পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় অংশগ্রহণকারীদের করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ মেনে চলার অনুরোধ করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ৷
বিজ্ঞাপন
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগের দিন শুক্রবার বেলা ১১টায় মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাটে প্রধানমন্ত্রীর জনসভাস্থল পরিদর্শনে এসে আইজিপি জানান, সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠান ও জনসভায় কোনো ধরনের হুমকি নেই৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবগুলো শাখা সমন্বিতভাবে কাজ করছে৷
কোভিড সংক্রমণ বাড়ার প্রসঙ্গ টেনে বেনজীর বলেন, ‘‘জনসভাস্থলে লাখ লাখ মানুষের সমাগম হবে৷ আমরা সম্প্রতি দেখতে পেয়েছি, সারা দেশে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে৷এ কারণে যারা জনসভাস্থলে আসবেন করোনার যে নিরাপত্তা ও বিধিনিষেধ রয়েছে সেগুলো সবাইকে মেনে চলার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি৷’’
জনসভায় ১০ লাখ মানুষের সমাগম হতে পারে উল্লেখ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান বলেন, ‘‘পুলিশের কাছে এ নিয়ে কোনো থ্রেট (হুমকি) নেই৷ যদি কোনো থ্রেট থাকে তা আমরা মিটিগেশন (হ্রাস করা) করব৷ আমাদের সঙ্গে সবার ক্রমাগত গোয়েন্দা সমন্বয় আছে৷এ ছাড়া ঐতিহাসিক এই জনসভা ঘিরে প্রতিটি স্থানে আমাদের নিরাপত্তার জন্য আলাদা সিকিউরিটি ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ এখানে জেলা পুলিশ, নৌ-পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ আলাদাভাবে কাজ করছে৷ জনসভা শেষ হওয়া না পর্যন্ত আমরা এখানে থাকব৷’’
পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে আইজিপি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর জনসভাস্থলে দুটি সর্বাধিক প্রযুক্তির ওয়াচ টাওয়ার বসানো হয়েছে৷ যা প্রথমবারের মতো আমাদের দেশে ব্যবহার হচ্ছে৷ এই বড় ওয়াচ টাওয়ার দুটি অমেরিকা থেকে সম্প্রতি আনা হয়েছে৷ শারীরিকভাবে এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুর্ণমূল্যায়ন করছি এবং প্রতি মুহূর্তে মূল্যায়ন করা হচ্ছে৷ আমাদের সঙ্গে গোয়েন্দা সমন্বয় রয়েছে৷ আশা করছি, দেশবাসীর সমর্থন নিয়ে আগামীকালের ঐতিহাসিক এই মুহূর্তকে উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপন করতে পারব৷’’
পদ্মা সেতু নিয়ে ১০ বছরের কিছু কথা ও ‘কুকথা’
গত ১০ বছর ধরেই বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে, সামাজিক মাধ্যমে তুমুল আলোচিত একটি বিষয় পদ্মা সেতু। নানা সময়ে এ নিয়ে রাজনীতিবিদ ও রাজনীতির বাইরের অনেকে অনেক কথা বলেছেন। সেসব নিয়েই এই ছবিঘর...
