পরমাণু শক্তি ইস্যুতে ভারতে অস্বস্তি বাড়ছে – বিশেষ করে বেসামরিক পরমাণু প্রকল্পে৷ নতুন যে সব পরমাণু প্রকল্পের কাজ সরকার হাতে নিয়েছে, স্থানীয় মানুষজনের প্রতিবাদ বিক্ষোভে তার কাজ আপাতত স্থগিত৷
বিজ্ঞাপন
ভারতে পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে বাড়তে থাকা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক ইউকিয়া আমানোর ৫ দিনের ভারত সফর তাৎপর্যপূর্ণ৷ তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে যে সব নতুন পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ সরকার হাতে নিয়েছে, স্থানীয় লোকজনদের প্রতিবাদ বিক্ষোভে তার কাজ আপাতত স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে সরকার৷ আমানো ভারতের বিভিন্ন পরমাণু শক্তি দপ্তরের কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে পরমাণু কেন্দ্রগুলির নিরাপত্তার নতুন মাপকাঠি এবং অন্যান্য সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করবেন৷ কথা হবে ভারতের বিতর্কিত পরমাণু দায়বদ্ধতা ধারা নিয়ে৷
পরমাণু সরঞ্জাম সরবরাহকারী দেশগুলি ভারতের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নেয়ায় আন্তর্জাতিক পরমাণু চুল্লি সরবরাহকারী কোম্পানিগুলি এই ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে৷ চুল্লিতে দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ বর্তাবে সরবরাহকারী কোম্পানির ওপর৷ উল্লেখ্য, ভারতে এখন ২০টি পরমাণু চুল্লি চালু আছে৷ আরো ৭টি বসানো হচ্ছে৷ ২০৩২ সাল নাগাদ ভারতে পরমাণু বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৩ হাজার মেগাওয়াট৷
প্রতিবাদ আন্দোলন কেন?
কিছু এনজিও-র নেতৃত্বে পরমাণু প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী আশপাশের লোকজনদের বক্তব্য, তাদের প্রধান উদ্বেগ নিরাপত্তা৷ জাপানের ফুকুশিমা পরমাণু কেন্দ্রের দুর্ঘটনা তাদের ভীতি বাড়িয়ে দিয়েছে৷ তামিলনাড়ুর আন্দোলনকারীরা মনে করে, পরমাণু কেন্দ্রের বর্জ্য পদার্থ সমুদ্রের জলে মিশলে উপকূলবর্তী মৎসজীবীদের রুজি-রোজগার মার খাবে৷ মহারাষ্ট্রের আন্দোলনকারীদের মতে, বর্জ্য পদার্থে উপকূলের ম্যানগ্রোভ বা বাদাবন বিনষ্ট হবে৷ জৈব বৈচিত্র্য তথা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে৷ গুজরাটের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য৷ এই নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা হয় জনস্বার্থ মামলা৷ পশ্চিমবঙ্গের হরিপুরে রাজ্য সরকার পরমাণু কেন্দ্র বসানোর অনুমতি দেয়নি এইসব কারণে৷
ফুকুশিমার ছায়া
দুইবছর আগে ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নতুন করে ভেবেছে৷ কারও উপর আবার কোনো প্রভাবই পড়েনি৷
ছবি: Reuters/Kyodo
একইসঙ্গে সুনামি, ভূমিকম্প ও পরমাণু দুর্ঘটনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হয় দুই বছর আগে৷ সাগরের নীচে ৯.৩ মাত্রার ভূমিকম্পের পর উত্তরপূর্ব উপকূলে সুনামি তৈরি হয়৷ এতে কমপক্ষে ১৫,৮৮০ জন মারা যায়৷ আর আহত হয় ৬,১৩৫ জন৷ তবে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ২,৬৯৪ জন৷
ছবি: dapd
পরমাণু দুর্ঘটনা
সুনামির কারণে ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের শীতলীকরণ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়৷ এতে তিনটি চুল্লি অতিরিক্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে৷ আর তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে৷ ফলে সরকার ঐ বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশেপাশের ৩০ কিলোমিটার এলাকায় বসবাসরতদের সরে যেতে বলে৷ এখনো তারা ঘরে ফিরতে পারেনি৷
ছবি: Reuters/Kyodo
চেরনোবিল
ফুকুশিমার আগে ইউক্রেনের চেরনোবিল দুর্ঘটনা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক পরমাণু দুর্ঘটনা৷ ১৯৮৬ সালে ঐ কেন্দ্রের একটি চুল্লিতে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে সে ধ্বংস হয়ে যায়৷ ফলে ইউরোপ ও রাশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে৷ ঐ দুর্ঘটনায় ৩০ জন নিহত হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তারপরও পরমাণু বিদ্যুৎ
