1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পরকীয়া অপরাধ নয়: সমাজ কি মেনে নিলো?

পায়েল সামন্ত কলকাতা
২ অক্টোবর ২০১৮

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পরকীয়া আর অপরাধ নয়৷ এই রায়ে নতুন বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে৷ অনেকে বলছেন, নারীর অধিকারকে পূর্ণতা দিয়েছে এই রায়৷ কারো মতে, এই স্বাধীনতা আদতে সমাজজীবনে নৈরাজ্য ডেকে আনবে৷

Symbolbild Ehebruch
ছবি: Fotolia/drubig-photo

কবির ভাষায়, ‘‘পৃথিবীতে প্রেম নামে একটা শব্দের চাবি কত দরজা খোলে৷'' কিন্তু তা যদি পরকীয়া প্রেম হয়, তাহলে? সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পরকীয়ার পথটাও এবার প্রশস্ত হয়ে গেল৷ কোর্টের রায় অনুযায়ী, পরকীয়া আর অপরাধ নয়৷ অনেকে স্বাগত জানিয়েছেন এই রায়কে, আবার অনেকে এই রায় নিয়ে খুশি নন৷

পরকীয়া নিয়ে ১৫৮ বছরের পুরোনো ৪৯৭ ধারাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত৷ যে আইন এত বছর আগে তৈরি হয়েছিল, তা তৎকালীন সমাজের প্রতিফলন৷ তাই সমানাধিকারের যুগে দাঁড়িয়ে সেই আইন সমর্থন করার অর্থ নারীকে পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে ধরে নেওয়া৷ কার্যত এই ভিক্টোরিয়ান আইন যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ফসল, তা মনে করে সমাজের একটা অংশ৷ সেই বিতর্কে যাওয়ার আগে দেখে নেওয়া যাক, সুপ্রিম কোর্ট আদতে কী রায় দিয়েছে৷ বিশিষ্ট আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ বলেন, ‘‘আমাদের দেশে পরকীয়া আর ফৌজদারি অপরাধ রইলো না৷ এতদিন কোনো বিবাহিতা নারী পরপুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক করলে স্বামীর অভিযোগের ভিত্তিতে ওই প্রেমিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যেতো৷ মহিলার বিরুদ্ধে মামলা হতো না, কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত হলে পরপুরুষকে সাজার মুখে পড়তে হতো৷ সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পর আর ফৌজদারি মামলা করা যাবে না৷''

‘আমাদের দেশে পরকীয়া আর ফৌজদারি অপরাধ রইলো না’

This browser does not support the audio element.

তিনি জানান, স্বামীর সম্মতি নিয়ে স্ত্রী পরকীয়া করলে অপরাধ হতো না৷ কিন্তু সেটা বাস্তবে সম্ভব ছিল না৷ তবে তিনি বলেন, ‘‘আগের মতোই বিবাহ বিচ্ছেদের মামলার ক্ষেত্রে পরকীয়া একটি জোরালো কারণ হিসেবে বিবেচিত হবে৷''     

সু্প্রিম কোর্টের এই রায়ে খুবই খুশি সাহিত্যিক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়৷ কাদম্বরী দেবী ও রাণুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক ঘিরে বই লিখে বাঙালি সমাজে বিতর্কের ঝড় তুলেছেন তিনি৷ রঞ্জন বলেন, ‘‘এই রায়ে নারীকে সম্মান দেওয়া হলো৷ দুটো মানুষ একমত হয়ে সম্পর্ক করলে তা আর অপরাধ থাকে না৷ পরকীয়া কোনো দেশেই আর অপরাধ নয়৷ মুক্ত সমাজ ও মুক্তচিন্তার পক্ষে এটা ভালো৷''    

ভারতীয় সংস্কৃতিতে নানাভাবে পরকীয়া উঠে এসেছে৷ সেখানে নারীকে নিন্দনীয় হিসেবেই দেখানো হয়েছে৷ এ ব্যাপারটা একেবারেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ফসল বলে মনে করেন তিনি৷ তাঁর মতে, ‘‘পৃথিবীর সবকিছুর এক্সপায়ারি ডেট আছে, কেবল স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে নেই, এটা হতে পারে?৷''

একই সুরে ডয়চে ভেলেকে সাংবাদিক, পরিচালক ও অভিনেত্রী সুদেষ্ণা রায় বললেন, ‘‘পরকীয়া রাধাকৃষ্ণের আমল থেকে ছিল৷ এটা তো একটা ইউটোপিয়ান কনসেপ্ট যে একজন মহিলার সারাজীবন একজন পুরুষকেই ভালো লাগবে৷''  নিজের ছবিতে সুদেষ্ণা সমাজের অনেক প্রথা বহির্ভূত বিষয় তুলে ধরেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সমাজে সবটাতেই ‘গেল গেল' রব ওঠে৷ এই রায়ের জন্য সবাই ব্যাভিচার করবে, সেটাও নয়৷'' 

‘এই রায়ে স্বামী ও স্ত্রী একই জায়গায় চলে আসায় সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো’

This browser does not support the audio element.

