করোনা মহামারি কাল পেরিয়ে এবার দুই বছর পর বাংলা নববর্ষ বাইরে উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হলো। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ আর চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা- এই দুই প্রধান আয়োজনে হয়েছে এবারের বর্ষবরণ।
বিজ্ঞাপন
আর এই বাংলা নববর্ষ ১৪২৯ সালের পহেলা বৈশাখে একটি পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রত্যাশা করেছেন সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ। তাদের কথা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। গণতন্ত্র সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ তেমন ভালো নেই। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে এক সর্বজনীন এবং প্রগতিশীল বাংলাদেশের প্রত্যাশা করেন তারা।
তিতুমীর কলেজের ছাত্র মামুন সোহাগ বলেন,"বাংলা নববর্ষ একটি সর্বজনীন উৎসব। কিন্তু এই উৎসব নিয়েও আমরা সামাজিক যোগাযোগমধ্যমসহ নানা জায়গায় সমালোচনা ও কটূক্তি দেখতে পাই। এটা আমাদের আতঙ্কিত করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের পাঁয়তারা দেখতে পাই। আমরা চাই এটা যেন না হয়। বাংলাদেশে আমরা সব ধর্ম সব মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন দেখতে চাই।”
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অংকন রোজারিও বলেন,"যেকোনো মূল্যে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে হবে। বাংলা নববর্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎস। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে।”
মঙ্গল শোভাযাত্রায় রঙিন ও আনন্দমুখর পহেলা বৈশাখ
করোনার কারণে গত দু বছর পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপন হয়েছে সীমিত পরিসরে৷ তবে এবার ফিরে এসেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা৷ উদযাপনেও ফিরেছে বাধাহীন উৎসবের রং৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Sazzad Hossain/DW
নতুন পথে মঙ্গল শোভাযাত্রা
প্রতি বছর শোভাযাত্রা চারুকলা থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ ও টিএসটি মোড় ঘুরে ফের চারুকলার সামনে গিয়ে শেষ হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) থেকে শুরু হয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা ভিসি চত্বর সংলগ্ন স্মৃতি চিরন্তন হয়ে আবার টিএসসিতে গিয়ে শেষ হবে। তাই হয়েছে৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
বাঙালির প্রাণের উৎসব
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব মানুষ এ দিনটির অপেক্ষায় থাকে। বর্ণিল সাজ আর আয়োজনের উৎসবে মেতে ওঠেন সবাই। বর্ষবরণের আয়োজনের মূল আকর্ষণ মঙ্গলশোভাযাত্রা।
ছবি: Sazzad Hossain/DW
স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ
করোনার প্রকোপের কারণে ২০২০ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়নি। ২০২১ সালে স্বল্প পরিসরে হয় চারুকলার ভেতরে। এবার অনেকটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরায় মঙ্গল শোভাযাত্রাও ফিরেছে পুরোদমে৷ জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সার্থক হয়েছে আয়োজন৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা
নিরাপত্তার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা ও আর্চওয়ে স্থাপন করে তা মনিটরিং করার জন্য পুলিশ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তায় সুন্দরভাবে শেষ হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
কিছুটা সীমিত
এবারের আয়োজনকেও অবশ্য ‘সীমিত’ বলা হচ্ছে, কারণ, প্রতি বছর ১০ থেকে ১২টি ভাস্কর্য থাকলেও এবার রাখা হয় মাত্র চারটি। এছাড়া নিরাপত্তার স্বার্থে শোভাযাত্রায় মুখোশ না পরার পরামর্শও দেয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
মঙ্গল শোভাযাত্রার সার্বিক আয়োজনে যারা
প্রতি বছর চরুকলা অনুষদই শোভাযাত্রার আয়োজন করে। এবার সেই দায়িত্ব পালন করেছেন চারুকলার ২২ ও ২৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।
ছবি: Sazzad Hossain/DW
ছায়ানটের বর্ষবরণের ৫২ বছর
রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান ৫২ বছর পার করেছে এ বছর৷ ১৯৬৭ সাল থেকে রমনা বটমূলে ছায়নট এ প্রভাতী আয়োজন করে আসছে৷ মাঝে করোনার কারণে অবশ্য দুই বছর এ আয়োজন হতে পারেনি।
ছবি: Sazzad Hossain/DW
মুখে মুখে আলপনা
বর্ষ বরণের উৎসবে যোগ দিতে আসা অনেকেই শিল্পীদের দিয়ে মুখে এঁকে নেন বাহারি সব আলপনা৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
খোঁপায় ফুল
পহেলা বৈশাখ উদযাপনে অংশ নিতে আসা অনেক নারীর মাথায় শোভা পাচ্ছিল ফুল৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
‘নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’
বাংলাদেশে বর্ষবরণের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে মঙ্গল শোভাযাত্রা৷ এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য রজনীকান্ত সেনের লেখা গানের ‘নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’ অংশটুকু৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
বর্ণিল শোভাযাত্রা
বৈশাখী সাজে সেজে রঙবেরঙের বাহারি মুখোশ, শোলার পাখি, টেপা পুতুল হাতে নিয়ে ঢাক-ঢোল-বাঁশি বাজিয়ে হাজরো মানুষ অংশ নেন মঙ্গল শোভাযাত্রায়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য
