1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পথশিশুদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনবে কে?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাংলাদেশে পথশিশুদের বড় অংশই রয়েছে রাজধানী ঢাকায়৷ ফেলে দেয়া খাবারেই তাদের ক্ষুধা মেটে৷ আর ফেলে দেয়া জিনিসপত্র সংগ্রহ ও বিক্রি করাই তাদের প্রধান পেশা৷ তারা থাকে ফুটপাথ, পার্ক অথবা কোনো খোলা জায়গায়৷

চিত্র শিল্পী রফিকুন্নবী ( রনবী)-র ‘টোকাই' চরিত্র সবার জানা৷ অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় তাদের একেকটা ক্যারেক্টার তিনি প্রতি সপ্তাহে  হাজির করতেন৷ তারা অনেক বুদ্ধিদীপ্ত ছোট ছোট মন্তব্য করত৷ এটা অনেক আগের কথা৷ তারাই পথ শিশু৷ তাদের কেউ ভেঙে যাওয়া পরিবার থেকে বের হয়ে আসে৷ কেউ অভাবের তাড়নায়৷ আবার কেউবা নদী ভাঙনের শিকার হয়ে৷ এরা শিশু৷ এদের বয়স ৬ থেকে ১৮ বছরের নীচে৷ এই বয়সের এসব শিশুর দেখা মেলে ঢাকার রাস্তা, পার্ক, বাস স্টেশন, রেল স্টেশন বা খোলা কোনো জায়গায়৷ তাদের কোনো ঘরবাড়ি নেই৷ নেই কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা৷ পথেই থাকে৷ পথেই তাদের জীবিকা৷ তাদের বয়সও তো বাড়ে৷ তারপর কোথায় যায়? কী হয় তাদের পরিণতি? তাদের জীবন কেমন হয়?

এই পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করছে লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (লিডো) নামের একটি এনজিও৷ সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এদের মধ্যে যারা কিছু কিছু সংস্থার অধীনে থাকে, তারা হয়তো মূল ধারায় গিয়ে যুক্ত হয়৷ কিন্তু এর বাইরে যারা থাকে, তাদের কেউ কেউ মাদকাসক্ত হয়ে রাস্তায়ই মারা যায়৷ কেউ কেউ চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়ে যায়৷ যারা পাচারের শিকার হয়, তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হয়৷ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় তারা৷ যারা মেয়ে, তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়৷ কোনো কোনো গ্যাং তাদের যৌনকর্মী হতে বাধ্য করে৷''

‘এরা অপরাধী নয়, অপরাধের শিকার’: ফরহাদ

This browser does not support the audio element.

তিনি বলেন, ‘‘অপরাধীচক্রগুলো এদের মাদকসহ নানা অবৈধ ব্যবসায় কাজে লাগায়৷ এরা অপরাধী নয়৷ এরা অপরাধের শিকার হয়৷ রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের নানা কাজে ব্যবহার করে৷''

বাংলাদেশে পথ শিশুর সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো জরিপ নেই৷ কেউ বলেন ২০ লাখ৷ আবার কেউ বলেন ২৫ লাখ৷ ঢাকা শহরে আছে কমপক্ষে ৬-৭ লাখ৷ তবে এদের মধ্যে ৫০ হাজার শিশু আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় থাকে৷

সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ) নামের একটি সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু গোসল করতে পারে না, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই এবং ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলে ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না৷

একই গবেষণায় বলা হয়, ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে সর্বোচ্চ ছয় মাস থাকে৷ এদের মধ্যে ২৯ শতাংশ শিশু স্থান পরিবর্তন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কারণে আর ৩৩ শতাংশ পাহারাদারের কারণে৷

খোলা আকাশের নীচে ঘুমানোর পরও তাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ শিশুকে মাসিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা নৈশপ্রহরী ও মাস্তানদের দিতে হয়৷ তারা পুলিশি নির্যাতন এবং গ্রেপ্তারেরও শিকার হয়৷

জানা যায়, পথশিশুদের বড় একটি অংশ আসে দরিদ্র ‘ব্রোকেন ফ্যামিলি' থেকে৷ দারিদ্র্যই মূল কারণ৷  বাবা-মায়ের বহু বিবাহও একটি কারণ৷ তার সাথে যুক্ত হয় নদী ভাঙন, ভূমিহীনতা, জলবায়ুর পরিবর্তন৷

‘কোনো উদ্যোগই টেকসই নয়’: ইমরানুল

This browser does not support the audio element.

ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘‘এই পথশিশুদের জীবন যাপন অনেক জটিল৷ নিজেদের চেয়ে অনেক বেশি বয়সের লোকজনের সাথে থাকতে হয়৷ ভিক্ষাবৃত্তি করতে হয়৷ আর ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ থেকে তারা নানা জিনিস সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য৷ তারা নানা রোগে আক্রান্ত হয়৷ পথশিশুদের ২৫-৩০ ভাগ মেয়ে৷ তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে৷''

