1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পদ্মা সেতু ও প্রচারের প্রতিযোগিতা

সুলাইমান নিলয় ঢাকা
১ জুলাই ২০২২

এক সময় পদ্মা সেতু বিষয়ক সাংবাদিকতাকে ‘স্প্যান বা পিলার জার্নালিজম’ নামে ট্রল করা হতো৷ সেই পর্ব ছাপিয়ে আরো এগিয়ে উদ্বোধনের সপ্তাহে এই সেতুকে যেন প্রতিযোগিতা করে কাভারেজ দিয়েছে ঢাকার গণমাধ্যমগুলো৷

এক সময় পদ্মা সেতু বিষয়ক সাংবাদিকতাকে ‘স্প্যান বা পিলার জার্নালিজম' নামে ট্রল করা হতো। সেই পর্ব ছাপিয়ে আরো এগিয়ে উদ্বোধনের সপ্তাহে এই সেতুকে যেন প্রতিযোগিতা করে কাভারেজ দিয়েছে ঢাকার গণমাধ্যমগুলো।
ছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS

মানুষের আগ্রহের কারণে এই কাভারেজ- সংশ্লিষ্টদের এমন মত থাকলেও একজন গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ বলেছেন, এটা বিকৃতির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে৷ গণমাধ্যমের এই কাভারেজ নিয়েও অনলাইনে-অফলাইনে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে৷

৭ বছরের বেশি সময় ধরে পদ্মা সেতু কাভার করছেন দেশের প্রথম বিজনেস টেলিভিশন ‘এখন টিভি'-র অ্যাসাইনমেন্ট ইনচার্জ ও বিশেষ প্রতিনিধি এহসান জুয়েল৷ ২০১৪ সালে সময় টিভির হয়ে তিনি পদ্মা সেতু কাভার করতে যান৷ ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ছোট-বড় ঘটনার পাশাপাশি, প্রতি মাসের ১ তারিখের জন্য একটি স্টোরি করতেন তিনি৷

অনেকে মনে করেন, স্প্যান জার্নালিজমের ট্রলের শুরু এহসান জুয়েলের এক সময়কার কর্মস্থল সময় টিভির কাভারেজ থেকেই৷ সামাজিক মাধ্যমে এই ট্রল নানা সময়ে নজরে এসেছে সাংবাদিক জুয়েলেরও৷ তিনি বলেন, এই সব ট্রলকে পরোয়া না করে মানুষের, বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের আগ্রহের কারণেই তারা এই সব রিপোর্ট করেছেন৷

২০১৪ সালের শেষের দিকে পদ্মা সেতুকে নিয়ে প্রথম প্রতিবেদন করতে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘‘তখন পদ্মায় সেতুর কিছু ছিল না৷ কেবল পানি ছিল৷ সেইক্ষেত্রে আমরা তখন অল্প অল্প যে বিষয়গুলো ছিল, রাস্তা হচ্ছিল, কিছু যন্ত্রপাতি আসছিল- সেটা নিয়ে আমরা প্রথম স্টোরি করি৷’’

জুয়েল জানান, সাধারণ মানুষের ব্যাপক সাড়া পেয়েই তখন প্রতি মাসের ১ তারিখে একটা আপডেট দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷

‘অনেক টিভি ৪০-৫০ জনের টিম নিয়ে কাভার করেছে’

This browser does not support the audio element.