১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উদ্যোগে ঢাকায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়৷ ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এই শোভাযাত্রাকে ‘বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের’ স্বীকৃতি দেয়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
ময়মনসিং থেকে ঢাকায়
ময়মনসিংহের সৌরভ ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরে চলে এসেছেন হাতপাখা বিক্রি করতে৷ প্রতিটি পাখার দাম ১০০ টাকা৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
খাবারের দোকান কম
পবিত্র রমজান মাসে বলে শাহবাগ ও টিএসসি এলাকায় কোনো খাবারের দোকান খোলা ছিল না৷ তবে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে কিছু দোকান খোলা ছিল।
ছবি: Sazzad Hossain/DW
ব্যান্ডেনা
শাহবাগ মোড়ে এক ব্যান্ডেনা বিক্রেতা৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
মাটিকে বাঁচান
মাটি না বাচলে মানুষও বাঁচবে না- এই স্লোগান নিয়ে নববর্ষ উদযাপনের দিনে রাজু ভাস্কর্যের সামনে ‘সেভ সয়েল বাংলাদেশ’ আন্দোলন৷ ছবিতে অভিনেত্রী, অ্যাক্টিভিস্ট কাজী নওশাবা আহমেদকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
নব আনন্দে জাগো’
রাজধানীর রমনার বটমূলে বর্ণাঢ্য আয়োজন শুরু হয় ভোর ঠিক সোয়া ৬টায়। এবার রমনার আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য ‘নব আনন্দে জাগো’৷ শুরুতে ভোরের বিভিন্ন রাগে যন্ত্রসংগীত ও একক এবং সম্মেলক গান পরিবেশিত হয়।
ছবি: Sazzad Hossain/DW
বাবা ও মেয়ে
মোহাম্মদপুর থেকে এক বাবা তার মেয়েকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছেন নববর্ষ উদযাপন।
ছবি: Sazzad Hossain/DW
বিদেশিদের অংশগ্রহণ
বরাবরের মতো এবারও মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিদেশি দর্শনার্থীদের দেখা গেছে৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
সেলফি
তিন তরুণীর সেলফি৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
সপরিবারে...
নববর্ষ উপলক্ষ্যে ধানমন্ডি লেক এলাকায় ঘুরতে বেরিয়েছে একটি পরিবার৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
21 ছবি1 | 21
করোনার দুই বছর পর এবার বাইরে বাংলা নববর্ষ বরণ করা হলেও নিরাপত্তা ছিলো ব্যাপক। দপুর দুইটার মধ্যে সব অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশনা ছিলো। এটা অনেকেই ভালোভাবে নেননি। তাদের কথা বাংলা নববর্ষ উদযাপনে কিসের এত আতঙ্ক! সমাজে ভয় আর আতঙ্ক ঢুকে গেছে। একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পিংকি ভৌমিক বলেন, "আমার মধ্যে এক ধরনের ভয় আর আতঙ্ক কাজ করে। আমি নিরাপত্তাহীনতা দেখছি। মানুষের মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। এই দূরত্ব দূর করতে হবে। বাংলা নববর্ষ সেই দূরত্ব দূর করতে পারে। এটা এমন একটা অনুষ্ঠান, উৎসব যেখানে ধর্মের কোনো প্রভাব নেই। নেই কোনো সাম্প্রদায়িকতা।”
দেশের সাধারণ মানুষ এখন নানা সংকটে আছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দরিদ্র্য একটি অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করছে বলে মনে করেন পোশাক শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলাম রনি। তিনি বলেন,"করোনার ধকল কাটিয়ে উঠলেও শ্রমিকরা ভালো নেই। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। আয় বাড়েনি। এই পহেলা বৈশাখ তাদের জন্য কোনো সুখবর বয়ে আনেনি। নতুন বছরে তারা যেন ভালো থাকেন এই প্রত্যাশা করি।”
সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন এক সংকট কাল চলছে। এই সংকট থেকে নতুন বছরে উত্তরণের আশা করেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। তিনি বলেন,"দেশে আইনের শাসন নেই, মানবাধিকার নেই, গণতন্ত্র নেই, মানুষের ভোটের অধিকার নেই। এগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে। এগুলো ফিরিয়ে আনার পথে অনেক বাধা আছে। সেই বাধা আমাদের অতিক্রম করতে হবে।নতুন বছরে সেই বাধা অতিক্রম করে গণতন্ত্রের জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।”
তিনি বলেন,"দেশের বাইরেও বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে। তারা র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।”
আর নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন,"দেশ সঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। একটি অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের যে স্বপ্ন তা সফল হচ্ছে। বাংলা নববর্ষে সেই স্বপ্ন পুরণে আরো এগিয়ে যাব আমরা। যারা দেশে গণতন্ত্রহীনতা দেখতে পান, সমস্যা দেখতে পান সমস্যা আসলে তাদের মধ্যে। তারা নিজেদের সমস্যা এখন অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন।”
মানবাধিকার কর্মী নূর খান মনে করেন,"বাংলা নববর্ষের আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক দিকে ভাটার টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমরা সাজসজ্জায় নজর দিচ্ছি। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে পড়ছি। সুশাসন, মানবাধিকার, ভোটাধিকার এগুলো কেতাবি শব্দে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিলো এগুলো।”