরিয়া যুদ্ধ শুরুর পর সেই দেশে চলে যাওয়া নারীদের ফেরা নিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা ইউরোপে নতুন নয়৷ তবে আপত্তি সত্ত্বেও কোনো কোনো নারীকে বিশেষ বিবেচনায় ফেরানো হচ্ছে৷ গত নভেম্বরে জার্মানিতেও ফিরেছেন একজন৷
দেশে দেশে উগ্রপন্থিদের পুনর্বাসন
উগ্রবাদে জড়িতদের সমাজের মূল স্রোতে ফেরাতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়ে থাকে বিভিন্ন দেশ৷ কোনো কোনো দেশ সে কাজে সাফল্য পেয়েছে, আবার কোথাও কাজ এখনো চলমান৷ চলুন দেখে নিই কয়েকটি দেশের উগ্রপন্থি পুনর্বাসন প্রক্রিয়া৷
ছবি: picture alliance / akg-images
নাৎসিদের পুনর্বাসন, জার্মানি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসিবাদের বিলোপের পাশাপাশি যারা হত্যা-নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়৷ নাৎসি পার্টি ও অনুগত সংগঠনের লোকদের মূল অপরাধী, অপরাধী, কম অপরাধী, অনুগত এবং খালাস ক্যাটেগরিতে চিহ্নিত করা হয়৷ প্রথম তিন শ্রেণিকে আনা হয় বিচারের আওতায়৷ ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চলে ডিনাজিফিকেশন৷ পরে নাৎসি অনুগতদের নাগরিক অধিকার দেওয়া হলেও অপরাধীদের বিচার এখনো চলছে৷
ছবি: picture alliance / akg-images
তামিল টাইগার, শ্রীলঙ্কা
২০০৯ সালে তামিল টাইগার বিদ্রোহীদের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়৷ আটক ১১,৬৬৪ জন যোদ্ধাকে পুনর্বাসনের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নেয় সরকার৷ ৬+১ মডেলে শুরু হয় এই পুনর্বাসন কার্যক্রম৷ এর মধ্যে যোদ্ধাদের জন্য ১. শিক্ষা, ২. কারগরি, ৩. মানসিক ও সৃজনশীল থেরাপি, ৪. সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক কার্যক্রম ৫. আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় এবং ৬. বিনোদনমূলক কার্যক্রম নেয়া হয়৷ পাশাপাশি চলে ‘কমিউনিটি পুনর্বাসন’ কাযর্ক্রম৷
ছবি: picture-alliance/dpa/epa/str
উইঘুর জঙ্গিদের পুনর্বাসন, চীন
উইঘুর মুসলিম জঙ্গিদের দমনে ডিব়্যাডিকালাইজেশনের সঙ্গে পুনর্বাসন কার্যক্রম হাতে নেয় চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ৷ এর মধ্যে কারা কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, ধর্মীয় কাউন্সেলিং, নাগরিক সমাজের পরামর্শ গ্রহণ এবং উগ্রবাদ থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের দিয়ে উগ্রবাদবিরোধী বক্তব্য প্রচারের উদ্যোগ ছিল৷ সাজা মওকুফ করা হয় জঙ্গিদের কারো কারো৷ যাদের সাজা শেষ কিংবা মওকুফ হয়, তাদের চাকরি ও সমাজে অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়াও আছে চীনে৷
ছবি: Getty Images/K. Frayer
মুসলিম উগ্রপন্থিদের পুনর্বাসন, সিঙ্গাপুর
ইসলামি পণ্ডিত ও শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত সিঙ্গাপুরের রিলিজিয়াস রিহ্যাবিলিটেশন গ্রুপ (আরআরজি) উগ্রবাদীদের সঠিক পথে ফেরানোর কাজে সরকারকে সহায়তা করে৷ ২০০৩ সালে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জেমাহ ইসলামিয়া-কে পুনর্বাসনের জন্য এর কার্যক্রম শুরু হয়৷ গ্রেপ্তার হওয়া উগ্রবাদীদের পরিবারকে কাউন্সেলিং ও আর্থিক সহায়তা দিতে কাজ করে তারা৷ এ পর্যন্ত দেড় হাজার কাউন্সেলিং সেশন করে সুনাম কুড়িয়েছে গ্রুপটি৷ মোবাইল অ্যাপও আছে তাদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সন্ত্রাসী পুনর্বাসন, নাইজেরিয়া
তেল নিয়ে সংঘাতে জড়িত নাইজার ডেল্টা মিলিট্যান্টদের ২০০৯ সালে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করে নাইজেরিয়া৷ জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা হয়৷ দেশে-বিদেশে দেওয়া হয় প্রশিক্ষণ৷ স্কিল ট্রেইনিংয়ের পর তাদের ৪৩৯ মার্কিন ডলার করে মাসিক ভাতাও দেয়া হয়৷ ২০১৬ সাল থেকে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী বোকো হারামের পুনর্বাসন কাজ চলছে৷ জঙ্গিদের পাশাপাশি সংঘাতে বাস্তুচ্যুতরাও আছেন এই প্রক্রিয়ায়৷
ছবি: Reuters/A. Sotunde
কমিউনিস্ট ও আইএস জঙ্গিদের পুনর্বাসন, মালয়েশিয়া
১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ সালে মালয়ান ইমারজেন্সির সময়ে কমিউনিস্টদের পুনর্বাসনের যে ধারা মালয়েশিয়ায় চালু হয়েছিল, সেটি এখনো অন্যভাবে চালু আছে৷ সেই প্রক্রিয়ায় ২০১৭ সালের দিকে ২৫০ জন আইএস জঙ্গিকে ধরা হয় এবং তাদের অনেককে বিচারের পাশাপাশি পুনর্বাসন করা হয়৷ মূলধারার মূল্যবোধ শেখানো, অর্থ সহায়তা ও ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণসহ নানা উদ্যোগ থাকে তাদের এই পুনর্বাসন কার্যক্রমে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Xinhua
পুনর্বাসনে উদাহরণ তৈরি করেছে সৌদি আরব
২০০৪ সালে কয়েকটি জঙ্গি হামলার শিকার হলে উগ্রবাদীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় সৌদি আরব৷ কারাগার ও ওপেন সোসাইটির মিশেলে ৫টি পুনর্বাসন কেন্দ্র খোলে তারা৷ শিক্ষা, খেলাধুলা ও বিনোদনসহ নানা ব্যবস্থা রাখা হয় সেখানে৷ সৌদি কর্তৃপক্ষ বলছে, এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫০০ জন সঠিক পথে ফিরেছেন, যাদের মধ্যে ১২৩ জন গুয়ানতানামো কারাগারে ছিলেন৷৮০ ভাগ সাফল্যের দাবি তাদের৷ সেখান থেকে ফিরে আবার জঙ্গিবাদে জড়ানোর কিছু উদাহরণও আছে৷