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চেরনোবিলের কথা সবাই ভুলে যায়৷ ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পরমাণু বিদ্যুতের দিকে ঝুঁকে পড়ে৷ এমনকি ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পরও যুক্তরাষ্ট্রে দুটি চুল্লি নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এমনকি জার্মানিও
জার্মানি এমনিতেই পরমাণু শক্তির চরম বিরোধী৷ তাই সাবেক চ্যান্সেলর গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার ২০২২ সালের মধ্যে পরমাণু শক্তি উৎপাদন বন্ধ করার পরিকল্পনা করেছিলেন৷ বর্তমান সরকার সেটা বাড়িয়ে ২০৩৪ পর্যন্ত করতে চেয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফুকুশিমা বদলে দিল সব
ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর জার্মানিতে পরমাণু শক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠায় আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সরকার তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়৷ ফলে এখন আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২২ সালের মধ্যেই সব পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে৷ জার্মানি ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ৮০ শতাংশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে৷
ছবি: picture alliance/Hinrich Bäsemann
ইটালিতেও পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ
জার্মানির মতো ইটালিও পরমাণু শক্তির ঘোর বিরোধী৷ চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর ১৯৮৭ সালে একটি গণভোটের মাধ্যমে ইটালীয়রা পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের পক্ষে ভোট দেয়৷ পরবর্তীতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি সেটা আবারও শুরু করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পরমাণু বিদ্যুতের পক্ষে ব্রিটেন
ব্রিটিশ সরকার পরমাণু বিদ্যুৎকে জ্বালানির একটা উৎস হিসেবে দেখছে৷ তাদের মতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে পরমাণু বিদ্যুৎ৷
ছবি: AP
চারগুণ বাড়াতে চায় ভারত
২০২০ সালের মধ্যে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন চারগুণ বাড়াতে চায় ভারত৷ সরকারের এই সিদ্ধান্ত ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়েছে৷ রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি হওয়া একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বিক্ষোভের কারণে মাঝেমধ্যেই বন্ধ রাখতে হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চীনের লক্ষ্যও একই
চীনও পরমাণু বিদ্যুতের উপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে৷ বর্তমানে দেশটির মোট চাহিদার মাত্র এক শতাংশ আসে পরমাণু বিদ্যুৎ থেকে৷ ২০২০ সালের মধ্যে এই হারটা চীন ছয় শতাংশে নিয়ে যেতে চায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশে প্রথম
পাবনার রূপপুরে বাংলাদেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হতে যাচ্ছে৷ রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি হতে যাওয়া এই কেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images
11 ছবি1 | 11
পরমাণু অস্ত্রের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা
পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে ভারত তার নীতি স্পষ্ট করেছে৷ যেমন, ভারত কখনই প্রথমে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে না৷ তবে আক্রান্ত হলে পাল্টা আঘাত হানবে দ্বিগুণ শক্তিতে৷ কোনো দেশ যদি ভারতের বিরুদ্ধে জীবাণু ও রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে, তাহলে পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের অধিকার থাকবে ভারতের৷ পরমাণু অস্ত্রহীন কোন দেশের বিরুদ্ধে ভারত পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে না৷ প্রতিরক্ষার জন্য পরমাণু অস্ত্রের কমান্ড ও কন্ট্রোল থাকবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে৷ পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগ নিবারণে ন্যূনতম পরমাণু অস্ত্র মজুত রাখা হবে৷ আন্তর্জাতিক পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ হতে হবে বৈষম্যহীন৷