আদালতের রায়ে নারী পুরুষের সঙ্গে সমানাধিকার পেয়েছে, এমনটাই মনে করেন প্রাক্তন বিচারপতি ও রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অশোক গঙ্গোপাধ্যায়৷ তিনি বলেন, ‘‘এতদিন পুরুষের মামলা করার অধিকার ছিল৷ কিন্তু স্বামী বহুগামী হলে তাঁর প্রেমিকার বিরুদ্ধে স্ত্রী মামলা করতে পারতেন না৷ আদালতের রায়ে স্ত্রী'র প্রেমিকের বিরুদ্ধে স্বামীর ফৌজদারি মামলা করার অধিকার বাতিল হয়ে গেল৷ সেই অর্থে স্বামী ও স্ত্রী একই জায়গায় চলে আসায় সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো৷''

পুরোনো নিয়ম অনুযায়ী পরকীয়ায় লিপ্ত স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ ছিল না৷ তাহলে এই রায়কে কেন নারীর মুক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে? প্রাক্তন বিচারপতির বক্তব্য, ‘‘নারীর শাস্তি হতো না ঠিকই, কিন্তু তিনি যার সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত, তাঁর সাজা হলে নারীর সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতো৷ আইন-আদালত সব কথা নয়, সামাজিক মর্যাদাটাও গুরুত্বপূর্ণ৷''ভারতীয় সমাজের একটা বড় অংশ এই রায়ের সমর্থক৷ তবে অনেকেই বলছেন, এই রায়ের ফলে পরিবার ও সমাজ জীবনে নৈরাজ্য দেখা দেবে৷ ‘পীড়িত পুরুষ পতি পরিষদ' নামক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রাধিকানাথ মল্লিকের মতে, ‘‘এই রায়ের পরিণাম ভয়ংকর হবে৷ একটা ছেলে বা মেয়ে এ ধরনের স্বাধীনতা পেলে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠবে৷ অনেকে এটাকে জৈবিক চাহিদা বলছেন, তাহলে তো দেশে যৌন হিংসা রোধে কোনো আইন থাকাই উচিত নয়৷'' এতে পরিবার জীবনে সংকট তৈরি হবে বলে মনে করেন রাধিকানাথ৷ তিনি বলেন, ‘‘বহুগামী মহিলার সন্তানের পিতা কে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে৷ ডিএনএ পরীক্ষা করাতে আদালতে যেতে হবে৷ এ সবের মধ্যে পড়ে সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে৷ কোনো বহুগামী মহিলাকে ডিভোর্স দিতে চাইলে স্বামীকে বিপুল টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে৷ তাঁর সংসারও ভাঙবে, আর্থিক ক্ষতিও হবে৷'' 

            

‘এই রায়ে নারীকে সম্মান দেওয়া হলো’

This browser does not support the audio element.

নারীবাদী কবি কৃষ্ণা বসু অবশ্য আদালতের এই রায়কে চমক ছাড়া আর কিছুই বলতে চাননি৷ তাঁর মতে, ‘‘স্বকীয়া বা পরকীয়া কোনো ব্যাপার নয়৷ প্রেম বা আকর্ষণটাই বড়৷ রাধাকৃষ্ণের প্রেমের কাহিনী আমরা আদর করে পড়ি, তাহলে পরকীয়াতে আপত্তি করব কেন?''