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
ঋণ চুক্তি বাতিলের সময় বিশ্ব ব্যাংকের বক্তব্য
২০১২ সালের ৩০ জুন বিশ্ব ব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করে বিবৃতি দেয়। তাতে সেতু প্রকল্পের ব্যাপারে সরকারি কর্মকর্তা, এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা এবং বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ আছে- দাবি করে বিশ্বব্যাংক বলে, ‘‘কেবল তখনই একটি প্রকল্পে আমরা অর্থায়ন করবো, যখন আমরা যথেষ্ট নিশ্চয়তা পাবো যে, প্রকল্পটি পরিষ্কার ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হবে। ’’
ছবি: AFP/Getty Images/E. Baradat
খালেদা বললেন, দুর্নীতিতে প্রধানমন্ত্রীর পরিবার জড়িত, এ আমলে পদ্মা সেতু হবে না
বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের দিন চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, “পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতিতে সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর পরিবারই জড়িত। এই সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক আর টাকা দেবে না বলে দিয়েছে। ফলে এই সরকারের আমলে আর পদ্মা সেতু হবে না।’’
ছবি: Reuters
সাত সদস্যের বাইরে পরিবার নেই: শেখ হাসিনা
এর তিন দিন পর যেন খালেদার এই কথারই জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংসদে তিনি বলেন, “আমি, আমার ছোট বোন এবং আমাদের পাঁচ ছেলে-মেয়ে ছাড়া আমার আর কোনো পরিবার নেই। এর বাইরে আমার কেউ নেই। পরিবারের মোট সাত সদস্যের কেউ দুর্নীতিতে জড়িত নয়।” তাদের নাম ভাঙিয়ে কেউ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করলে তাকে জানাতেও অনুরোধ করেন শেখ হাসিনা। অভিযোগ জানানোর জন্য দুটি ফোন নম্বর এবং একটি ইমেইল ঠিকানাও দিয়েছিলেন তিনি।
ছবি: Reuters
দুর্নীতির অভিযোগ ফালতু: মুহিত
২০১২ সালের ৮ এপ্রিল সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর সঙ্গে প্রাক বাজেট আলোচনায় সাবেক অর্থমন্ত্রী, প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত।বলেছিলেন, “পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি, আর এ ক্ষেত্রে তাদের (বিশ্ব ব্যাংক) পদক্ষেপ পুরোপুরি ভুল। কেউ কেউ বলছে, সেখানে দুর্নীতি হয়েছে। এটা একেবারেই ফালতু কথা।”
ছবি: Thomas Koehler/photothek.net/picture alliance
ঋণ চুক্তি বাতিল পরোক্ষভাবে বেশ ক্ষতিকর: আকবর আলী খান
বিশ্ব ব্যাংক ঋণ চুক্তি বাতিল করার পর আকবর আলী খান বলেন, পরোক্ষভাবে এটি বাংলাদেশের জন্য বেশ ক্ষতিকর হবে। ভবিষ্যতে নতুন প্রকল্প নেওয়া হলে তাতে দুর্নীতি সংক্রান্ত সম্ভাব্য বিষয়গুলোর জন্য নতুন শর্ত যুক্ত হতে পারে। এতে প্রকল্প অনুমোদন, প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন বিলম্বিত হবে। তিনি বলেন, ‘‘বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে অপেক্ষাকৃত কম দামে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেতো। এটি কারিগরি ও তদারকির দিক থেকেও অনেক উন্নত হতো। ’’
ছবি: Samir Kumar Dey
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি মির্জা ফখরুলের
পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল হওয়ার আগেই ২০১২ সালের ১১ এপ্রিল বিএনপির সেই সময়কার ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। মন্ত্রীর এপিএস-এর গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এসব দুর্নীতির সঠিক ব্যাখ্যা দিতে না পারলে দায় স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিৎ।”
ছবি: DW/S. Hossain
মসিউরের পদত্যাগ চেয়েছিলেন এরশাদ
২০১২ সালের আগস্টে পদ্মা সেতু ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমানকে পদত্যাগ করতে বলে ছিলেন সেই সময় ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তখনকার যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন পদত্যাগ করেছিলেন। সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসাইন প্রথমে ছুটিতে যান, পরে গ্রেপ্তার হন। সেই সময় ঋণ চুক্তি বাতিল করার পর বিশ্ব ব্যাংককে ফেরাতে মসিউরের পদত্যাগ চান এরশাদ।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার কারণে অন্য সব অগ্রাধিকার প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে সরকারকে সতর্ক করেন সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল সিপিডিকে উদ্বৃত করে ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী অর্থ বছরের বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তার মত তিন গুরুত্বপূর্ণ খাতের অতিরিক্ত বরাদ্দ খেয়ে ফেলতে পারে পদ্মা সেতু। এ সবে আশঙ্কাজনকভাবে বরাদ্দ কমে যেতে পারে।