ঢাকাসহ সারাদেশে পথশিশুদের নিয়ে অনেক বেসরকারি সংগঠন কাজ করে৷ কেউ খাবার দেয়৷ কেউ পোশাক দেয়৷ কেউ দেয় শিক্ষা৷ কেউ আবার তাদের বিনোদনের ব্যবস্থাও করে৷ তবে দিনশেষে তাদের পথেই ফিরে যেতে হয়৷ তাদের পুরোপুরি পুনর্বাসনের জন্য খুব বেশি উদ্যোগ নেই৷ লিডো পথশিশুদের উদ্ধার করে রেসকিউ সেন্টারে রাখে৷ তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে৷ যাদের পরিবার পাওয়া যায় না, তাদের পুনর্বাসন করার চেষ্টা করে৷ তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম৷

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের সভাপতি ইমরানুল হক চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ঢাকা শহরে অনেক কেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ আছে এই পথশিশুদের জন্য৷ সরকারি কিছু উদ্যোগও আছে৷ কিন্তু এর কোনো উদ্যোগই টেকসই নয়৷ এটা ঘায়ে মলম দেয়ার মতো৷ আসলে তাদের দরকার স্থায়ী পুনর্বাসন৷ ফ্যামিলি অ্যাটাচমেন্ট৷ সেটা কিভাবে করা যায় তা সরকারকে ভাবতে হবে৷ তাদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনাই হলো আসল কাজ৷ তাদের শিক্ষা, থাকার স্থায়ী জায়গা এবং খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে৷ তারা যদি যেখানে আছে, সেখানেই থাকে, তাহলে কোনো লাভ নেই৷ মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে৷''

তিনি বলেন, ‘‘এই পথশিশুদের নিয়ে প্রথমে একটা সঠিক সার্ভে বা রিয়েল স্টাডি করতে হবে৷ আর সেই স্টাডির ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ আমরা একটি ছোট প্রকল্প চালাচ্ছি৷ সরকারের কাছে আমরা কিছু প্রস্তাবও দিয়েছি৷ এই শিশুদের শিক্ষা দেয়া সহজ৷ কারণ, সরকারি প্রাইমারিতে ফ্রি এডুকেশন, বই এবং শিক্ষা সামগ্রী দেয়া হয়৷ এর বাইরে তাদের মাসিক একটা ভাতা দিতে হবে৷ সেটা ১০০০ টাকা হতে পারে৷ তাতে খুব বেশি টাকা লাগবে না৷ যাদের পরিবার আছে, তাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে৷ যাদের নেই, তাদের নানাভাবে পুনর্বাসন করে রাস্তা থেকে নিয়ে আসতে হবে৷ তারা রাস্তায় থাকলে তাদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা যাবে না৷''

‘পথশিশুদের নিয়ে সঠিক পদ্ধতিতে কাজ হচ্ছে না’: সুমন

This browser does not support the audio element.

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পথশিশুদের ৫১ ভাগ ‘অশ্লীল কথার শিকার' হয়৷ শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ২০ শতাংশ৷ সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় মেয়েশিশু৷ ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়৷ আর মেয়ে পথশিশুদের মধ্যে ৪৬ ভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার৷

ইমরানুল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘পথশিশুদের মধ্যে যারা মেয়ে, তারা সবচেয়ে বেশি ভালনারেবল৷ তারা মোট পথ শিশুর ৩০ ভাগ৷ সবার আগে প্রয়োজন তাদের পথ থেকে নিয়ে এসে পুনর্বাসন করা৷''

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলকায় কিছু শিক্ষার্থী মিলে ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে ওই এলাকার পথশিশুদের জন্য ‘বঞ্চিত শিশুদের স্কুল অর্ক' নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল সম্পুর্ন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে৷ সেখানে প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি খাদ্য এবং কাজের ব্যবস্থা করা হতো৷ তাদের স্কুলে মোবাইল খাবারের দোকান ছিল৷ তাতে তারা কাজ করত এবং অর্ক স্কুলে পড়াশুনা করতো৷ দোকান থেকে লাভের একটা অংশ তারা পেতো৷ অন্য অংশ দিয়ে স্কুল  পরিচালনা করা হতো৷ তাদের এক পর্যায়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেয়া হতো৷ সেই স্কুলের উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ছাত্র সুমন জাহিদ৷ সুমন জাহিদ তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পরিবার থেকে একবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তাদের শৃঙ্খলায় আনা কঠিন৷ তাদের ভিতরে এক ধরনের স্বাধীনচেতা ভাব কাজ করে৷ তাই তাদের কোথাও কোনো নিয়মে আটকে রাখা অনেক জটিল৷ এজন্য নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়৷ তাদের মানসিক অবস্থা বুঝে তাদের সঙ্গে কাজ করতে হয়৷ তাদের জীবন সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি দেয়াই আসল কাজ৷''

তিনি বলেন, ‘‘আমরা এটা অনেকটা পেরেছিলাম৷ তারা আমাদের বন্ধু মনে করত৷ আমি পরবর্তীতে দেখেছি, আমাদের স্কুলে যারা ছিল, তাদের প্রায় সবাই মূল ধারায় ফিরতে পেরেছে৷ কেউ চাকরি, কেউ ব্যবসাও করছে৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশে পথশিশুদের অবস্থা এখন খুবই খারাপ৷ তাদের নিয়ে সঠিক পদ্ধতিতে কাজ হচ্ছে না৷''

পথশিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কীভাবে কাজ করা উচিত বলে মনে করেন? লিখুন মন্তব্যের ঘরে৷ 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