জার্মানির জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার মেসুত ও্যজিল বর্ণবাদের অভিযোগ এনে গতবছর পদত্যাগ করেন৷ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে আবারও কথা বলেছেন তুর্কি বংশোদ্ভূত এই ফুটবলার৷
বিজ্ঞাপন
খেলাধুলা বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘দ্য অ্যাথলেটিক'কে দেয়া সাক্ষাৎকারে জার্মানির হয়ে বিশ্বকাপ জেতা ও্যজিল বলেন, জাতীয় দল থেকে তাঁর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল৷ ‘‘সিদ্ধান্ত নেয়ার পর অনেক সময় চলে গেছে৷ কিন্তু আজও আমি জানি যে, সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল,'' বলেন ৩১ বছর বয়সি ও্যজিল৷ তিনি বলেন, ‘‘ঐ সময়টা আমার জন্য খুব কঠিন ছিল৷ কারণ জার্মানির হয়ে আমি নয় বছর খেলেছি৷ তাদের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ও ছিলাম আমি৷’’
গতবছর মে মাসে লন্ডনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যিপ এর্দোয়ানের সঙ্গে ছবি তুলে জার্মানিতে বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন ও্যজিল৷ তাঁর সঙ্গে জার্মান জাতীয় দলের আরেক খেলোয়াড় ইলকায় গুন্দোয়ানও ছিলেন৷
ঐ ছবি প্রকাশের পর সামাজিক মাধ্যমে ও্যজিলকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল৷ এরপর জুন-জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে জার্মানির হয়ে খেলার সময় সমর্থকদের রোষের মুখে পড়েন বলে জানান তিনি৷
এরপর ২২ জুলাই জাতীয় দল থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন ও্যজিল৷ পদত্যাগপত্রে তিনি বর্ণবাদ ও বৈষম্যের অভিযোগ তুলেছিলেন৷
দ্য অ্যাথলেটিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ও্যজিল ঐ সময় সম্পর্কে আবারও কথা বলেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি বর্ণবাদী আচরণ পাচ্ছিলাম - এমনকি রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকেও - সেই জাতীয় দলের কেউ এসে বলেননি যে, ‘এসব বন্ধ করুন৷ ও আমাদের খেলোয়াড়, আপনি তাঁকে এভাবে অপমান করতে পারেন না’৷ সবাই চুপ করে ছিলেন এবং এসব ঘটতে দিয়েছিলেন৷’’
এক নজরে মেসুত ও্যজিল
এক যুগ জার্সি গায়ে বিভিন্ন পর্যায়ের জার্মান দলের প্রতিনিধিত্ব করার পর, এর্দোয়ান-বিতর্কে অবসর নিলেন মেসুত ও্যজিল৷ চলুন এক নজরে দেখে নেয়া যাক ও্যজিলের বর্ণিল ক্যারিয়ার৷
২০০৫ সালে ও্যজিল নিজের শহর গালসেনকিয়র্শেনে বুন্ডেসলিগার দল শালকের যুবা দলে যোগ দেন৷ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর সাফল্য আসে বেশ দ্রুতই৷ ২০০৯ সালে জার্মানির হয়ে অনূর্ধ্ব-২১ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন তিনি৷
ছবি: Imago/Team 2
ব্রেমেন এবং তারপর
যাঁরা একসময় ‘ভবিষ্যতের তারকা’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন, তাঁদের হতাশ করেননি ও্যজিল৷ শালকের সাথে বেতন নিয়ে বনিবনা না হওয়ার পর ২০০৮ সালে ভ্যার্ডার ব্রেমেনে যোগ দেন তিনি৷ ২০১০ সালের বিশ্বকাপে তাঁর নজরকাড়া নৈপুণ্য ইউরোপের সবচেয়ে ভালো ক্লাবগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ ২০১০ সালে ও্যজিল রেয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন, পরে তৎকালীন সময়ে ৫০ মিলিয়ন ইউরোর রেকর্ড ট্রান্সফার মানিতে যোগ দেন ইংলিশ দল আর্সেনালে৷
ছবি: Imago/Sven Simon
ইন্টিগ্রেশন
২০১০ সালে ও্যজিল জার্মানির সর্বোচ্চ মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড ‘বাম্বি’ জিতে নেন৷ জার্মানিতে ও্যজিল তাঁর পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম৷ তুর্কি ঐতিহ্য নিয়ে গর্ববোধ করলেও, ও্যজিল জার্মানির প্রতি তাঁর আনুগত্যের কথা বরাবরই জানিয়ে এসেছেন৷ ও্যজিল একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম৷ ২০১৬ সালে মক্কায় হজ করে এসেছেন তিনি, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছবিও পোস্ট করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Pedersen
জয় করেছেন হৃদয়
২০১২ সালে জার্মানির হয়ে তুরস্ককে হারানোর পরের ছবি এটি৷ খেলোয়াড়দের কেবিনে গিয়ে ও্যজিলের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ নিজের শান্ত মেজাজ ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার অনেক ভক্তকে কাছে টেনেছেন৷ ২০১৪ সালে নিজের বিশ্বকাপ জয়ের উপার্জন ব্রাজিলের দুস্থ শিশুদের চিকিৎসার জন্য দান করে সবার মন জয় করে নেন তিনি৷
