1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পথে পথে ‘গরু শিকারি’ রুখবে কে?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৩ জুন ২০২৩

কোরবানির পশুবাহী ট্রাক রাস্তায় কোথাও থামানো যাবে না- নির্দেশনা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এর উদ্দেশ্য যাতে কোনোভাবে চাঁদাবাজির শিকার না হন বেপারিরা। কিন্তু তদের কথা, পথে পথে এখন তৎপর নানা হাটের ইজারাদারদের ‘গরু শিকারি'৷

Bangladesch | Opferfest
ছবি: Mortuza Rashed

কোরবানির পশুবাহী ট্রাক রাস্তায় কোথাও থামানো যাবে না- এই নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এর উদ্দেশ্য যাতে কোনোভাবে চাঁদাবাজির শিকার না হন গরুর বেপারিরা। কিন্তু তদের কথা এরচেয়েও বেশি আতঙ্কে আছেন তারা জোর করে হাটে গরু নামানো নিয়ে। পথে পথে এখন তৎপর নানা হাটের ইজারাদারদের ‘গরু শিকারি’।

বাংলাদেশে ইদুল আজহা ২৯ জুন। ঢাকার দুই সিটি কর্পোারেশনে আনুষ্ঠানিকভবে পশুর হাট বসবে ২৫ জুন থেকে। এরইমধ্যে হাটের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বেপারি ও গৃহস্থরা গরু নিয়ে হাটে আসা শুরু করেছেন। তাদের একজন মোস্তফা মিয়া নাটোর থেকে তিনটি ট্রাকে ২২টি গরু নিয়ে ঢাকার বারিধারা হাটে এসেছেন মঙ্গলবার সকালে।  তিনি জানান, "আসার পথে গরু ভর্তি তিনটি ট্রাক আটক করে উত্তরা হাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা ওই হাটেই আমাকে গরু নামাতে বলে। পরে আমার এক আত্মীয় আছে ঢাকায় পুলিশের এসআই। তাকে ফোন করলে তিনি এসে আমাদের উদ্ধার করেন। তারপর গরু নিয়ে বারিধারা হাটে যাই৷’’

তিনি জানান, নাটোর থেকে আসার পথে তার গরুর ট্রাক কেউ থামায়নি। পুলিশও না। তবে পথে পথে অন্যদের গরুর ট্রাক থামানোর খবর তিনি পেয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, "রাস্তার পাশে যেসব গরুর হাট বসেছে সেই হাটের লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। তারা গরুর ট্রাক লাঠি দিয়ে পিটিয়ে থামিয়ে ফেলে। ট্রাকের সামনের কাঁচ ভেঙ্গে দেয়। জোর করে তাদের হাটে গরু নামাতে চায়’’

বুধবার সকালে তার সঙ্গে কথা হয়। সন্ধ্যায় তিনি আবার এই প্রতিবেদককে ফোন করে জানান তার আরো ১৩টি গরু নিয়ে ট্রাক বৃহস্পতিবার নাটোর থেকে রওয়ানা হবে। যদি পথে তার ট্রাক আটকানো হয় তাহলে তিনি ফোন করবেন। তার আশা এই প্রতিবেদক তাকে তখন সহায়তা করেন। কারণ পথে পুলিশ থাকলেও তারা সহায়তা করে না।

তার কথা, "স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিষেধ করলেও পথে পথে ট্রাক আটকানো শুরু হয়ে গেছে। তার কথায় কোনো কাজ হচ্ছে না৷’’

ঢাকার দুই সিটিতে এবার মোট ১৬টি গরুর হাট বসবে। এরমধ্যে গাবতলীসহ দুইটি স্থায়ী আর ১৪টি হাট অস্থায়ী। আর সারাদেশে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো কোরবানির পশুর হাট বসবে। এইসব হাটের ইজারাদাররা পশু বিক্রির পর হাসিল ( খাজনা) আদায় করে বিপুল অর্থ আয় করেন। আর সেই জন্যই কোরবানির পশুর ট্রাক নিয়ে টানাটানি। পশুর হাটগুলোর ইজারা ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের বাইরে কারো পাওয়ার কোনো সুযোগ নাই।

গরুর ট্রাক লাঠি দিয়ে পিটিয়ে থামিয়ে ফেলে: মোস্তফা মিয়া

This browser does not support the audio element.