পদ্মা সেতুর ছোটখাটো বিষয় কাভার করার ক্ষেত্রে তার যুক্তি, ‘‘পত্রিকায়-টিভিতে প্রচুর নিউজ যায়, সেখানে অনেক অপ্রয়োজনীয় নিউজও থাকে৷ এত এত নিউজ যেতে পারলে স্প্যানের নিউজও যেতে পারে৷ এর আর্থিক মূল্যও ১০-১৫ কোটি টাকার কাছাকাছি৷ আর্থিক দিক বিবেচনায়ও নিউজ মূল্য আছে৷ আবার এটার গুরুত্ব বিবেচনায়ও নিউজ মূল্য আছে৷’’

এই কাভারেজ প্রসঙ্গে রাতিন রহমান নামে একজন পাঠক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ঠিক যে এক্সট্রিম বিরোধিতা আর চরম সব সংকট পেরিয়ে এই সেতু হার না মানা, অদম্য একটা ভিজ্যুয়াল তৈরি করে দাঁড়িয়েছে, সেটাকে যথাযথ কমপ্লিমেন্ট করে তুলে আনতে পেরেছে গণমাধ্যম৷ অবশ্যই তাদের একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য৷’’

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আশিক রনো ফেইসবুকে লিখেছেন, দারুণ কাভারেজ ছিল, সেইসাথে ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশও জাতির সামনে তুলে ধরেছিল মিডিয়াগুলো৷

রেকর্ড কাভারেজ

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন মূল পত্রিকার উপরে চার পৃষ্ঠার অতিরিক্ত মলাট ছেপেছে প্রথম আলো৷ এর পুরোটাই ছিল একটি সিমেন্ট কোম্পানির বিজ্ঞাপন৷

‘আজি দখিন দুয়ার খোলা’ শিরোনামে মূল পত্রিকায় লিড হিসাবে ছাপা হয়েছে আনিসুল হকের একটি লেখা৷ ‘দেশের টাকায় দেশের সেতু' শিরোনামে প্রথম ফোল্ডে তিন কলামে সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনের একটি প্রতিবেদন রয়েছে৷ এছাড়া ৩, ৭, ৮, ৯, ১২ এবং শেষের পৃষ্ঠায়ও রয়েছে প্রতিবেদন, গ্রাফিক্স, ছবি, সাক্ষাৎকার৷ এর বাইরে রয়েছে ১৬ পৃষ্ঠার বিশেষ ক্রোড়পত্র৷

উদ্বোধনের পরদিনও মূল মলাটের উপরে অতিরিক্ত মলাট ছিল৷ ‘পদ্মার দুই পাড়ে নতুন ভোর' শিরোনামে ছিল ছয় কলাম লিড৷ এদিন ছয় কলামে শিবচরে প্রধানমন্ত্রীর জনসভার ছবি ছেপেছে পত্রিকাটি৷ ‘যারা বাধা দিয়েছিল, জবাব দিয়েছি', ‘স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার সকালটিতে'—শিরোনামে আরো দুটি প্রতিবেদন রয়েছে প্রথম পাতায়৷ রয়েছে আরো একটি ছবি৷

পদ্মা সেতুর বাইরে অন্য ইস্যুতে প্রথম পৃষ্ঠায় এক কলাম করে তিনটি খবর ছাপা হয়েছে৷ বরাদ্দ ছিল দ্বিতীয় পাতাও৷ শেষের পাতায়ও অন্য খবরের সাথে ছিল পদ্মার খবর৷ ‘দক্ষিণের পথে স্বস্তির যাত্রা'- শিরোনামে ২৭ জুন তিন কলামে ছবিসহ লিড ছেপেছে পত্রিকাটি৷ ‘আসতে সাড়ে ৯, যেতে ৩ ঘণ্টা'—শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠাতেই রয়েছে আরেকটি খবর৷

‘পদ্মা সেতুতে ট্রেন আগামী জুনে' শিরোনামে তিন কলামে লিড ছেপেছে ২৮জুন৷ ২৯ জুন পদ্মা সেতুর কাভারেজ থেকে বেরিয়ে এসেছে পত্রিকাটি৷ এদিন এই সেতুতে মোটর সাইকেল চলাচল নিয়ে এক কলামের একটা স্টোরি ছাড়া প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠায় পদ্মা সম্পর্কিত আর কিছু ছিল না৷

