বৃহস্পতিবার ৪১তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে ৬.১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর এখন পুরোটাই দৃশ্যমান৷ এখন বাকি রেল সংযোগ৷ মানুষের আগ্রহ আর প্রশ্ন, কবে এই সেতু দিয়ে পার হওয়া যাবে? এই সেতু অর্থনীতি আর যোগাযোগে কী ভূমিকা রাখবে৷
বিজ্ঞাপন
সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, রেল সংযোগসহ আরো যে কাজ বাকি আছে তাতে কমপক্ষে ১০ মাস সময় লাগবে৷ তবে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম জানান, ‘‘২০২১ সালে পদ্মা সেতু চালুর সম্ভাবনা নেই৷ আমরা ছয় মাস পিছিয়ে আছি৷ ২০২০ সালের জুনের মধ্যে আমাদের আজকের অবস্থানে আসার কথা ছিলো কিন্তু সেই কাজ আমরা ছয় মাস পরে করেছি৷ ঠিক সময়ে কাজ শেষ করে ২০২০ সালের জুনে আমরা পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার কথা বলেছিলাম৷ কিন্তু সেটা আর হচ্ছে৷ আরো বেশ কিছু কাজ বাকি আছে৷’’
তিনি জানান, রেল কবে চালু হবে তা বলা যাচ্ছেনা৷ সেতুর সাথে রেল লাইন এক সঙ্গেই করা হবে৷ কিন্তু সেতুর দুই পাশে তো রেল লাইন লাগবে৷
শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা সেতুর পরবর্তী কাজ নিয়ে ঠিকাদারদের সঙ্গে বসে এক মাস পরে জানাতে পারব আসলে ঠিক কবে পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দিতে পারব৷ দুই পাশে রেল লাইন স্থাপনের জন্য সেতু খুলে দেয়া আটকে থাকবে না৷’’
২০২১ সালে পদ্মা সেতু চালুর সম্ভাবনা নেই: পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম
মূল সেতুর যেসব কাজ এখনো বাকি আছে তার মধ্যে রয়েছে রোডওয়ে স্ল্যাব, রেলওয়ে স্ল্যাব, সুপার-টি গার্ডার বসানো৷ স্ল্যাবের ওপর পিচ ঢালাইয়ের কাজ, আলোকসজ্জা, ল্যাম্পপোস্ট বসানোর প্রভৃতি৷
কংক্রিট আর স্টিলের তৈরি এই সেতুর নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন এবং ওপর দিয়ে যানবাহন৷ ফলে সেতুর আকৃতি হবে দোতলা৷ তিন বছর দুই মাস ১০ দিনে পদ্মা সেতুর ৪১টি পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যান বসানো হলো৷ আর এই প্রকল্পের প্রাথমিক যে খরচ ধরা হয়েছিল তার চেয়ে খরচ বেড়েছে তিন গুণ৷ সেতুর মোট বাজেট এখন ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা৷ বিশ্বব্যাংক ও উন্নয়ন সহযোগীরা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ঋণ প্রত্যাহার করে নিলে বাংলাদেশের নিজম্ব অর্থায়নেই এই সেতু হচ্ছে৷ সেতুর কাজে এপর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ১১৫ দশমিক শুণ্য দুই কোটি টাকা৷ কাজ শেষ হয়েছে শতকরা ৮২ ভাগের একটু বেশি৷
পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা সরাসরি সড়ক পথে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সঙ্গে যুক্ত হবে৷ আসবে রেল যোগাযোগের আওতায় ৷ চার কোটিরও বেশি মানুষ সরাসরি এর সুবিধা পাবে৷ আর দেশের অর্থনীতিতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে৷ বিশ্বব্যাংক বলেছিল, সেতু হলে জিডিপিতে দুই ভাগ বাড়তি প্রবৃদ্ধি হবে৷ কিন্তু সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, ‘‘সেতুর খরচ বেড়ে যাওয়ায় সেটা নাও হতে পারে৷ তবে অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে৷ এখন দক্ষিণাঞ্চল কানেকটিভিটির আওতায় আসায় ইকোনোমিক জোন গড়ে উঠবে৷ কারণ গ্যাস ও বন্দর সুবিধা আছে৷’’ তিনি বলেন, ‘‘নতুন নতুন সমস্যার কারণে ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে৷ বিশ্বব্যাংকের সাথে জটিলতার কারণে সময়ক্ষেপণ হয়েছে৷ নদী শাসনের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছিল, কোভিড আরেকটি সমস্যা৷ আমাদের কাছে মনে হয়েছে তারপরও ব্যয় আরো একটু যৌক্তিক করার সুযোগ ছিলো৷ কিন্তু এখন এটা যত দ্রুত খুলে দেয়া যায় ততই ভাল৷’’
অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে: অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
তিনি মনে করেন এই সেতুর কারণে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে৷ এশিয়ান দেশগুলো যারা পায়রা এবং মংলা বন্দর ব্যবহার করতে চান তারা ব্যবহার করতে পারবেন৷ এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে এই সেতু যা আঞ্চলিক যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে৷
সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (এমবিইসি) ৷ নদী শাসনের কাজ করেছে চীনেরই আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো কর্পোরেশন৷
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ বলেন, ‘‘পদ্মা সেতু কোনো জটিল ডিজাইনের ব্রিজ নয়৷ সিম্পল স্প্যান ট্রাস্ট ব্রিজ৷ এটা সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের আগে থেকেই জ্ঞান আছে৷ এটা এখানে পড়ানোও হয়৷ কিন্তু এর বিশেষত্ব হলো বিশালতা৷ আমাদের টেকনোলজি ছিলো না৷ যা আনতে হয়েছে৷ আর নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় টেকনোলজির ট্রান্সফার হয়েছে৷ বিদেশি অর্থায়নে হলে এটা সম্ভব ছিল না৷ এটা আমাদের সেতুর বাইরেও বড় আরেকটি লাভ হয়েছে৷ ভবিষ্যতে আমােেদর প্রকৌশলীরা নিজেরাই এ ধরনের সেতু বানাতে পারবেন৷’’
তার মতে, ‘‘খরস্রোতা নদী ও পলিমাটির কারণে এই সেতুর একমাত্র চ্যালেঞ্জ ছিলো এর ফাউন্ডেশন৷ এই সেতু শত বছরেও ব্যবহার উপযোগী থাকবে৷’’
২২ নভেম্বরের ছবিঘরটি দেখুন...
পদ্মা সেতুর জানা-অজানা
দক্ষিণবঙ্গের মানুষকে রাজধানীর সাথে যুক্ত করবে, গতি আনবে অর্থনীতির- এক যুগ আগে এমন স্বপ্ন নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ৷ দিন যায়, বছর গড়ায়, সেই সাথে বাড়ে নির্মাণ ব্যয়...