তাই ট্রাক থামিয়ে রাস্তায় পুলিশসহ স্থানীয় রাজনৈতিকনেতা, মাস্তান, শ্রমিক নেতাদের চাঁদা আদায়ের চেয়েও গরুর ট্রাক থামিয়ে ইজারাদারদের পছন্দের হাটে যাওয়াই কোরবানির পশু ব্যবসায়ীদের জন্য এখন বড় আতঙ্ক।

সেই কথাই বললেন মেহেরপুরের মোস্তফা এগ্রোর মালিক  আবু নাইম আহমেদ। এবার তিনি ঢাকার ভাটারা এলাকার নতুন বাজার পশু হাটে ৫০ টি গরু আনবেন মেহেরপুর থেকে। দুই ট্রাক নিয়ে এরইমধ্যে চলে এসেছেন। তার কথা,"স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললে কী হবে। তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। পথে পথে অসহ্য যন্ত্রণা। মেহেরপুর থেকে আসতে মহাসড়কের পাশে পশুর হাটের লোকজন গরুর ট্রাক থামানোর জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। নানাভাবে তাদের ম্যানেজ করতে হয়। মারধোরও করে। আমার লোকজন ঢাকার সংসদ সদস্য রহমত উল্লাহর নাম বলে ঢাকা পর্যন্ত গরু নিয়ে আসতে পেরেছে। অনেকে আসতে পারেন না। পথের হাটেই গরু নামাতে বাধ্য হয়। চাঁদা দিয়েও কাজ হয় না। গরু নামাতেই হয়।’’

এগুলো পুলিশ দেখে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, "পুলিশ তো ইজারাদারদের লোক। যত হাট ইজারা হয়েছে সবগুলোর সঙ্গেই পুলিশ আছে। তারা ভাগ পায়। এখন আর আগের মতো গরুর ট্রাক থামিয়ে পুলিশ তেমন চাঁদা নেয় না। তারা ইজারাদারদের সঙ্গে থেকে ভাগ নেয়।’’

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি হনিফ খোকন বলেন, ‘‘ধরুন বগুড়া থেকে ঢাকার গাবতলি গরুর হাটে কোরবানির পশু নিয়ে একটি ট্রাককে কমপক্ষে ৩০ জায়গায় থামানো হয়। এর বেশিরভাগেরই উদ্দেশ্য চাঁদা আদায়। এই দূরত্বে কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়।” তার কথা, এই চাঁদা শুধু পুলিশ নয়, স্থানীয় মাস্তান, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী, পরিবহন মালিক-শ্রমিক ইউনিয়ন, পৌরসভাসহ নানা নামে তোলা হয়। এট রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। তিনি মনে করেন, "স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই পথে পথে কোরবানির পশুর ট্রাক থামানোর ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন তা ভালো ফল দেবে। ব্যবসায়ীদের স্বস্তি হবে। তবে আশঙ্কাও আছে। এই সুযোগে না আবার গরুর ট্রাকে করে ফেনসিডিলসহ নানা ধরনের মাদক ও অবৈধ পণ্য পরিবহন হয়।”

বাংলাদেশে সাড়ে চার লাখের মতো ছোট-বড় ট্রাক ও কভার্ড ভ্যান আছে। এরমধ্যে কোরবানির সময় এক লাখ ট্রাক কোরবানির পশু পরিবহন করে বলে জানান বাংলাদেশ ট্রাক ও কভার্ড ভ্যান মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি রুস্তম আলী খান। তিনি বলেন, "কোরবানির পশুর ট্রাকে সাধারণত অবৈধ মাদক বা পণ্য পরিবহন হয়না। কারণ তারা গরু নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আর একটি ট্রাকে অনেক টাকার গরু থাকায় ওই ধরনের রিস্ক কেউ নেন না।”

চাঁদা দিয়েও কাজ হয় না, গরু নামাতেই হয়: আবু নাইম আহমেদ

This browser does not support the audio element.