তবে প্রথম আলোতে পদ্মা সেতু নিয়ে কাভারেজ শুরু ১ জুন থেকে কাউন্ট ডাউনের মাধ্যমে৷ প্রতিদিনই প্রথম পাতায় একটি করে খবর থাকতো পদ্মা সেতু নিয়ে৷ ‘পদ্মা সেতুর আদ্যোপান্ত' নামে আরেকটি ধারাবাহিক ছেপেছে পত্রিকাটি৷ ২৪ জুন নবম পর্ব ছাপা হয়েছিল এটি৷ এছাড়াও অতিরিক্ত মলাট ছিল ২২, ২৩, ২৪ জুনও৷ পাশাপাশি ২৩, ২৪ তারিখেও প্রধান লিড ছিল পদ্মাকে নিয়েই৷

প্রথম আলো এক সময় পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগকে জোরেশোরে তুলে এনেছিল বলে অনেকে এখনো বলে থাকেন৷ সেই প্রথম আলোতে কাভারেজে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ‘সরকার সমর্থক' অনেক ব্যক্তি৷ বিশেষত এবারের কাভারেজের মধ্যে ‘প্রশংসা' দেখেছেন অনেকে৷ উদ্বোধনের দিন সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী নিশীতা ইকবাল নদী ফেইসবুকে লিখেন, ‘‘প্রথম আলোর কী হইসে আজকে?'' ছাত্রলীগের আরেক সাবেক নেত্রী আফরিন নুসরাত প্রথম আলোর একটি স্টোরির স্ক্রিনশট দিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘আই অ্যাম কনফিউজড অ্যাবাউট প্রথম আলো৷ একের পর এক পদ্মা সেতু নিয়ে প্রশংসা করেই যাচ্ছে৷''

তবে প্রথম আলোর কাভারেজের মূল চিত্র বুঝতে দেখতে হবে অনলাইন এবং তাদের সামাজিক মাধ্যমও৷ সেতু উদ্বোধনের আগের দিন ২৪ জুন প্রথম আলোর অনলাইনে পদ্মা সেতু বা এর প্রভাব সম্পর্কিত ৫০টি টেক্সট বা ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে৷ উদ্বোধনের দিন এই সংখ্যা পৌঁছায় ৬১টিতে৷ পরে ২৬ জুন ৩২টি, ২৭জুন ২৬টি, ২৮ জুন ২২টি, ২৯ জুন ১৫টি, ৩০ জুন ১৩টি প্রতিবেদন বা ভিডিও প্রকাশিত হয় তাদের অনলাইনে৷

পদ্মা সেতু নিয়ে সংসদের আলোচনা, নানা এলাকায় এই সেতুর প্রভাব নিয়ে করা প্রতিবেদনের মতো খবরগুলোকেও এই হিসাবে ধরা হয়েছে৷

পিছিয়ে ছিল না অন্য গণমাধ্যমগুলোও৷ পদ্মা সেতু এবং পদ্মা সেতু সম্পর্কিত খবর নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম তাদের বাংলা সংস্করণে ২৪ জুন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৭দিনে মোট ১৪১ টি টেক্সট, ছবিঘর, ভিডিও প্রকাশ করেছে৷

পদ্মার নানা স্পট থেকে নিয়মিত লাইভ প্রচার করেছে টিভি চ্যানেলগুলো৷ এছাড়া বুলেটিনেরও বড় একটা অংশ জুড়ে ছিল পদ্মার কাভারেজ৷ টেক্সট নিউজের পাশাপাশি অনলাইনগুলোও লাইভ করেছে৷ ভিডিও স্টোরি করেছে৷ সাংবাদিক এহসান জুয়েল বলেন, ‘‘উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে ঘিরে অনেক টিভি ৪০-৫০জনের টিম নিয়ে পদ্মা পাড়ে অস্থায়ী ক্যাম্প করে এটা কাভার করেছে৷’’ দেশের প্রথম বিজনেস টিভি ‘এখন টিভি'র কাভারেজ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘উদ্বোধনের আগেরদিন বিকাল তিনটা থেকে উদ্বোধনের পরেরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত আমরা অস্থায়ী স্টুডিও থেকে ২৮টা টকশো করেছি৷’’ 

