ইরান তাদের পরমাণু-কেন্দ্রে লাগানো ক্যামেরা খুলে দিয়েছে বলে অভিযোগ আইএইএ-র। ফলে পরমাণু চুক্তির নবীকরণ নিয়ে সমস্যা হবে বলে তারা মনে করছে।
বিজ্ঞাপন
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি(আইএইএ) বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, ইরানের পরমাণুকেন্দ্রে নজরদারির জন্য যে ২৭টি ক্যামেরা লাগানো ছিল, ইরান সেগুলি সরিয়ে ফেলার কাজ শুরু করেছে। ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি অনুসারে ওই নজরদারি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল। ওই চুক্তি অনুসারে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে না।
অ্যামেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে এনেছিলেন। তারপর চুক্তি নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আবার চুক্তির নবীকরণ চাইছেন। ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশের আলোচনাও চলছে।
এই পরিস্থিতিতে আইএইএ-র তরফে আশঙ্কাপ্রকাশ করা হয়েছে, ইরানের এই কাজের ফলে পরমাণু চুক্তির নবীকরণ নিয়ে সমস্যা দেখে দেবে। ইরান বেশি করে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করছে। তাতে আইএইএ-র আশঙ্কা, তারা পরমাণু বোমা বানাবার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে।
ক্যামেরা খুলে নেয়ায় আইএইএ-র কাছে আর কোনো তথ্য পৌঁছাচ্ছে না। বুধবার আইএইএ-র বোর্ড অফ গভর্নর্স তেহরানের নিন্দা করেছে। আইএইএ-তে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র নিন্দাপ্রস্তাব জমা দেয়। ৩০টি দেশ তাকে সমর্থন করে। শুধু রাশিয়া ও চীন এর বিরোধিতা করেছে।
ইরান পরমাণু চুক্তি কী ও কেন?
অ্যামেরিকা একতরফাভাবে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করলেও বাকি স্বাক্ষরকারী দেশগুলি চুক্তি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর৷ ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ নামের এই চুক্তির প্রধান শর্তগুলি কী?
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Neubauer
পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ?
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ইরান শুধু পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাতে পারবে না৷ তবে আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি চালু রাখার অধিকার সে দেশের রয়েছে৷ অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসার মতো ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images/IIPA
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ
চুক্তির প্রথম আট বছরে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সীমা মেনে চলতে রাজি হয়েছিল৷ সেইসঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত গবেষণাও বন্ধ থাকবে৷ আন্তর্জাতিক পরমাণু জ্বালানি সংস্থা আইএইএ ইরানের কার্যকলাপের উপর নজর রেখে চলেছে৷ জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, চীন ও রাশিয়া এক্ষেত্রে আইএইএ-র মূল্যায়নকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে৷
ছবি: Kazem Ghane/AFP/Getty Images
পরমাণু ভাণ্ডারের ভবিষ্যৎ
চুক্তির আওতায় ইরান ৩,৬৭ শতাংশ সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর অঙ্গীকার করেছিল৷ অর্থাৎ ১৫ বছরের জন্য ৩০০ কিলোগ্রামের বেশি এমন মানের ইউরেনিয়াম ইরানের হাতে থাকার কথা নয়৷ ফলে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথ আপাতত বন্ধ থাকছে৷
ছবি: BEHROUZ MEHRI/AFP/Getty Images
নিষেধাজ্ঞা শিথিল
ইরান শর্ত পূরণ করার পরিবর্তে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ফলে ইরান আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়াম বিক্রি ও আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল৷ অ্যামেরিকার চাপের মুখে সেই সুবিধা হাতছাড়া করতে চায় না ইরান৷
ছবি: FARS
চুক্তিভঙ্গের পরিণতি
পরমাণু কর্মসূচির উপর আন্তর্জাতিক নজরদারির ফলে একটি পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করতে ইরানের কমপক্ষে এক বছর লাগবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷ সে রকম প্রচেষ্টা চালালে আবার সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর বিধান মেনে নিয়েছে ইরান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Jenis
চুক্তির মেয়াদ শেষের অবস্থা
সমালোচকরা বার বার চুক্তির ‘সানসেট ক্লজ’ বা মেয়াদ শেষের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন৷ তাদের অভিযোগ, শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা সত্ত্বেও ইরান চুক্তির মেয়াদ শেষে আবার অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করবে৷ তবে চুক্তির প্রবক্তারা মনে করিয়ে দেন, যে বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপের উপর ১০, ১৫, ২০ বা ২৫ বছর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকবে৷
ছবি: Fars
ক্ষেপণাস্ত্র ও আঞ্চলিক প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকরা ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বাড়বাড়ন্ত ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সে দেশের প্রভাব প্রতিপত্তির কড়া সমালোচনা করেন৷ ইউরোপসহ অন্যান্য অনেক দেশও বিষয়ে একমত৷ তবে ‘সফল’ পরমাণু চুক্তি বাতিল করার বদলে তা কাজে লাগিয়ে ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায় তারা৷
ছবি: Reuters/O. Sanadiki
7 ছবি1 | 7
ইরান বলেছে, এই প্রস্তাব তাড়াহুড়ো করে নেয়া এবং ভারসাম্যহীন।
২০১৫-র চুক্তি নবীকরণে ধাক্কা
আইএইএ-র প্রধান রাফায়েল গ্রসি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ''ক্যামেরা সরিয়ে দেয়া মানে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির উপর নজরদারিতে ধাক্কা। তার মানে স্বচ্ছ্বতা কমবে, সন্দেহ দেখা দেবে, অনিশ্চয়তাও বাড়বে।''
গ্রসি বলেছেন, ''আমরা খুবই উদ্বেগের মধ্যে আছি। যদি ইরান ওই ক্যামেরা আর না লাগায়, তাহলে তা ২০১৫-র চুক্তিতে বিশাল ধাক্কা হিসাবেই দেখতে হবে।''
অ্যামেরিকার আবেদন
মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, ইরানের উচিত আইএইএ-র সঙ্গে সহযোগিতা করা। ব্লিংকেনও বলেছেন, ইরানের এই কাজের ফলে ২০১৫-র চুক্তি নবীকরণের সম্ভাবনা কমবে। তিনি মনে করেন, ইরানের এই আচরণ পারমাণবিক সংকট ডেকে আনবে এবং ইরানকে আর্থিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে আরো একঘরে করে দেবে।