দুর্নীতিবিরোধী জন লোকপাল বিল বিধানসভায় তুলতে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল৷ প্রশ্ন হলো, এর সঙ্গে সঙ্গেই কি শেষ হয়ে গেল আম আদমি পার্টি বা আপ-এর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ?
বিজ্ঞাপন
অনেকের মতে, এই দল আসলেই ছিল সাধারণ মানুষের৷ ক্ষমতায় যাওয়া বা নিজেদের পকেট ভরানো নয়, এই দল বলেছিল মানুষের কথা, দেশের কথা ভেবে৷ আর তাতেই তারা করেছিল বাজিমাত! বিধানসভা নির্বাচনে জয় লাভ করে গত ২৮শে ডিসেম্বর দিল্লিতে সরকার গঠন করেছিল কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি৷
কিন্তু শুক্রবার বিকালে বিধানসভার অধিবেশনে কংগ্রেস ও বিজেপির তীব্র বিরোধিতায় লোকপাল বিল তুলতে ব্যর্থ হলেন কেজরিওয়াল৷ এরপর রাতেই তিনি করে বসলেন কাজটা৷ অনশন নয়, একেবারে পদত্যাগ৷ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে রাজনীতিতে আসার এক বছরের মাথাতেই তাহলে কি শেষ হয়ে গেল আম আদমি পার্টির ভবিষ্যৎ?
ক্ষমতায় আসার পর পরই অবশ্য অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার তাপ ক্রমশই বাড়ছিল৷ দলের ভিতরের এবং বাইরের এই কোন্দল কীভাবে সামলানো যায়, সেটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ৷ অভিযোগের প্রথম তোপ দেগেছিলেন দলেরই ওজনদার বিধায়ক বিনোদ কুমার বিন্নি৷
দিল্লিতে সাধারণ মানুষের জয়
দুর্নীতিবিরোধী দল ‘আম আদমি পার্টি’ দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে চমক দেখিয়েছে৷ ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে হারিয়ে শুধু দিল্লির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেনি, ভারতের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দিয়েছে তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিকল্পে স্বস্তি খোঁজা
আত্মপ্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮টিতে জিতেছে আম আদমি পার্টি৷ অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক নতুন একটি দলের এমন সাফল্যকে দেখছেন ‘সাধারণ মানুষের জয়’ হিসেবে৷ তাদের এ জয় কংগ্রেস তো বটেই, এমনকি এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ৷আম আদমি পার্টি লোকসভা নির্বাচনের জন্য ভোটারদের সামনে বিকল্প পছন্দ হিসেবে উঠে এসেছে৷
ছবি: Getty Images/Afp/Narinder Nanu
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ
আম আদমি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানিয়েছেন, তাঁর দল ৩২টি আসন পাওয়া ডানপন্থী দল বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে রাজ্য সরকারে অংশীদার হবে না৷ ঘুস কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল আম আদমি পার্টি৷ অরবিন্দ কেজরিওয়াল ছিলেন সেই আন্দোলনের পুরোভাগে৷ দিল্লির নির্বাচনে এ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: Reuters
কংগ্রেসের ভরাডুবি
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে বড় দল কংগ্রেস৷ এবারের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে সেই দল হেরে গেছে নবাগত আম আদমি পার্টির কাছে৷ ভোটাররা যে দিল্লিতে অন্তত কংগ্রেসের শাসনে ক্ষুব্ধ এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই৷ মুখ্যমন্ত্রী শীলা দিক্ষিতের নেতৃত্বে টানা ১৫ বছর রাজ্য সরকার পরিচালনা করেছে কংগ্রেস৷ এবার শীলা দিক্ষিত নিজেই হেরেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাছে৷ মাত্র ৮টি আসন পেয়েছে কংগ্রেস৷
ছবি: Reuters
নতুন পথের বাঁকে
ভারতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন শুরু করেছিলেন আন্না হাজারে৷ ৭৪ বছর বয়সি এই সমাজকর্মী সংসদে ‘জন লোকপাল বিল’ পাস করানোর দাবিতে শুরু করেছিলেন অনশন৷ অরবিন্দ কেজরিওয়ালও ছিলেন তখনকার সেই দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে৷ পরে আম আদমি পার্টি গড়েন৷ ‘আম আদমি’, অর্থাৎ সাধারণ জনগণের সমর্থন নিয়ে কেজরিওয়াল এবার এক নতুন পথের বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছেন ভারতের রাজনীতিকে৷
ছবি: Reuters
‘গণতন্ত্রবিরোধী’ দাবি!
কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা দুর্নীতিকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করলেও এর সমাধানের উপায় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অদূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন৷ কংগ্রেস সমর্থকরা বলছেন, আম আদমি পার্টি এবং এর বাইরের সমাজকর্মীরা প্রকারান্তরে অনির্বাচিতদের কর্তৃত্বের কথা বলছেন, অথচ গণতন্ত্র নির্বাচিত প্রতিনিধির ওপরই জনগণের সেবার দায়িত্ব অর্পণ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ধর্ষণের বিরুদ্ধে রায়
গত এক বছরে বেশ কয়েকটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দিল্লিতে৷ ধর্ষণ রোধ করে দিল্লির নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার৷ এ ব্যর্থতার জন্য দিল্লির ভোটাররা রাজ্য সরকারকেই দায়ী মনে করে৷ বিশ্লেষকদের মতে, নারীর নিরাপত্তা বিধানে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতার কারণে জনমনে জন্ম নেয়া হতাশারও প্রতিফলন ঘটেছে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে৷
ছবি: Reuters
নতুন চ্যালেঞ্জার
দিল্লির মতো রাজস্থান, ছত্তিশগড় আর মধ্য প্রদেশের নির্বাচনেও বিজেপির কাছে হেরেছে কংগ্রেস৷ আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ড্রেস রিহার্সেলে এমন পরাজয় কংগ্রেসের জন্য নিশ্চয়ই খুব বড় ভাবনার বিষয়৷ আম আদমি পার্টি বিধানসভা নির্বাচনে শুধু দিল্লিতেই অংশ নিয়েছে৷ তবে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনেও অংশ নেয়ার পরিকল্পনার কথা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে দলটি৷ বিজেপির জন্যও এটা কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জ!
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
বলেছিলেন কেজরিওয়াল সরকার ও জনগণকে ধোঁকা দিচ্ছেন৷ নির্বাচনি প্রতিশ্রুতির কোনোটাই এখনও পর্যন্ত পালন করতে পারেননি তিনি৷ যে ইস্যুকে ভিত্তি করে আম আদমি পার্টি ক্ষমতায় এসেছে সেই দুর্নীতি দমনে জনলোকপাল বিল ১৫ দিনের মধ্যে বিধানসভায় আনার কথা ছিল, কিন্তু আনতে পারেনি৷ ২০১২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দিল্লির বাসে একজন মেডিকেল ছাত্রীর গণধর্ষণ কাণ্ডে গোটা দেশে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে সামিল হয়ে মহিলাদের নিরাপত্তার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন যিনি, সেই তিনি সরকারে আসার পর চোখের সামনে নির্বিবাদে চলেছে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ৷ বিনোদ কুমার বিন্নির প্রশ্ন ছিল, কোথায় গেল মহিলাদের নিরাপত্তার জন্য কেজরিওয়ালের বিশেষ কমান্ডো বাহিনী গঠনের প্রতিশ্রুতি? কেন শিথিল হয়ে গেল আম আদমি পার্টির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের লৌহমুষ্টি?
আম আদমি পার্টির মুখপাত্র যোগেন্দ্র যাদব অবশ্য মনে করেন, সরকার চালাবার অনুকূল পরিবেশ তাদের নেই৷ প্রথমত সংখ্যালঘু সরকার, দ্বিতীয়ত রাজধানী দিল্লির দ্বৈত প্রশাসনিক কাঠামো৷ পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা এবং জমি দিল্লি সরকারের অধীনে নেই – যেটা অন্যান্য রাজ্যে থাকে৷
তা সত্ত্বেও আম আদমি সরকার যা করে দেখিয়েছে তার তুলনা হয়ত নেই৷ বিদ্যতের বিল কমানো, ভিআইপি কালচার বন্ধ করা, এমনকি দুর্নীতি-বিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল তোপ দেগেছিলেন ওপর মহলের দিকেও৷ মুখ খুলেছিলেন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মুকেশ আম্বানি এবং বর্তমান ও প্রাক্তন পেট্রোলিয়াম মন্ত্রীর বিরুদ্ধেও৷ কিন্তু এবার? তাঁর অচমকা পদত্যাগে সাধারণ মানুষের কথা কি তবে আবারো হারিয়ে যাবে হাওয়ায়?