‘‘যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, কৃষি অর্থনীতিবিদ, পর্যটন বিশেষজ্ঞ, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ-এরকম বিশেষজ্ঞদের আমরা নিয়ে গিয়েছিলাম৷ পদ্মা সেতুকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে এই শো করা হয়েছে৷” এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘অভিজ্ঞতার ঘাটতি থেকে কিছু কিছু জায়গায় অতিরঞ্জিত হয়েছে৷ সবাই যে পেশাদারিত্বের সাথে করেছে, বিষয়টা তা নয়৷ সেটা হয়ত অভিজ্ঞতার অভাবে৷ এখান থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে ভবিষ্যতে আরো কাভার হবে৷ গণমাধ্যমগুলো আরো বেশি পেশাদারিত্বের পরিচয় দেবে৷”

‘‘তবে এটা ঠিক, ভালোর কোনো শেষ নেই৷”

কী এসেছে খবরে, কী আসেনি

খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, উদ্বোধন এবং পরের দিনগুলোতে সেতুকে ঘিরে ঘটনা প্রবাহ, মানুষের প্রতিক্রিয়া, আবেগ-উচ্ছ্বাস, যানজট, পারাপারের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি বিষয় উঠে এসেছে৷ পদ্মা সেতু সম্পর্কিত নানা তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন দেখা গেছে আগের দিনগুলোতে৷ কলাম, টক শো ও প্রতিবেদনের বড় আরেকটা উপজীব্য ছিল পদ্মা সেতুর প্রভাব সম্পর্কিত৷

পদ্মা সেতু ইস্যু কাভার করা সাংবাদিক আলী আসিফ শাওন বলেন, ‘‘উৎসব উচ্ছ্বাসটাই এসেছে৷ ক্রিটিক্যাল জার্নালিজমের অনুপস্থিতি দেখা গেছে৷ বিশেষ করে যে প্রশ্নগুলো এসেছে, পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়, এগুলো কোনো কারণে সেইভাবে আসেননি৷ আমরা মূলত উৎসব-উচ্ছ্বাসের নিউজই দেখেছি৷’’

দৈনিক মানবজমিন-এর প্রধান বার্তা সম্পাদক সাজেদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অর্থনৈতিক এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর ঐতিহাসিক তাৎপর্য এবং গুরুত্বের দিক থেকে রিপোর্টিং/মতামত/নানা লেখা অসাধারণ হয়েছে৷ তবে রাজনীতিতে এ সেতুর ভূমিকা কী হতে পারে-তা নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি৷ যেমন এ সেতু ২১টি জেলায় তথা দেশে সরকারি দলের ভোট বাড়াবে কিনা? এ সেতুর মাধ্যমে ভোটের কোনো ক্যাম্পেইন শুরু হলো কিনা, এ সেতু দেশকে অবাধ নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাবে কিনা, অথবা এ সেতু নির্বাচনের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে কিনা ইত্যকার প্রসঙ্গ৷”

গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পদ্মা সেতু নিয়ে আরো অনেক ইন্টারেস্টিং রিপোর্ট করা যেতো৷ যে রিপোর্টগুলো করা হয়েছে, বেশিরভাগেরই সংবাদমূল্য নেই৷ কিন্তু সেগুলো যেহেতু নিউজ হচ্ছে টিভিতে, আমরা এগুলো নিউজ বলতে বাধ্য হই৷ স্ট্যান্ডার্ড সাংবাদিকতার ভ্যালুর দিক থেকে দেখলে এগুলো কোনকিছুই নিউজ না৷'' ‘‘বরং যেগুলো নিউজ হওয়ার উপযুক্ত ছিল, সেগুলো কিন্তু নিউজ হয় নাই৷ যে কোনো সেতু বা যে কোনো বাঁধ, একদিকে যেমন যোগাযোগে সুবিধা করে দেবে, অপর দিকে সেটা বন্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দেবে৷ এই প্রসঙ্গে আমি একটাও নিউজ দেখিনি৷ যে মানুষেরা ডিসপ্লেসড হলো, তাদের কোনো গ্রিভেন্স আছে কিনা, সেটা নিয়ে কোন রিপোর্ট আমি দেখিনি৷ কোথাও কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে কিনা, সেটাও আমি দেখিনি৷”

