পরমাণু বিদ্যুতের রমরমার কারণে ইউরেনিয়ামের চাহিদা বাড়ছে
১ জানুয়ারি ২০২৪ফলে ইউক্রেনে হামলার কারণে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরেনিয়াম কিনতে বাধ্য হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব৷
সূর্য ও বাতাস অফুরন্ত জ্বালানির উৎস, যা কাজে লাগিয়ে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়৷ তবে কোনো দেশের পক্ষে শুধু এই দুই উৎসের উপর পুরোপুরি নির্ভর করা কঠিন৷
অনেক দশক ধরে পরমাণু বিদ্যুৎ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে৷ গত কয়েক বছরে এই উৎস বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছে৷ গোটা বিশ্বে নতুন পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে৷
ফুয়েল রডের জন্য জীবাশ্মভিত্তিক উপাদান হিসেবে ইউরেনিয়ামের প্রয়োজন হয়৷ গোটা বিশ্বে এই ধাতুর চাহিদা বেড়ে চলেছে৷ কিন্তু কোন কোন দেশে ইউরেনিয়াম উত্তোলন করা হয়?
তালিকারশীর্ষে রয়েছে কাজাখস্তান৷ সেখানে বছরে ২১ হাজার টনেরও বেশি ইউরেনিয়াম উত্তোলন করা হয়৷ তার পরেই রয়েছে ক্যানাডা, নামিবিয়া ও অস্ট্রেলিয়া৷ রাশিয়া তালিকায় ছয় নম্বরে রয়েছে৷ পরমাণু জ্বালানি উপদেষ্টা মাইকেল শ্নাইডার বলেন, ‘‘এখন বলা যেতে পারে, যে কাজাখস্তান রাশিয়ার প্রভাবের বলয়ে রয়েছে৷ ইউরোপের জন্য সেই প্রভাবের ক্ষেত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ ২০২২ সালে ইউরোপের প্রায় ৪৪ শতাংশ ইউরেনিয়াম রাশিয়া ও কাজাখস্তান থেকেই এসেছিল৷''
এ ক্ষেত্রে শুধু ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার নয়, প্রযুক্তিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ফুয়েল রড হিসেবে কাজে লাগাতে হলে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে হয়৷ প্রশ্ন হলো, সমৃদ্ধ করা ইউরেনিয়াম কোথা থেকে আসে?
প্রায় ৪০ শতাংশ এনরিচড ইউরেনিয়াম উৎপাদন করে রাশিয়া তালিকার সবচেয়ে উপরে রয়েছে৷ তার ঠিক পরেই রয়েছে ফ্রান্স ও চীন৷ মোটকথা এ ক্ষেত্রে খুব বেশি প্রতিযোগিতা নেই৷ কোলোরাডো স্কুল অফ মাইনসের আয়ান ল্যাংগে মনে করেন, ‘‘আপনি যদি ভাবেন, এটা কিছুটা ‘বিশ্ববাজারের' মতো৷ ধরুন আপনি রাশিয়া বা কাজাখস্তানের বদলে ক্যানাডা থেকে কিনলেন৷ তাহলে এর অর্থ হলো, অন্য কাউকে রাশিয়া বা কাজাখস্তানের কাছ থেকে কিনতে হবে, ঠিক তো? কিন্তু বাস্তবে সেটা হয় না৷ আপনি না কিনলে কিছুই বদলাবে না, সেটা ঠিক নয়৷ সেই সিদ্ধান্ত কোনো না কোনো অর্থে বাজারে পরিবর্তন আনে বৈকি৷’’
তবে ২০২২ সালে ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার হামলার পর থেকে মস্কো অবাঞ্ছিত ব্যবসার সহযোগী হয়ে উঠেছে৷ তা সত্ত্বেও পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়া থেকে এনরিচ়ড ইউরেনিয়ামের উপর নির্ভরশীল৷ রাশিয়াও তার জন্য মোটা টাকা আদায় করে৷ ২০১৮ সাল থেকে ইউরেনিয়ামের মূল্য একশো শতাংশেরও বেশি বেড়ে গেছে৷
গত বছর শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার মূল্যের ইউরেনিয়াম কিনেছে৷ তা সত্ত্বেও বিশ্ব বাজারে রাশিয়াই সবচেয়ে সস্তার বিকল্প৷ কোলোরাডো স্কুল অফ মাইনসের আয়ান ল্যাংগে বলেন, ‘‘আসলে ইউরেনিয়াম উৎপাদন করে কাজাকস্তান বা রাশিয়া থেকে সেটা নিয়ে আসা অপেক্ষাকৃত সস্তা৷ এটা শুধু বাজারের প্রশ্ন নয়৷ ট্রাম্প প্রশাসনে ইউরেনিয়াম আমদানি সীমিত করার বিষয়ে বড় আলোচনা হয়েছিল৷ কিন্তু তার কোনো ফল পাওয়া যায় নি৷ কারণ বিদ্যুতের দাম কমে যাওয়ায় পরমাণু বিদ্যুৎ প্লান্টগুলি এমনিতেই চাপের মুখে পড়েছিল৷ গ্যাসের দাম কমে যাওয়ার ফলে সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল৷ তারা বলেছিল, এবার আরো কম দামের ইউরেনিয়ামের জোগান বন্ধ করে দিলে প্রতিযোগিতার বাজারে টেকা সম্ভব হবে না, বন্ধ করে দিতে হবে৷''
গোটা বিশ্বে আরো বেশি দেশ নতুন পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে৷ সে কারণে পরমাণু প্রযুক্তি রপ্তানি রাশিয়ার অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
১৯৯৯ সাল থেকে রাশিয়া যে মাত্রায় জ্বালানি প্রযুক্তি বিদেশে বিক্রি করেছে, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সম্মিলিত অংকের চেয়েও বেশি৷ পরমাণু জ্বালানি উপদেষ্টা মাইকেল শ্নাইডার জানান, ‘‘২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে গোটাবিশ্বে ২৮টি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে৷ তার মধ্যে ১৭টি চীনে গড়ে উঠছে৷ বাকি ১১টি রাশিয়ার রোসআটম সংস্থা বিভিন্ন দেশে তৈরি করছে৷''
তার আগেও রোসআটম সক্রিয় ছিল৷ চীন, ভারত ও তুরস্কে তারা চারটি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছে৷ মিশর, বাংলাদেশ ও ইরানেও এমন কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে৷ এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ স্লোভাকিয়ায়ও এই রুশ সংস্থা একটি কেন্দ্র তৈরি করছে৷
ইউরোপীয় ও মার্কিন পরমাণু শিল্পক্ষেত্রও নতুন করে ভাবনাচিন্তা করছে৷ রাশিয়ার উপর থেকে নির্ভরতা কমানোই হলো লক্ষ্য৷ কিন্তু সেই সম্পর্ক ছিন্ন করতে অনেক বছর সময় লাগবে৷
মার্তা গ্রুন্ডজিনস্কা/এসবি
গত বছরের ছবিঘরটি দেখুন...