রায়ের সমর্থকেরা অনেকে পরকীয়ার পক্ষে বলতে গিয়ে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার উল্লেখ করেছেন৷ এর বিরোধিতা করে রাধিকানাথ বলেন, ‘‘পুরাণ আর বাস্তব এক নয়৷ ওটা বিশ্বাস, সমাজ নয়৷ মা কালীকে আমরা যেভাবে দেখি, সেই পোশাক কি মহিলারা পরেন?'' রাধিকানাথের বক্তব্য, ‘‘এই রায়ের ফলে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটা ধ্বংস হয়ে যাবে৷ সবচেয়ে ভালো হয়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পাড়ায় পাড়ায় পতিতালয় খোলা হোক৷''

একই সুরে চন্দননগরের গৃহবধূ নীতা রায় বলেন, ‘‘পুরুষদের ব্যাভিচারে সমাজের স্বীকৃতি আছে৷ সে জন্য সমাজের উপকন্ঠে পতিতালয়ও আছে৷ কিন্তু সংসারে মহিলাদের পরকীয়া চললে পরিবারের অন্যরা কী শিখবে? বিশেষ করে সন্তানের কী অবস্থা হবে?'' মেদিনীপুরের গৃহবধু মউ হোড় আবার বলেছেন, ‘‘রায়ে কিস্যু এসে যাবে না৷ পরকীয়া হওয়ার হলে তা কেউ আটকাতে পারবে না৷ মনুয়া খুন করতই, তাকেও আটকানো যেতো না৷''

‘‘এই রায়ের ফলে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটা ধ্বংস হয়ে যাবে’

This browser does not support the audio element.

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বারাসতের মনুয়া মজুমদার বিয়ের পরেও অতীতের প্রেম বজায় রেখেছিলেন৷ স্বামীর সঙ্গে এ নিয়ে বিবাদ চলত৷ অবশেষে মনুয়ার পরামর্শে তাঁর স্বামীর ‘লাইভ মার্ডার' ঘটিয়েছিলেন প্রেমিক অজিত৷ সম্প্রতি এই পরকীয়া ও হত্যাকাণ্ড খবরের শিরোনামে এসেছিল৷ সুপ্রিম কোর্টের রায় শুনে জেলবন্দি অজিত অবশ্য খুশি৷ 

সত্যিই কি মহিলারা মনুয়ার মতো বিপথগামী হতে পারেন? বাংলা মেগাসিরিয়ালে এখনপরকীয়ার রমরমা৷ চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক তথা রাজ্যের মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বহু মানুষ পরকীয়ার মধ্যে বাঁচে, এটা ঘটনা৷ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের উপর আইন চাপিয়ে কিছু হয় না৷ মহিলা ব্যাভিচার চাইলে আইন দিয়ে রোখা সম্ভব নয়৷''

আদালতের রায়ে অসন্তোষ জানিয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকে৷ বর্ধমানের নবগ্রাম সুন্নি মসজিদের ইমাম আফসার জামুরি বলেন, ‘‘সমাজের প্রচণ্ড ক্ষতি হবে বৈকি! কোরানে ১,৪০০ বছর আগে মহানবী মোহাম্মদ যা বলে গিয়েছিলেন, সেটা বিজ্ঞান ও সমাজসম্মত৷ পরকীয়া বৈধ হলে সম্পর্কের বাঁধন থাকবে না৷'' পার্শ্ববর্তী এলাকার ইমাম হাসিবুলও বলেন, ‘‘সম্পর্কের শাসন না থাকলে তা কি টিকবে?''   

‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সাবলম্বন, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা ছাড়া শুধু পরকীয়াতে নারীর মুক্তি হতে পারে না’

This browser does not support the audio element.

এই টানাপোড়েনের মধ্যে একটি শিবিরের মতো, প্রকৃত নারীমুক্তির সঙ্গে পরকীয়ার বৈধতা লাভের কোনো সম্পর্ক নেই৷ বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্রী অহনা বিশ্বাস বললেন, ‘‘সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের জগতে পরকীয়ার জন্য অ্যাশলে ম্যাডিসন নামের ওয়েবসাইট রয়েছে৷ যাদের স্লোগানই হলো, লাইফ ইজ শর্ট, হ্যাভ অ্যান অ্যাফেয়ার৷ ভারতেও বহু মানুষ এখানে যুক্ত৷ কিন্তু, এটাই আমাদের দেশ নয়৷ প্রত্যেক নারী কি এ দেশে নিজেকে সুরক্ষিত মনে করে? নিরাপত্তা আগে নিশ্চিত করা হোক, তারপর পরকীয়া নিয়ে ভাবা যাবে৷''

কবির কথাতেই বরং বিতর্কে উপসংহার টানা যেতে পারে৷ কৃষ্ণা বসুর ভাষায়, ‘‘নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সাবলম্বন ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা ছাড়া মুক্তি সম্ভব নয়৷পরকীয়াতে নারীর মুক্তি হতে পারে না৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