ছবি: bdnews24.com
যেখান থেকে শুরু
১৯৯৮-১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণের ফিজিবিলিটি স্টাডি বা সম্ভাব্যতা যাচাই করে৷ পরে ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগ পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেয়৷
ছবি: bdnews24.com
সহযোগীদের আশ্বাস
পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে বিশ্বব্যাংক৷ ২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকারের সাথে ১২০ কোটি ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করে সংস্থাটি৷ জাপান সরকারের দাতা সংস্থা জাইকা ৪০ কোটি , এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক ৬৪ কোটি এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ১৪ কোটি ডলারের সহায়তা দেবে বলেও চুক্তি স্বাক্ষর করে৷
ছবি: DW
দুর্নীতির অভিযোগ, সরে গেল দাতারা
ক্যানাডার এসএনসি লাভালিন কোম্পানি পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ পায়৷ কিন্তু ক্যানাডার আদালতে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ উঠলে দাতা সংস্থাগুলো প্রকল্প অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায়৷
ছবি: imago/Rainer Unkel
আঙুল নোবেল বিজয়ীর দিকে
অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে গেলে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুসের দিকে আঙুল তোলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেউ কেউ৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ বিষয়ে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘‘পদ্মা সেতু ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আমাদের দেশের একজন নোবেলজয়ী জড়িত৷’’
ছবি: Getty Images/S. Vlasic
যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগ
সেতুর কাজ নিয়ে দূর্নীতির অভিযোগ উঠার পর সরকার সে সময়ের যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়৷ কিন্তু সমালোচনার মুখে সেখান থেকেও পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
দূর্নীতির অভিযোগ খারিজ
প্রায় পাঁচ বছর তদন্তের পর দুর্নীতির অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি ক্যানাডার আদালত৷ এ অভিযোগকে আদালত ‘অনুমানভিত্তিক, গালগল্প ও গুজব’ বলে আখ্যায়িত করে৷
ছবি: picture-alliance/empics/P. Chiasson
নিজস্ব অর্থায়নে তৈরির ঘোষণা
বিশ্ব ব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থা প্রকল্প থেকে সরে গেলে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি হবে এমন ঘোষণা দেয় সরকার৷
ছবি: bdnews24.com
অবশেষে শুরু হলো কাজ
দীর্ঘ প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে অবশেষে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন৷ এ কাজের দায়িত্ব পায় চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিংকন্সট্রাকশন কোম্পানি৷ ২০১৮ সালের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা নিয়ে শুরু হয় কাজ৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
কাজ পেছালো
প্রথম দফায় ডিসেম্বর ২০১৫ সালে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা থাকলেও প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়৷ নদীশাসন, নকশায় পরিবর্তন আনাসহ নানা কারণে আবারো প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়৷ এবার ২০২১ সালের জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা বলা হয়৷ এদিকে করোনার কারণে কাজের ধীরগতি প্রকল্পকে আবারো পিছিয়ে দিচ্ছে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের৷
ছবি: bdnews24.com
ব্যয় বেড়েছে তিনশ’ ভাগ
এক যুগেরও বেশি সময় আগে ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে একনেক-এ পাশ হয় পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প, যার ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার একশ’ ৬২ কোটি টাকা৷ ২০১৮ সালে এ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ত্রিশ হাজার একশ’ ৯৩ কোটি টাকা৷ এক যুগে ব্যয় বাড়লো তিনশ’ ভাগ৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto
বেড়েছে কয়েক দফায়
২০০৭ সালে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদনের পর ২০১১ সালে তা সংশোধন করা হয়৷ প্রকল্পের সংশোধিত ব্যয় ধরা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা ৷ ২০১৬ সালে আরেক সংশোধনীতে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা৷ সর্বশেষ হিসেবে খরচ ধরা হয়েছে ত্রিশ হাজার একশ’ ৯৩ কোটি টাকা৷
ছবি: bdnews24.com
কেন বাড়ছে ব্যায়?
ব্যয় বাড়ার অন্যতম কারণ হলো নকশায় পরিবর্তন আনা, বলছেন বিশেষজ্ঞরা৷ প্রকল্পের শুরুতেই ত্রুটি ধরা পড়ে নকশায়৷ তাছাড়া নানা সময়ে নতুন পরিকল্পনাও যুক্ত করা হয়েছে৷ নদীশাসনে ধীরগতিও ব্যয় বাড়ার অন্যতম কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷
ছবি: bdnews24.com
কাজ এগিয়েছে যতদূর
গত বছর ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে পদ্মা সেতুর ৪১তম স্প্যানটি বসানো হয়৷ আর দৃশ্যমান হয় ছয় হাজার একশ মিটার দৈর্ঘ্যের এ সেতুটি৷ ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম স্প্যানটি বসানোর পর এর শেষ স্প্যানটি বসানো পর্যন্ত সময় লেগেছে তিন বছর৷