প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে ‘ইসলামিক স্টেট’ ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে একটা সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছে বিশ্ব৷ ইসলাম মানেই জঙ্গিবাদ, ইসলাম মানেই যুদ্ধ – এমন ধারণা উঁকি মারছে যত্রতত্র৷ কিন্তু কোরান কি সত্যি এতটা আগ্রাসী?
বিজ্ঞাপন
আসন্ন মার্কিন নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প তো বলেই দিলেন, ‘‘অ্যামেরিকার প্রতি মুসলিমদের বিদ্বেষ এত তীব্র যে তা ‘ধারণারও বাইরে'৷ এই ঘৃণার উৎস কী এবং অ্যামেরিকার জন্য তা কী হুমকি সৃষ্টি করেছে, তা পুরোপুরি বুঝে না ওঠা পর্যন্ত মুসলিমদের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা চালু রাখতে হবে৷''
আচ্ছা, তাহলে পাশ্চাত্য কি সত্যিই মুসলমানদের বাসের অযোগ্য? কোরান আর বাইবেল কি তবে একে অপরের পরিপন্থি? এ প্রশ্ন জেগেছিল পশ্চিমেরই কিছু তরুণের মাথায়৷ যুক্তি-তর্কে না গিয়ে ওরা একটা ‘এক্সপেরিমেন্ট' বা পরীক্ষা করবে বলে স্থির করলো৷
ভিডিওটা দেখলেই বুঝবেন৷ তবে পরীক্ষাটা অনেকটা এ রকম৷ একটি বাইবেল নিয়ে তার ওপর পবিত্র কোরানের মলাট দিয়ে দিলো ওরা৷ তারপর ধর্মগ্রন্থটির যে অংশগুলি পাশ্চাত্যের আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে খাপ খায় না, সেগুলি আলাদা আলাদা করে চিহ্নিত করলো৷ ব্যাস্, ‘হোমওয়ার্ক' শেষ৷ এরপর রাস্তায় গিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে সেই অংশগুলো পড়ে শোনালো ওরা৷ মজার বিষয়, উপস্থিত সকলেই কিন্তু ঐ অংশগুলোকে কোরানের অংশ বলে মেনে নিলেন, এমনকি নারী বিদ্বেষী অংশগুলিও৷ কী লেখা ছিল বইটায়? নারীকে হতে হবে ধীর-স্থির, শান্ত৷ তাকে পুরুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে তাল মানিয়ে চলতে হবে৷ ঔদ্ধত্য নয়, বরং পুরুষের আধিপত্য মেনে নেয়াই নারীর গুণ৷ নারীদের উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন নেই, নারীকে শাসন করতে হবে, প্রয়োজনে তার হাত কেটে ফেলতে হবে৷ আর সমকামিতা? দু'জন পুরুষ যদি যৌন সম্ভোগ করে তবে তাদের হত্যা করা স্রেয়৷
আবারো নতুন প্রশ্ন রাখা হলো৷ আচ্ছা, বাইবেলের সঙ্গে কোরানের পার্থক্য কোথায় বলুন তো? ‘‘কোরান অনেক বেশি আগ্রাসী৷'' ‘‘বাইবেলে নারীকে অনেক বেশি সম্মান দেয়া হয়েছে৷'' ‘‘বাইবেল শান্তির কথা বলে, হিংসার নয়৷''
জীবন, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠানে শুভ-অশুভ শক্তি
‘গুড অ্যান্ড ইভিল পাওয়ার’, শুভ এবং অশুভ শক্তি – তা সে আপনি মানুন আর না মানুন – একে অগ্রাহ্য করার কিন্তু উপায় নেই৷ বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিষ্টান, এমনকি ইসলাম ধর্মেও আমরা অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির জয়ের কথা পাই৷
ছবি: Reuters/S. Pring
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে
শুভ শক্তি থাকুক আর না থাকুক, শুভ বোধ, আদর্শ মানবজীবনকে অবশ্যই সত্য ও সুন্দরের পথ দেখায়৷ আর তাই, এর বিপরীতের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সৃষ্টির সেই আদি কাল থেকে৷ ভূত-প্রেত, আত্মা বা জিন নিয়ে তাই রয়েছে অসংখ্য গল্প, কল্প-কাহিনি আর তার সঙ্গে সঙ্গে অজস্র আচার-অনুষ্ঠান, অন্ধ বিশ্বাস৷
ছবি: Reuters/S. Pring
আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গা
অসুরের অত্যাচার, পাপীদের অনাচার আর অশুভ শক্তির উত্থানে মানবতা যখন ভূলুণ্ঠিত, নিষ্পেষিত, তখন সমস্ত দেবতারা, অর্থাৎ সমস্ত শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা, সব নিপীড়িত-নির্যাতিতরা সংঘবদ্ধ হন৷ তাঁদের আকুল আবেদনেই আবির্ভূতা হন আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গা৷ হিন্দুধর্ম অনুসারে, মহিষাসুর বধের মাধ্যমে শুভ শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন তিনি৷
ছবি: DW/M. Mamun
বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি...