২০১৪ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পথে সাতটি ম্যাচই শুরুর করেছিলেন ও্যজিল৷ জার্মান কোচ ইওয়াখিম ল্যোভের সঙ্গে বরাবরই সুসম্পর্ক ছিল তাঁর৷ সবচেয়ে বেশি সফল পাসের তালিকায় সেবার তৃতীয় হয়েছিলেন ও্যজিল৷ সবচেয়ে বেশি গোলের সুযোগ তৈরি করে দেয়ার ক্ষেত্রে আর্জেন্টাইন তারকা মেসিই ছিলেন কেবল তাঁর চেয়ে এগিয়ে৷
ছবি: picture-alliance/GES/M. Gillar
এর্দোয়ান বিতর্ক
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ানের সঙ্গে আগেও দেখা করেছেন ও্যজিল৷ কিন্তু ২০১৮ সালের মে মাসে এর্দোয়ানের সাথে এমনই এক সাক্ষাতের পর তোলা ছবি বিতর্ক উসকে দেয়৷ বামপন্থিরা এই বৈঠক ও ছবিকে বর্ণনা করেছেন স্বৈরাচারী এক শাসকের পক্ষে সমর্থনের প্রতীক বলে, অন্যদিকে, চরম ডান থেকে অভিযোগ এসেছে ও্যজিলের জার্মানির প্রতি আনুগত্যের অভাবের৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Presidential Press Service
একটি অধ্যায়ের অবসান
২০১৮ সালে রুশ বিশ্বকাপের প্রথম পর্ব থেকেই বাদ পড়ে জার্মানি৷ কয়েক দশকের মধ্যে যা ছিল দেশটির সবচেয়ে বাজে পারফর্ম্যান্স৷ ডিএফবি-প্রধান রাইনহার্ড গ্রিন্ডেল নিজের দিকে আসতে থাকা সমালোচনার তীর ঘুরিয়ে দেন ও্যজিলের দিকে৷ তিনি অভিযোগ করেন, এর্দোয়ানের সঙ্গে বৈঠকের পর দলে বিক্ষিপ্ত মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে৷ এর সমালোচনায় মুখর হয়েছেন রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে জার্মান ফুটবল ফ্যানরাও৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
জিতলে ‘জার্মান’, হারলে ‘অভিবাসী’
মাত্র ২৯ বছর বয়সেই টুইটারে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে অবসরের ঘোষণা দিলেন ও্যজিল৷ গ্রিন্ডেলের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘তাঁর অদক্ষতার জন্য আমি বলির পাঁঠা হতে রাজি না’৷ ডিএফবি প্রধানের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগও তোলেন তিনি৷ বাজে সময়ে পাশে থাকায় জার্মান কোচ ইওয়াখিম ল্যোভ এবং সহকর্মীদের ধন্যবাদ জানান তিনি৷ জার্মানির হয়ে মোট ৯২ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ২৩টি গোল নিজে করেছেন এবং ৪০টি গোলে সহায়তা করেছেন ও্যজিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Charisius
8 ছবি1 | 8
বিশ্বকাপের সময় সমর্থকদের কাছ থেকে শোনা কয়েকটি মন্তব্যও উল্লেখ করেন ও্যজিল৷ যেমন ‘তোমার দেশে ফিরে যাও’, ‘এফ... ইওরসেল্ফ’ এবং ‘তুর্কি শুয়োর’ ইত্যাদি৷
ও্যজিল বলেন, ‘‘আমার মনে হচ্ছিল, তাঁরা আশা করছিলেন, (এর্দোয়ানের সঙ্গে) বৈঠকের জন্য আমি ক্ষমা চাই, আমি যে ভুল করেছি সেটা স্বীকার করে নেই, এবং তারপর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে৷ তা না হলে, আমি দলে স্বাগত হতাম না এবং আমাকে দল ছাড়তে হতো৷ আমি কখনও তা করবো না৷’’
জার্মানিতে বর্ণবাদ সবসময় ছিল মন্তব্য করে আর্সেনালের বর্তমান ফুটবলার ও্যজিল বলেন, তাঁর ঘটনায় বর্ণবাদের বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে এসেছে৷ তিনি বলেন, ‘‘তাঁরা ব্যক্তিগত মত দিতে পারেন, আমার ছবি তাঁদের অপছন্দ হতে পারে, তেমনি আমিও ছবি তোলার বিষয়ে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারি৷ কিন্তু তারপর যা হয়েছে, তাতে সবার কাছে তাদেঁর বর্ণবাদী চরিত্র বের হয়ে গেছে৷’’
ও্যজিল মনে করছেন, তাঁর সঙ্গে হওয়া ঘটনাটি জার্মানিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের একটি নির্দেশক৷
সম্প্রতি জার্মানির হালে শহরে ইহুদিদের একটি উপাসনালয়ের কাছে এক নব্য-নাৎসির এলোপাতাড়ি গুলিতে দুজন নিহত হন৷ এই ঘটনার উল্লেখ করে ও্যজিল বলেন, ‘‘জার্মানির অনেকগুলো বড় সমস্যা আছে - গত সপ্তাহে হালেতে যে ঘটনাটি হলো সেটির দিকে তাকান, সেটা একটি ইহুদিবিদ্বেষী হামলা ছিল৷ দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বর্ণবাদ শুধুমাত্র আর ডানপন্থি ইস্যু নয়৷ এটি সমাজের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে৷’’