পরমাণু চুক্তি রক্ষার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যাচ্ছে ইরান
৮ মে ২০১৯
২০১৫ সালে পরমাণু চুক্তিতে স্বাক্ষরকারীদের একটি চিঠি পাঠানোর কথা জানিয়েছে ইরান৷ চিঠিতে সেই চুক্তির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সরে যাওয়ার কথা বলেছে দেশটি৷ ইরানের এই সিদ্ধান্তের জবাবে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন দেশ৷
বিজ্ঞাপন
ইরান বুধবার জানায়, ২০১৫ সালে সম্পাদিত পরমাণু চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকে জানিয়েছে যে, চুক্তিতে থাকা ‘স্বত:স্ফূর্ত প্রতিশ্রুতিগুলো' না মানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে একটি যুদ্ধবিমানবাহী রণতরী পাঠানোর পর এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে দেশটি৷ তেহরানকে ‘পরিষ্কার এবং সন্দেহাতীত' বার্তা দিতে রণতরীর এই বহর পাঠানো হয়েছে বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছে ওয়াশিংটন৷
ইরান যা বলেছে
টেলিভিশনে দেয়া এক বক্তৃতায় ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন:
- বিশ্বশক্তিগুলো যদি প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে তাহলে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের প্রক্রিয়া আবার শুরু করবে ইরান৷
- পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে যারা এখনো চুক্তির পক্ষে রয়েছেন, অর্থাৎ জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন এবং রাশিয়া ইরানের তেল এবং ব্যাংকিংখাত রক্ষায় তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে আর ৬০ দিন সময় পাবে৷
ইরান পরমাণু চুক্তি কী ও কেন?
অ্যামেরিকা একতরফাভাবে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করলেও বাকি স্বাক্ষরকারী দেশগুলি চুক্তি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর৷ ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ নামের এই চুক্তির প্রধান শর্তগুলি কী?
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Neubauer
পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ?
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ইরান শুধু পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাতে পারবে না৷ তবে আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি চালু রাখার অধিকার সে দেশের রয়েছে৷ অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসার মতো ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images/IIPA
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ
চুক্তির প্রথম আট বছরে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সীমা মেনে চলতে রাজি হয়েছিল৷ সেইসঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত গবেষণাও বন্ধ থাকবে৷ আন্তর্জাতিক পরমাণু জ্বালানি সংস্থা আইএইএ ইরানের কার্যকলাপের উপর নজর রেখে চলেছে৷ জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, চীন ও রাশিয়া এক্ষেত্রে আইএইএ-র মূল্যায়নকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে৷
ছবি: Kazem Ghane/AFP/Getty Images
পরমাণু ভাণ্ডারের ভবিষ্যৎ
চুক্তির আওতায় ইরান ৩,৬৭ শতাংশ সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর অঙ্গীকার করেছিল৷ অর্থাৎ ১৫ বছরের জন্য ৩০০ কিলোগ্রামের বেশি এমন মানের ইউরেনিয়াম ইরানের হাতে থাকার কথা নয়৷ ফলে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথ আপাতত বন্ধ থাকছে৷
ছবি: BEHROUZ MEHRI/AFP/Getty Images
নিষেধাজ্ঞা শিথিল
ইরান শর্ত পূরণ করার পরিবর্তে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ফলে ইরান আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়াম বিক্রি ও আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল৷ অ্যামেরিকার চাপের মুখে সেই সুবিধা হাতছাড়া করতে চায় না ইরান৷
ছবি: FARS
চুক্তিভঙ্গের পরিণতি
পরমাণু কর্মসূচির উপর আন্তর্জাতিক নজরদারির ফলে একটি পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করতে ইরানের কমপক্ষে এক বছর লাগবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷ সে রকম প্রচেষ্টা চালালে আবার সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর বিধান মেনে নিয়েছে ইরান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Jenis
চুক্তির মেয়াদ শেষের অবস্থা
সমালোচকরা বার বার চুক্তির ‘সানসেট ক্লজ’ বা মেয়াদ শেষের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন৷ তাদের অভিযোগ, শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা সত্ত্বেও ইরান চুক্তির মেয়াদ শেষে আবার অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করবে৷ তবে চুক্তির প্রবক্তারা মনে করিয়ে দেন, যে বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপের উপর ১০, ১৫, ২০ বা ২৫ বছর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকবে৷
ছবি: Fars
ক্ষেপণাস্ত্র ও আঞ্চলিক প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকরা ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বাড়বাড়ন্ত ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সে দেশের প্রভাব প্রতিপত্তির কড়া সমালোচনা করেন৷ ইউরোপসহ অন্যান্য অনেক দেশও বিষয়ে একমত৷ তবে ‘সফল’ পরমাণু চুক্তি বাতিল করার বদলে তা কাজে লাগিয়ে ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায় তারা৷
ছবি: Reuters/O. Sanadiki
7 ছবি1 | 7
- সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম এবং ভারী পানির ভান্ডার, যা নির্দিষ্ট কিছু পারমাণবিক চুল্লীতে পরমাণু বিদারণের জন্য দরকার, কমানো বন্ধ করবে দেশটি৷
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চুক্তির ‘স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিশ্রুতিগুলো' না মানার সিদ্ধান্তের কথা ইতোমধ্যে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে৷
প্রসঙ্গত, এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পরও সেটি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ইরান৷ দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জেরিফ বলেছিলেন, ‘‘ইরানের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা পরমাণু চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত হবে৷ এই চুক্তি থেকে সরে যাবে না ইসলামিক রিপাবলিকটি৷''
কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার কারণ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য যেসব দেশ চুক্তির পক্ষে রয়েছে, তাদের সীমাবদ্ধতাকে দায়ী করেছে দেশটি৷ ইরান মনে করছে, এসব দেশের মার্কিন চাপ এড়িয়ে চলার ক্ষমতা নেই৷
উল্লেখ্য, ইরানের এই ঘোষণায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন দেশ৷ ব্রিটেন বলেছে, ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিলে তার পরিণতি ভালো হবে না৷ পশ্চিমা দেশগুলো সেক্ষেত্রে দেশটির উপর আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে বলে জানিয়েছে লন্ডন৷ জার্মানি অবশ্য পরমাণু চুক্তি টিকিয়ে রাখতে নিজ দেশ এবং ইউরোপের দেশগুলো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে বলে জানিয়ে ইরানকে চুক্তি মানার আহ্বান জানিয়েছে৷ অন্যদিকে, ইসরায়েল জানিয়েছে, ইরানকে পরমাণু অস্ত্র বানানোর কোনো সুযোগ দেবে না দেশটি৷