বৌদ্ধ ধর্ম অনুযায়ী, চিন্তা জগতে অশুভ ভাবনার নাম হলো ‘মার’৷ অবশ্য শব্দটি রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা এবং মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্যেও চোখে পড়ে৷ মহাযান বৌদ্ধধর্ম বলে, অশুভ শক্তি ধ্বংস হলে পৃথিবী স্বর্গীয় হয়৷ বুদ্ধদেবের কথায়, ‘‘কাম, ক্ষুধা, পিপাসা থেকে বিরত থাকে ‘মার’-কে দূরে রাখতে পারলে প্রত্যেক জীব ‘বুদ্ধ’ হয়ে উঠতে হতে পারে৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/E. Jones
রূপকথা আর ইতিহাসের পাতায়
এশিয়া বা আফ্রিকার মতো ইউরোপেও অশুভ ও শুভ শক্তি নিয়ে নানা লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে৷ একটা সময় ইউরোপে ‘ডাইনি’-দের পুড়িয়ে মারার চল ছিল৷ আবার রূপকথাগুলিতেও ছিল আশ্চর্য সব জাদুর গন্ধ৷ গ্রিম ভ্রাতৃদ্বয়ের ‘স্নো হোয়াইট’ বা ‘স্লিপিং বিউটি’-তেও আমরা ডাইনি, এঞ্জেল এবং শুভ-অশুভ শক্তির সংঘাতের নজির পাই৷
ছবি: picture-alliance / akg-images
জিন-পরীর অস্তিত্ব
বৌদ্ধ, হিন্দু আর খ্রিষ্টধর্মের পাশাপাশি ইসলামেও রয়েছে জিন-পরীর উল্লেখ, আছে ‘ইবলিশ’ বা শয়তানের কথা৷ এই ‘ইবলিশ’, ‘সিলা’ বা ‘ইফরিত’-রা নাকি সব দুষ্টপ্রকৃতির জিন বা আত্মা, যারা কবরস্থানে থাকে আর যে কোনো আকার ধারণ করতে পারে৷ অবশ্য শুধু অশুভ জিন নয়, আলাদিনের মতো শুভ জিন বা ফেরেশতার কথাও রয়েছে ‘সহস্র এক আরব্য রজনি’ -তে৷
ছবি: Fotolia/ThorstenSchmitt
‘প্রিং কা-এক’ উৎসব
আধুনিক সমাজেও কিন্তু এমন হাজারো আচার-অনুষ্ঠান চোখে পড়ে৷ কম্বোডিয়ার মানুষদের যেমন আজও বিশ্বাস, অশুভ শক্তি অসুখ-বিসুখ নিয়ে আসে, মানুষের ক্ষতি করে৷ তাই ‘প্রিং কা-এক’ উৎসবে সারা গায়ে কালি মেখে, অশুভ আত্মাকে দূর করার কাজে নেমে পড়ে সহজ-সরল গ্রামবাসী৷ উৎসবের শেষ হয় ভূরিভোজ দিয়ে৷
ছবি: Reuters/S. Pring
6 ছবি1 | 6
এখানেই শেষ নয়৷ একজন তো বলে উঠলেন, ‘‘পশ্চিমা বিশ্ব বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী৷ পৃথিবী পালটে গেছে৷ অথচ এখনও এমন কিছু মানুষ আছে, যারা ঐ মান্ধাতা আমলের কিছু লেখাকে ‘শেষ কথা' বলে মেনে আসছে৷ এটা বদলানো দরকার৷ প্রয়োজন একটা সংস্কারের৷''
এবার পরীক্ষার শেষ পর্ব৷ মলাট খুলে ফেলা হতেই বেরিয়ে এলো ভেতরের বাইবেলটি৷ অবিশ্বাস্য, তাই না?