 ‘‘সরকার নিজেদের প্রশংসার জন্য যে বিষয়গুলো বলেছে, যেমন নিজেদের অর্থায়ন, এগুলো নিয়ে সাংবাদিকতার চর্চায় ক্রিটিসিজমের ঘাটতি আমি দেখেছি৷”

‘এটাকে পারভার্স কাভারেজ বলা যেতে পারে’

This browser does not support the audio element.

পেছনে আছে বিজ্ঞাপনের গল্পও

পদ্মা সেতু নিয়ে এই ব্যাপক কাভারেজে বিজ্ঞাপনের প্রভাবও রয়েছে৷ বিজ্ঞাপনদাতারা যেন হাত খুলেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এই ইভেন্টের নানা খবরের সাথে নিজেদের প্রতিষ্ঠান বা পণ্যকে ব্র্যান্ডিং করতে৷ বিজ্ঞাপনের এই বাজার সম্পর্কে অবশ্য জনপরিসরে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে খুব বেশি তথ্য নেই৷ পদ্মা সেতুর কাভারেজের সাথে বিজ্ঞাপনদাতাদের ভূমিকার কথা উঠে এসেছে প্রথম আলো সম্পাদকের পুরোনো এক লেখায়৷ ইন্টারন্যাশনাল নিউজ মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন (ইনমা)-র ওয়েবসাইটে ২০২১ সালে প্রকাশিত হয় সেই লেখা৷ এতে বলা হয়, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যান যুক্ত হওয়ার সময়কে সামনে রেখে প্রথম আলো একটি ক্যাম্পেইনের সূচনা করে, যার নাম দেয়া হয়, ‘দ্য সিক্স পয়েন্ট ওয়ান ফাইভ কিলোমিটার্স অব হোপ ক্যাম্পেইন'৷

‘‘সব প্ল্যাটফর্মের কনটেন্ট দিয়ে সাজানো হয় এই ক্যাম্পেইন৷ কনটেন্ট ডিজাইনের সময় ডিজিটাল অ্যাডভার্টাইজারদের কথাও মাথায় রাখা হয়৷ বিষয়টা এমনভাবে সাজানো হয় যেন, প্রথম আলোর পদ্মা সেতু সম্পর্কিত খবরে ব্র্যান্ডগুলো তাদের ব্র্যান্ড ভ্যালুতে ‘পজিটিভ ইমপ্যাক্ট' পেতে পারে৷''

ক্যাম্পেইন শুরুর পূর্বে এমন কৌশল নেয়া হয়, যাতে প্রিমিয়াম অ্যাডের সম্ভাব্য ক্রেতা ইন্ডাস্ট্রির বিগ প্লেয়াররা এখানে যুক্ত হতে পারে৷ ক্যাম্পেইনে বড় অ্যাড পুল তৈরি করতে মধ্যম-ছোট বিজ্ঞাপন দাতাদের জন্যও পর্যাপ্ত কনটেন্ট তৈরি করা হয়৷ সব বিজ্ঞাপন এক সপ্তাহের মধ্যে বেচে দেয় প্রথম আলোর সেলস টিম৷ শাহ সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বিএসআরএম স্টিল, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, হোলসিম, কেএসআএম, নতুনধারা, নিক্কি থাই অ্যালুমিনিয়াম, ফ্রেশ সিমেন্টসহ আরো অনেকে ছিল এসব বিজ্ঞাপনের ক্রেতা৷