ছবি: bdnews24.com
নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ নিছক ‘কল্পনাবিলাস’: মওদুদ
২০১২ সালের ৮ জুলাই নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের রূপরেখা সংসদে ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই রূপরেখাকে ‘কল্পনাবিলাস’ হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন বিএনপির প্রয়াত নেতা মওদুদ আহমদ। পরের বছর ১২ জানুয়ারি মওদুদ বলেন, পদ্মা ‘‘সেতুর কাজ শুরুর আগেই মন্ত্রী, আমলারা ১০ শতাংশ হারে ২ হাজার কোটি টাকা ঘুস নিয়েছেন। এ কারণে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে।’’
ছবি: bdnews24.com
জোড়া-তালির পদ্মা সেতুতে উঠবেন না: খালেদা
২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেন, ‘‘পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না।’’
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/A. M. Ahad
সেতু তো জোড়া দিয়েই হয়: শেখ হাসিনা
খালেদা জিয়ার মন্তব্যের জবাবে সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘সেতু তো বিভিন্ন পার্ট (অংশ) তৈরি করে করে নির্মাণ হয়। এ ক্ষেত্রে তো জোড়া দিয়েই সেতু করা হয়। জোড়া না দিলে তো সেতু হয় না। উনি (খালেদা জিয়া) জোড়াতালি দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা আমার বোধগম্য নয়। তবে বাংলাদেশে তো একটা প্রচলিত কথা রয়েছে, পাগলে কিনা কয়, ছাগলে কিনা খায়। আমার মনে হয়, এ ধরনের পাগলের কথায় বেশি মনোযোগ না দেওয়াই ভালো।’’
ছবি: Xinhua News Agency/picture alliance
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে ইউনূসের হাত?
পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধে নোবেল বিজয়ী ইউনূসের ভূমিকার কথা নানা সময়ে উঠে এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিউনিখে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়কেও ‘ভয় দেখানো’ হয়েছিল; বলা হয়েছিল ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরালে পদ্মা প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ ছাড়াও ‘অসুবিধা হবে।
ছবি: Getty Images/S. Vlasic
ইউনূস সেন্টারের অস্বীকার
একই বছরের ১৯ জুন ইউনূস সেন্টারের এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রফেসর ইউনূস পদ্মা সেতু প্রকল্পে দূর্নীতির সম্ভাবনা বিষয়ে প্রকাশ্যে বা ব্যক্তিগতভাবে কখনো কারো কাছে কোনো বিবৃতি দেননি। সরকারের বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ তৈরিতে তিনি কখনোই কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন না।
ছবি: DW
পদ্মা সেতু নির্মাণের পর মির্জা ফখরুলের দাবি
গত ৫ জুন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, ‘‘পদ্মা সেতুর প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন খালেদা জিয়া।’’ তবে এই দাবি নাকচ করে দেন খালেদা সরকারের সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদা। ২০০৫ সালের ৬ অগাস্ট হুদা একটি ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন, ২০০৬-এর মার্চে হওয়ার কথা ছিল। তবে তার চার বছর আগে ২০০১ সালের ৪ জুলাই শেখ হাসিনা মাওয়া প্রান্তে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।
ছবি: bdnews24.com
14 ছবি1 | 14
বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘‘সেতু মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা কমিটি এখানে কাজ করছে৷ আমরা সর্বশেষ নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেখতে এসেছি৷ জনসভাস্থলে যাওয়া-আসার পথ কেমন হবে, গাড়ি পার্কিং কেমন হবে- এসব বিষয় আমরা ট্রাফিক পরামর্শ দিয়েছি৷ এই নির্দেশনা ও বিধিনিষেধ মানলে সবার জন্য জনসভাস্থলে আসা খুবই সুবিধা হবে৷ এ ছাড়া রাস্তায় সাইন পোস্টিং দেওয়া আছে৷ যারা এখানে কখনও আসেননি তারাও খুব সহজে এই জনসভাস্থলে খুব সহজে প্রবেশ করতে পারবেন৷’’
শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর সভাস্থল পরিদর্শনে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, মাদারীপুরের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) চাইলাউ মারমা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) লিমন রায়, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (শিবচর-সার্কেল) আনিসুর রহমান, শিবচর থানার ওসি মো. মিরাজ হোসেন উপস্থিত ছিলেন৷