আসলে ইসলাম কথার অর্থ তো ‘শান্তি'৷ তাহলে মানুষের মধ্যে এমন ধারণা, অন্ধবিশ্বাস কোথা থেকে এলো? ‘‘হয়ত এটাও মিডিয়ারই সৃষ্টি'', বললেন একজন৷
বন্ধুরা, আপনার কী মনে হয়? বাইবেল আর কোরান – এই দুটি ধর্মগ্রন্থ কি তাহলে একে অপরের পরিপন্থি নয়?
ধর্মবিশ্বাস, ধর্মান্তর এবং ধর্মের স্বাধীনতা
ডেভিড স্ট্যাং খ্রিষ্টান থেকে মুসলমান হয়েছেন৷ তবে তিনি সালাফিস্টদের উগ্রতা এড়িয়ে চলেন৷ জার্মানিতে অনেকেই মনে করেন, মানবাধিকারগুলোর মধ্যে ধর্মের স্বাধীনতাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ৷এসব নিয়েই আজকের ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কৌতূহল
ডেভিড স্ট্যাংয়ের কৈশোর থেকেই ধর্মের প্রতি বেশ অনুরাগ৷ নিয়মিত গির্জায় যেতেন, বাইবেল পড়তেন৷ তখন সবকিছু বুঝতে পারতেন না৷ অনেক প্রশ্ন জাগতো৷ কিন্তু উত্তর জানা হতো না৷ এখনো মনে আছে, দম্পতিদের নিয়ে একটা প্রশ্ন জেগেছিল, কিন্তু গির্জার পাদ্রী সে প্রশ্নের উত্তর তাঁকে বলেননি৷
ছবি: DW/K. Dahmann
হতাশা এবং মুসলমান হওয়া
একসময় ক্যাথলিক চার্চ, অর্থাৎ ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের গির্জা সম্পর্কে কেমন যেন হতাশ হয়ে পড়লেন ডেভিড স্ট্যাং৷ অন্য ধর্ম সম্পর্কে জানার চেষ্টা শুরু করলেন৷ এক মুসলিম আইনজীবীর সঙ্গে পরিচয় হলো৷ তিনি বললেন, ‘‘ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করো৷’’ তাঁর কথা মেনে একসময় সত্যিই মুসলমান হয়েছেন এবং সেই সুবাদে সবকিছুর নতুন মানেও খুঁজে পেয়েছেন স্ট্যাং৷
ছবি: DW/K. Dahmann
ধর্ম চর্চার দীর্ঘ প্রক্রিয়া
ডেভিড স্ট্যাং মনে করেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার মানে হলো, নতুন করে অনেক কিছু শেখা৷ তিনি জানতেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে মদ্যপান করা এবং শূকরের মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে৷ রাখতে হবে দাড়ি৷ যিনি তাঁকে মুসলমান হতে বলেছিলেন, তিনি এ-ও বলেছিলেন যে, মুসলিম হওয়ার অনুভূতিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাই প্রক্রিয়াটাও অত্যন্ত দীর্ঘ৷
ছবি: DW/K. Dahmann
বিশ্বাসে আপোশ
কাজের সূত্রে ডেভিড স্ট্যাংকে প্রতিদিন হানোফার-বন যাওয়া-আসা করতে হতো৷ দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া সব সময় হয়ে উঠতো না৷ তাই সকাল আর সন্ধ্যার নামাজের সময়টা বাড়িয়ে নিয়েছিলেন৷ তিনি মনে করেন, জীবনের সঙ্গে বিশ্বাসের মেলবন্ধন ঘটানোটাই আসল৷
ছবি: DW/K. Dahmann
উগ্রতা পরিহার