বিজ্ঞাপন ক্রেতাদের একটি সাধারণ বিষয় উল্লেখ করেন মতিউর রহমান৷ তিনি বলেন, এসব কোম্পানি নানা নির্মাণ সামগ্রীর উৎপাদক৷

২০২০ সালের ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরে চলা পদ্মা সেতু সম্পর্কিত খবরের মাধ্যমে চলা এই ক্যাম্পেইন দিয়ে প্রথম আলো তার রেভিনিউ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে বলেও উল্লেখ করেন পত্রিকাটির সম্পাদক৷ এতে বলা হয়, ভিডিও, ডিজিটালের পাশাপাশি পত্রিকার জ্যাকেট, ফ্রন্ট পেজ, ইনার পেজ, ব্যাক পেজের জায়গা পেতে বিজ্ঞাপনদাতা কাড়াকাড়ি লাগিয়ে দেয়৷

এই লেখা যাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়, সেই ইন্টারন্যাশনাল নিউজ মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন (ইনমা) থেকে সম্প্রতি প্রথম আলো দুটি পুরস্কার পায়৷ সেই খবর তারা ব্যাপক আয়োজন করে প্রচারও করেছে৷ দুটি পুরস্কারের একটি ছিল ‘বেস্ট আইডিয়া টু গ্রো অ্যাডভার্টাইজিং সেলস' ক্যাটাগরিতে৷ এখানে প্রথম আলো দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে৷ তবে ২০২০ সালের সেই ক্যাম্পেইন প্রথম আলোর এবারের ‘ক্যাম্পেইনের' তুলনায় একেবারের ছোট৷ পদ্মা সেতু উপলক্ষ্যে এরকম কাভারেজ দেখা গেছে প্রায় সকল গণমাধ্যমে৷

সাংবাদিক আলী আসিফ শাওন মনে করেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনের বাজারে এক ধরনের টানাপোড়েন রয়েছে৷ পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে  ভিজ্যুয়াল-প্রিন্টসহ সব মিডিয়ায় বিশেষ আয়োজন দেখা গেছে৷ ‘‘টিভি ও পত্রিকাগুলোতে স্পন্সর্ড স্টোরি ছিল৷ পদ্মা সেতু উপলক্ষ্যে প্রথম আলো যতগুলো ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট তৈরি করেছে, সবগুলো ছিল একটি সিমেন্ট কোম্পানির স্পন্সর্ড কনটেন্ট৷”

‘‘নতুন এই আর্থিক সংস্থান পদ্মা সেতু উপলক্ষ্যেই পেয়েছে গণমাধ্যম৷ আমি বলবো, নয়ত কয়েকশ কোটি টাকার এই বাজার গণমাধ্যমের কাছে আসতো না৷”

‘বিজ্ঞাপন দাতারা ইতিবাচক খবরের সাথেই থাকতে চান’

ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় পড়াশোনা শেষ করে সাংবাদিক হিসাবেই ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ইয়াসীন পাভেল৷ এখন নিউজ টোয়েন্টিফোরের মার্কেটিং ইনচার্জ হিসাবে কাজ করছেন৷ তিনিও বলছেন, বিজ্ঞাপনদাতারা ইতিবাচক খবরের সাথে থাকতে চান৷ নিজেদের টার্গেট অডিয়েন্সের সাথে থাকতে চান৷ দৃষ্টান্ত হিসাবে তিনি পদ্মা সেতুর প্রসঙ্গ টেনে বলেন, পদ্মা ব্রিজে যারা বিজ্ঞাপন দিয়েছে, ম্যাক্সিমাম কিন্তু সিমেন্ট কোম্পানি৷ কারণ, পদ্মা ব্রিজের সাথে সিমেন্ট কোম্পানির একটা সম্পর্ক রয়েছে৷ এভাবেই তারা ক্যাম্পেইন করেছে৷ তার মতে, টার্গেট অডিয়েন্সের সাথে থাকার চেষ্টা ব্র্যান্ড ম্যানেজাররা সব সময়েই করে এসেছে৷

‘বিজ্ঞাপনদাতারা বলে দেন নেগেটিভ নিউজে ব্র্যান্ডিং যাবে না’

This browser does not support the audio element.