তার কথা, ‘‘পথে পথে ট্রাক না থামানোর যে সিদ্ধান্ত সেটা ভালো। এতে চাঁদাবাজি কমে যাবে। এমনিতেও কয়েক বছর ধরে এটা অনেক কমে এসেছে। এখন মূল সমস্যা হলো পথে ট্রাক থামিয়ে বেপারিদের ইজারাদাদের  পছন্দের হাটে যেতে বাধ্য করা। জোর করে গরু নামানো।  এটা মহাসড়কে তো হয়ই। ঢাকা শহরের ভিতরেও হয়।”

এই জোর করে হাটে গরু নিয়ে যাওয়ার ঘটনা নৌপথেও একই রকম। ইজারদারদের লোকজন ট্রলারে করে নদীতে টহল দেন।  নদীর মঝে তারা গরু বোঝাই নৌযান আটকে জোর করে হাটে নিয়ে যায়।

গরুর বেপারিরা বলেন, এই জোর করে হাটে নিতে গিয়ে অনেক সময় গরু  ট্রাক থেকে পড়ে যায়। গরুর পা ভেঙে যায়। অতীতে গরুর ট্রলার ডুবিয়ে দেয়ার ঘটনাও আছে। এর  ফলে, তারাপছন্দের হাটে গরু নিতে পারেন না। ক্ষতি পোষাতে গরুর দাম তাদের বেশি চাইতে হয়। আর বিক্রি করতে না পারলে ইজারদারদের খুঁজে পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম বলেন, "শুধু কোরবানির সময় নয়, বছরের অন্যান্য সময়েও ইজারাদারদের হাতে ব্যবসায়ীদের জিম্মি থাকতে হয়। তারা তাদের ইচ্ছে মত হাসিল আদায় করে। দেখার কেউ নেই। একটি গরু  সারা বছর লালন পালন করে একজন ব্যবসায়ী পাঁচ হাজার টাকা লাভ করে। আর সেই একটি গরু থেকে  ইজারাদার একদিনেই পাঁচ হাজার টাকা হাসিল নিয়ে নেয়। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন।”

পুলিশ বলছে, এবার সবদিকই তারা দেখবে। রাস্তায় পশুর ট্রাক থামিয়ে যাতে চাঁদাবাজি না হয় সেটার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। জোর করে গরু যাতে কোনো ইজারাদার তাদের হাটে না নিতে পারে তাও দেখা হচ্ছে।  এজন্য হাইওয়ে এবং নৌ পুলিশও সক্রিয় আছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. মনজুর রহমান বলেন, "স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন কোরবানির পশুর ট্রাক থামানো যাবে না। তাদের চলাচলের পথে কোনো বাধা দেয়া বা হয়রানি করা যাবে না। তবে যদি সন্দেহজনক বা অবৈধ কোনো পণ্য পরিবহনের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য থাকে তাহলে এসপি বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে ট্রাক থামানো ও তল্লাশি করা যাবে।”

ট্রাকের সামনে কোন হাটে যাচ্ছে তার ব্যানার লাগানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে: মো. মনজুর রহমান

This browser does not support the audio element.

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "ইজারাদার বা তাদের লোক কোনো ট্রাক জোর করে কোনো হাটে নিতে পারবে না। এজন্য ব্যবসায়ীদের ট্রাকের সামনে কোন হাটে যাচ্ছে তার ব্যানার লাগানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। যদি কেউ জোর করে বা থামায় তাহলে ৯৯৯-এ ফোন করতে বলা হয়েছে তাৎক্ষণিক সহায়তার জন্য। আর হাইওয়ে এবং নৌ পুলিশ তো আছেই। সড়কে দায়িত্বরত পুলিশের কাছেও সহায়তা চাইতে পারেন  তারা।”

প্রসঙ্গত , ঈদুল আজহায় দেশে এবার চাহিদার তুলনায় প্রায় ২১ লাখ কোরবানিযোগ্য পশু বেশি আছে।

কোরবানির জন্য পশুর চাহিদা আছে এক  কোটি তিন লাখ ৯৪ হাজার ৭৩৯টি। আর কোরবানির জন্য দেশে পশু আছে এক কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি। যা গত বছরের চেয়ে চার লাখ ১১ হাজার বেশি। এই তথ্য মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