২০১২ সালে উগ্র সালাফিস্টদের সহিংসতা দেখেছেন ডেভিড৷ তারা যেভাবে সন্ত্রাসবাদের পক্ষে যুক্ত দেখায়, তা মানতে পারেননি তিনি৷ সন্ত্রাসবাদীদের মতো ভয় দেখাতে তারা গলার কাছে বোমাও ঠেকায়৷ সালাফিস্ট সম্পর্কে তাঁর একটাই কথা, ‘‘আমি এমন কিছুর সঙ্গে থাকতে চাইনা৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ক্যাথলিক চার্চ ছাড়লেন উটে
উটে লাস-এর জন্ম ক্যাথলিক পরিবারে৷ ধর্মতত্ব নিয়ে পড়াশোনা করতে আগ্রহী ছিলেন৷ কিন্তু ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করতে গেলে কিছু সমস্যাও যে হবে তা তিনি বুঝতেন৷ উটে বুঝতেন, ‘‘ক্যাথলিক থাকলে ধর্মতাত্ত্বিক হয়েও তেমন কিছু করতে পারবো না৷’’ এ সব ভেবে চার্চে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন উটে৷
ছবি: DW/K. Dahmann
অন্তর্দ্বন্দ্ব...
উটের স্বামী প্রটেস্ট্যান্ট হলেন৷ ফলে এবার প্রটেস্ট্যান্টদের গির্জায় যাওয়ার সুযোগ পেলেন উটে৷ তাঁর ছেলেটা সমবয়সিদের সঙ্গে খেলতো৷ ওরও চার্চে যাওয়ার ইচ্ছা৷ কয়্যারে যোগ দিতে চায় সে৷ এ সব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পাঁচ বছর সময় নিয়েছিলেন উটে৷ নারী যাজক আনেগ্রেট কোহেন (বাঁ দিকে) এবং নিনা গুটমান (মাঝে) উটের এ সব অন্তর্দ্বন্দ্ব সমাধানে সহায়তা করেছিলেন৷
ছবি: DW/K. Dahmann
সহনশীলতা
ব্যাপারটিকে উটের বন্ধুরাও খুব ভালোভাবেই নিয়েছিলেন৷ বন্ধুদের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে দীক্ষা নিয়ে চার্চে যাওয়া শুরু করলেন উটে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গির্জায় ভিড় কমছে
কয়েক বছর ধরে জার্মানিতে লোকজনের গির্জায় যাওয়ার প্রবণতা কমছে৷ গির্জার সদস্য বাড়াতে নেয়া হচ্ছে বিশেষ উদ্যোগ৷ বন শহরের ক্যাথলিক তথ্যকেন্দ্র ফিডেস-এ ধর্মের বিষয়ে সবাইকে আগ্রহী করে তোলার কাজটি করেন যাজক টোমাস ব্যার্নার্ড (ডানে)৷
ছবি: DW/K. Dahmann
কারণ কেলেঙ্কারি?
গির্জায় আর আগের মতো বেশি মানুষ আসছে না কেন? অনেকে মনে করেন, সাম্প্রতিক কালে পাদ্রিদের যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়ানোর খবর এক্ষেত্রে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছে৷ যাজক টোমাস ব্যার্নার্ডও এ সম্পর্কে কিছুটা একমত৷ তিনি মনে করেন, এসব খবর বেশি প্রচার করে মিডিয়া বেশ ক্ষতি করেছে৷
ছবি: DW/K. Dahmann
ধর্মের স্বাধীনতা
ধর্মান্তরিত হয়েছেন, এমন অনেকেই মিউনিখ শহরের একটা প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিলেন৷ প্রদর্শনীতে মানবাধিকারের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের স্বাধীনতার কথাও প্রচার করা হয়৷