সোমবার গ্রিনউইচ মান সময় রাত এগারোটায় মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০১৩ সালে কৃত মধ্যকালীন সমঝোতার৷ বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ি সদস্যদেশ সহ জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কি ইরানকে রাজি করাতে পারবেন?
বিজ্ঞাপন
লক্ষণ দেখে তা মনে হচ্ছে না৷ যদিও পরমাণু শক্তির প্রশ্নে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমের গত ১২ বছরের বিরোধের অন্ত ঘটানোর সম্ভবত এটাই ছিল সেরা সুযোগ – যদিও শেষ সুযোগ নয়, কেননা খেলার পরে যেমন থাকে ‘এক্সট্রা টাইম', ম্যাচের পরে ফিরতি ম্যাচ, ঠিক সেভাবেই এই মওকা হাতছাড়া হলেও, এই আলাপ-আলোচনা কয়েক সপ্তাহের জন্য বন্ধ রেখে আবার চালু করা যেতে পারে৷ নয়ত মধ্যকালীন সমঝোতায় কিছু নতুন শর্ত যোগ করে তার মেয়াদ আগামী বছর অবধি বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে৷
গত শুক্রবার থেকে ভিয়েনায় যে কূটনৈতিক ‘ব্লিৎস' শুরু হয়েছে, তা যে মূল সমস্যাগুলি সমাধানে সফল হয়েছে, এমনটা ঠিক বলা চলে না – সংশ্লিষ্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যেন আশা-নিরাশার দোলায় ভাসছেন: ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড যেখানে আশাবাদী, জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাংক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার সেখানে ইরান এবং ছয় শক্তির মধ্যে গভীর ব্যবধানের কথা বলেছেন৷ এই আলাপ-আলোচনা যদি সফল হয়, তবে তা-তে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রোহানি৷ এ পক্ষ চায় ইরানের আণবিক বোমা তৈরির সম্ভাবনা চিরকালের মতো দূরীভূত করতে; ও পক্ষ চায় যথাশীঘ্র এবং যাবতীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ প্রত্যাহার৷ এবং দু'পক্ষকেই শেষমেষ আপোশের কোনো একটা ফর্মুলা মেনে নিতে হবে৷
ফুকুশিমার ছায়া
দুইবছর আগে ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নতুন করে ভেবেছে৷ কারও উপর আবার কোনো প্রভাবই পড়েনি৷
ছবি: Reuters/Kyodo
একইসঙ্গে সুনামি, ভূমিকম্প ও পরমাণু দুর্ঘটনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হয় দুই বছর আগে৷ সাগরের নীচে ৯.৩ মাত্রার ভূমিকম্পের পর উত্তরপূর্ব উপকূলে সুনামি তৈরি হয়৷ এতে কমপক্ষে ১৫,৮৮০ জন মারা যায়৷ আর আহত হয় ৬,১৩৫ জন৷ তবে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ২,৬৯৪ জন৷
ছবি: dapd
পরমাণু দুর্ঘটনা
সুনামির কারণে ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের শীতলীকরণ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়৷ এতে তিনটি চুল্লি অতিরিক্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে৷ আর তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে৷ ফলে সরকার ঐ বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশেপাশের ৩০ কিলোমিটার এলাকায় বসবাসরতদের সরে যেতে বলে৷ এখনো তারা ঘরে ফিরতে পারেনি৷
ছবি: Reuters/Kyodo
চেরনোবিল
ফুকুশিমার আগে ইউক্রেনের চেরনোবিল দুর্ঘটনা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক পরমাণু দুর্ঘটনা৷ ১৯৮৬ সালে ঐ কেন্দ্রের একটি চুল্লিতে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে সে ধ্বংস হয়ে যায়৷ ফলে ইউরোপ ও রাশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে৷ ঐ দুর্ঘটনায় ৩০ জন নিহত হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তারপরও পরমাণু বিদ্যুৎ
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চেরনোবিলের কথা সবাই ভুলে যায়৷ ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পরমাণু বিদ্যুতের দিকে ঝুঁকে পড়ে৷ এমনকি ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পরও যুক্তরাষ্ট্রে দুটি চুল্লি নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এমনকি জার্মানিও
জার্মানি এমনিতেই পরমাণু শক্তির চরম বিরোধী৷ তাই সাবেক চ্যান্সেলর গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার ২০২২ সালের মধ্যে পরমাণু শক্তি উৎপাদন বন্ধ করার পরিকল্পনা করেছিলেন৷ বর্তমান সরকার সেটা বাড়িয়ে ২০৩৪ পর্যন্ত করতে চেয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফুকুশিমা বদলে দিল সব
ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর জার্মানিতে পরমাণু শক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠায় আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সরকার তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়৷ ফলে এখন আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২২ সালের মধ্যেই সব পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে৷ জার্মানি ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ৮০ শতাংশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে৷
ছবি: picture alliance/Hinrich Bäsemann
ইটালিতেও পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ
জার্মানির মতো ইটালিও পরমাণু শক্তির ঘোর বিরোধী৷ চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর ১৯৮৭ সালে একটি গণভোটের মাধ্যমে ইটালীয়রা পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের পক্ষে ভোট দেয়৷ পরবর্তীতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি সেটা আবারও শুরু করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পরমাণু বিদ্যুতের পক্ষে ব্রিটেন
ব্রিটিশ সরকার পরমাণু বিদ্যুৎকে জ্বালানির একটা উৎস হিসেবে দেখছে৷ তাদের মতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে পরমাণু বিদ্যুৎ৷
ছবি: AP
চারগুণ বাড়াতে চায় ভারত
২০২০ সালের মধ্যে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন চারগুণ বাড়াতে চায় ভারত৷ সরকারের এই সিদ্ধান্ত ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়েছে৷ রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি হওয়া একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বিক্ষোভের কারণে মাঝেমধ্যেই বন্ধ রাখতে হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চীনের লক্ষ্যও একই
চীনও পরমাণু বিদ্যুতের উপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে৷ বর্তমানে দেশটির মোট চাহিদার মাত্র এক শতাংশ আসে পরমাণু বিদ্যুৎ থেকে৷ ২০২০ সালের মধ্যে এই হারটা চীন ছয় শতাংশে নিয়ে যেতে চায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশে প্রথম
পাবনার রূপপুরে বাংলাদেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হতে যাচ্ছে৷ রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি হতে যাওয়া এই কেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images
11 ছবি1 | 11
সে আপোশের ফর্মুলা যে কী হবে, তা কারো জানা নেই৷ দৃশ্যত ইরান কোনোমতেই ইউরোনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ বন্ধ করতে, এমনকি কমাতে পর্যন্ত রাজি নয়৷ অপরদিকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কমিয়ে পশ্চিমের যে কী লাভ হবে, তা নিয়ে পশ্চিমেও সন্দেহের কমতি নেই৷ উত্তরোত্তর আলাপ-আলোচনার জন্য ‘ঘড়িতে আরো সময় ভরো', চলতি সমঝোতার মেয়াদ বাড়িয়ে দাও – এ সব করে হাতে আরো কিছু সময় পাওয়া যাবে বটে; কিন্তু সময়ই তো এই বিরোধে একটা মূল সমস্যা৷ সময় যত যাবে, ততই ইরান আণবিক বোমা তৈরির জন্য আরো বেশি সময় পাবে৷ ওদিকে ইসরায়েল আগে থেকেই হুমকি দিয়ে বসে আছে যে, তারা ইরানের পরমাণু বোমার অধিকারী হওয়াটা কোনো পরিস্থিতিতেই বরদাস্ত করবে না৷ সৌদি আরবও ইরানের পারমাণবিক উচ্চাশায় আদৌ সুখি নয়৷ ইরান আণবিক বোমা তৈরি করলে গোটা অঞ্চলটায় একটা বড় আকারের সংকট দেখা দেবে৷
কাজেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফ-এর সঙ্গে ষষ্ঠবারের জন্য মিলিত হয়েছেন৷ রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ অবশ্যই একজন ‘কি প্লেয়ার'; আরো বড় কথা, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন নাকি আজ স্বয়ং কথা বলবেন ইরানের প্রেসিডেন্ট রোহানির সঙ্গে, জানাচ্ছে রুশ ইটার-টাস সংবাদ-সংস্থা৷ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই আজ ভিয়েনা পৌঁছেছেন৷ ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরঁ ফাবিয়ুস তো গোড়া থেকেই উপস্থিত৷
ওদিকে মার্কিন কংগ্রেসের উভয় কক্ষে ‘হার্ডলাইন' রিপাবলিকানদের আধিপত্য শুরু হতে চলেছে৷ এবার যদি রিপাবলিকানরা ইরানের বিরুদ্ধে আরো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দাবি করেন, তাহলে ইরানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভরাডুবি: এ কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা স্বয়ং৷