তিনি বলেন, ‘‘একদিকে যেমন চ্যানেল বেড়েছে, অন্যদিকে গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও টার্গেটেড অডিয়েন্স নিয়ে এখন কাজ করছে৷’’

এক সময় বিজ্ঞাপন প্রকাশের মাধ্যম ছিল কেবল পত্রিকা৷ পরে আস্তে আস্তে রেডিও, টিভি আসে৷ এরপর অনলাইন সংবাদপত্রের পাশাপাশি ফেসবুক, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্ম এই খাতকে নাড়িয়ে দিয়েছে৷

যে কোনো ব্যক্তি একটি ফেসবুক পেজ বা ইউটিউব চ্যানেল খুলে বিজ্ঞাপন পেতে পারেন৷ এসব ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনদাতা অডিয়েন্স টার্গেট করে বিজ্ঞাপন দেন বা কোনো কনটেন্ট ক্রিয়েটরকে স্পন্সর করেন৷ বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের প্রভাষক মো. এনায়েত চৌধুরীও বাংলাদেশের পরিচিত একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর৷ তিনি বলেন, ব্র্যান্ড কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের সাথে নানাভাবে কাজ করে৷ তার মতে, কখনো নিজেরাই তাদের প্রোডাক্টের সাথে মিল রেখে কনটেন্ট ক্রিয়েটর খুঁজে নেন৷ কখনো কখনো তারা এর জন্য বিজ্ঞাপনী সংস্থাকেও দায়িত্ব দেন৷

ভিডিওর আধেয়ও নানাভাবে ঠিক হয়৷ তিনি জানান, যেমন, কখনো মূল কনসেপ্টটা বলে দেন বিজ্ঞাপনদাতারা৷ ক্রিয়েটর নিজের মতো করে বাকি বিষয় ঠিক করে৷ কখনো স্পন্সরের নাম ছোট করে বলে দিলেই হয়৷ কখনো টিভি অ্যাডের মতো করে অ্যাড যায়৷ আবার কখনো পুরোটাই ঠিক করে দেয় স্পন্সর৷ তখন পেমেন্টটা সাধারণত বেশি হয়৷

অনেকের মতে, কনটেন্ট ক্রিয়েশন ও অ্যাডভারটাইজমেন্টের এই সুযোগ সৃষ্টির হওয়ার পর বিজ্ঞাপনদাতারা এখন প্রায় সবক্ষেত্রেই আরো বেশি কনটেন্ট নিয়ে ভাবেন এবং ‘পিক অ্যান্ড চুজ' করেন৷ ইয়াসীন পাভেলের মতে, অনেক বিজ্ঞাপনদাতারা বলেই দেন যে, নেগেটিভ নিউজের সাথে তাদের ব্র্যান্ডিং করা যাবে না৷ কেবল ইতিবাচক খবরের সাথে থাকতে এমন স্পন্সর বহু রয়েছে বলে মত এনায়েত চৌধুরীরও৷ খবর তো সমালোচনামূলক হতে পারে, নেতিবাচক বিষয় নিয়ে হতে পারে, তাহলে সেখানে কি বিজ্ঞাপন থাকবে না- এমন প্রশ্নে ইয়াসীন পাভেল বলেন, দৈনিক পত্রিকার ক্ষেত্রে কেউ প্রথম পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন দিলো সেখানে তো নেতিবাচক খবরও থাকতে পারে৷ এক্ষেত্রে কারোরই করার কিছু নেই৷

তবে সাংবাদিক আলী আসিফ শাওন মনে করেন, স্পন্সর্ড কনটেন্টের বাইরে ক্রিটিক্যাল জার্নালিজমটা করতে হয়৷ কারণ, সব কনটেন্টতো স্পন্সর্ড হয় না৷

‘বিকৃত কাভারেজ’

গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেছেন, বাংলাদেশে এমন ব্যক্তিদের একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন (আ-আল মামুন)৷ পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘিরে গণমাধ্যমের কাভারেজ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, তখন একটা প্রবল বন্যা চলছিল৷ সিলেট-সুনামগঞ্জ ডুবে আছে এবং উত্তরবঙ্গেও বন্যা বেশ প্রবল হয়ে উঠেছে৷ এই সময় পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয়েছে৷ ‘‘উদ্বোধনের আগে, উদ্বোধনের দিন এবং পরে মূলধারার গণমাধ্যমে যে পরিমাণ কাভারেজ দেয়া হয়েছে, এটা কেবল অতিরিক্ত কাভারেজ নয়, এটাকে পারভার্স কাভারেজ বলা যেতে পারে৷ খুবই অস্বাভাবিক কাভারেজ দেয়া হয়েছে৷”

‘‘উদ্বোধনের দিন ব্যতিক্রমহীনভাবে ঢাকার সব পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ হয়েছে৷ এটা খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার না, একটা সেতু উদ্বোধন হচ্ছে, সেটার জন্য ক্রোড়পত্র প্রকাশ হচ্ছে৷ এমন কোন আসপেক্ট নাই, যেটা রিপোর্ট করা হয় নাই৷ এটা খুবই অবিশ্বাস্য৷”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারণ হলো মিডিয়ার কাঠামো, তার রিপোর্টিংয়ের নীতি নৈতিকতা, যে ভারসাম্য রক্ষা করবে, সেটা আজকের সময়ে থাকছে না৷ কিছু কিছু মিডিয়াকে ফোর্স করা হয় রিপোর্ট করতে৷ এখন প্রেশারটা মাত্রাতিরিক্ত৷ একদিকে ওউনারশিপের স্ট্রাকচারের সাথে গভর্মেন্টের স্ট্রাকচার একাকার হয়ে গেছে৷ তার সাথে কর্পোরেট ইন্টারেস্ট যুক্ত হয়েছে৷ এই তিন স্ট্রাকচার মিলে যেটা হয়েছে, নিউজ একটা সেলেবল আইটেম বলে আমরা ভাবতাম-সেটাও আর ভাবার সুযোগ নাই৷ নিউজ এখন হাতিয়ার, নিউজ এখন অন্যকিছু৷ যে কারণে মিডিয়াগুলো একটা বিকৃতির দিকে যাত্রা শুরু করেছে৷

‘‘বর্তমান সরকারের বড় একটা অর্জন নিশ্চয়ই৷ পদ্মা সেতু বাংলাদেশের ওয়ান অব দ্য বিগেস্ট প্রজেক্টস৷ এটা ঢাকার সাথে দক্ষিণ বঙ্গকে যুক্ত করেছে৷ জনগণের জন্য যোগাযোগে সময় কমবে৷ এটা যুক্তিকর৷ কিন্তু সরকারের যে ফোকাস, সেই ফোকাসের তাৎপর্য কী, সেটাও আমাদের ভাবতে হবে৷”

‘‘বন্যার কাভারেজটা অতটাই সামান্য ছিল৷ একটা মেজর টিভিতে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের চারদিন আগে তাদের সন্ধ্যার বুলেটিনে প্রথম ১৫ মিনিট গেল পদ্মা সেতু কাভারেজে৷ তার পর বন্যার খবর থাকলো মাত্র ৫ মিনিট৷ এটাতো একটা অস্বাভাবিক কাভারেজ৷”

‘‘সাংবাদিকতার কোন রকমের মোরালসের মধ্যেই আসলে এ ধরনের চর্চা পড়তে পারে না৷”

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