পরমাণু শক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ভারতকে আন্তর্জাতিক শক্তিধর দেশগুলির সঙ্গে এক আসনে বসার মর্যাদা দেয়া হয়নি৷ সেই বাধা দূর করতে ভারত-ভিত্তিক পরমাণু রক্ষাকবচের অতিরিক্ত খসড়া চুক্তিটি অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মোদী৷
বিজ্ঞাপন
ভারতের পরমাণু নীতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে নতুন মোদী সরকার আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে ভারত-ভিত্তিক পরমাণু রক্ষাকবচ চুক্তির অন্তর্গত অতিরিক্ত প্রোটোকল দ্রুতাতার সঙ্গে অনুমোদনের কথা ঘোষণা করেছে৷ এটা না করায় পরমাণু শক্তিধর দেশ হয়েও অন্যান্য আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তিধর দেশুলির সঙ্গে একই বন্ধনীভুক্ত হতে পারেনি ভারত৷ পরমাণু উপকরণ সরবরাহকারী ৪৫টি দেশ-গোষ্ঠীর এক বৈঠকের আগে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা আইএইএ-র সঙ্গে ভারত-ভিত্তিক পরমাণু রক্ষাকবচ সংক্রান্ত অতিরিক্ত প্রোটোকলটি অনুমোদন করে মোদী সরকার সময়োচিত কাজ করেছে৷
তবে এটাও ঠিক যে, এর পুরো কৃতিত্ব মোদী সরকারের একার নয়৷ সিংহভাগ কৃতিত্ব দাবি করতে পারে পূর্বতন মনমোহন সিং সরকার৷ এর ভূমিগত যাবতীয় কাজ করে গেছে মনমোহন সিং সরকার৷ ভারত-মার্কিন বেসামরিক চুক্তি সই হওয়া থেকে তার খসড়া ও নির্ভরযোগ্য নথিপত্র তৈরি সবকিছুই করে গিয়েছেন মনমোহন সিং সরকার৷ শুধু ফলের অপেক্ষা ছিল৷ আর সেই কাজটাই সম্পন্ন করল মোদী সরকার৷ এর ফলে মোদী সরকার পরমাণু উপকরণ সরবরাহকারী দেশগোষ্ঠীর সদস্য হবার পথে এক কদম এগিয়ে গেল৷
ফুকুশিমার ছায়া
দুইবছর আগে ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নতুন করে ভেবেছে৷ কারও উপর আবার কোনো প্রভাবই পড়েনি৷
ছবি: Reuters/Kyodo
একইসঙ্গে সুনামি, ভূমিকম্প ও পরমাণু দুর্ঘটনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হয় দুই বছর আগে৷ সাগরের নীচে ৯.৩ মাত্রার ভূমিকম্পের পর উত্তরপূর্ব উপকূলে সুনামি তৈরি হয়৷ এতে কমপক্ষে ১৫,৮৮০ জন মারা যায়৷ আর আহত হয় ৬,১৩৫ জন৷ তবে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ২,৬৯৪ জন৷
ছবি: dapd
পরমাণু দুর্ঘটনা
সুনামির কারণে ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের শীতলীকরণ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়৷ এতে তিনটি চুল্লি অতিরিক্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে৷ আর তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে৷ ফলে সরকার ঐ বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশেপাশের ৩০ কিলোমিটার এলাকায় বসবাসরতদের সরে যেতে বলে৷ এখনো তারা ঘরে ফিরতে পারেনি৷
ছবি: Reuters/Kyodo
চেরনোবিল
ফুকুশিমার আগে ইউক্রেনের চেরনোবিল দুর্ঘটনা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক পরমাণু দুর্ঘটনা৷ ১৯৮৬ সালে ঐ কেন্দ্রের একটি চুল্লিতে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে সে ধ্বংস হয়ে যায়৷ ফলে ইউরোপ ও রাশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে৷ ঐ দুর্ঘটনায় ৩০ জন নিহত হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তারপরও পরমাণু বিদ্যুৎ
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চেরনোবিলের কথা সবাই ভুলে যায়৷ ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পরমাণু বিদ্যুতের দিকে ঝুঁকে পড়ে৷ এমনকি ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পরও যুক্তরাষ্ট্রে দুটি চুল্লি নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এমনকি জার্মানিও
জার্মানি এমনিতেই পরমাণু শক্তির চরম বিরোধী৷ তাই সাবেক চ্যান্সেলর গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার ২০২২ সালের মধ্যে পরমাণু শক্তি উৎপাদন বন্ধ করার পরিকল্পনা করেছিলেন৷ বর্তমান সরকার সেটা বাড়িয়ে ২০৩৪ পর্যন্ত করতে চেয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফুকুশিমা বদলে দিল সব
ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর জার্মানিতে পরমাণু শক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠায় আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সরকার তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়৷ ফলে এখন আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২২ সালের মধ্যেই সব পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে৷ জার্মানি ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ৮০ শতাংশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে৷
ছবি: picture alliance/Hinrich Bäsemann
ইটালিতেও পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ
জার্মানির মতো ইটালিও পরমাণু শক্তির ঘোর বিরোধী৷ চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর ১৯৮৭ সালে একটি গণভোটের মাধ্যমে ইটালীয়রা পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের পক্ষে ভোট দেয়৷ পরবর্তীতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি সেটা আবারও শুরু করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পরমাণু বিদ্যুতের পক্ষে ব্রিটেন
ব্রিটিশ সরকার পরমাণু বিদ্যুৎকে জ্বালানির একটা উৎস হিসেবে দেখছে৷ তাদের মতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে পরমাণু বিদ্যুৎ৷
ছবি: AP
চারগুণ বাড়াতে চায় ভারত
২০২০ সালের মধ্যে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন চারগুণ বাড়াতে চায় ভারত৷ সরকারের এই সিদ্ধান্ত ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়েছে৷ রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি হওয়া একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বিক্ষোভের কারণে মাঝেমধ্যেই বন্ধ রাখতে হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চীনের লক্ষ্যও একই
চীনও পরমাণু বিদ্যুতের উপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে৷ বর্তমানে দেশটির মোট চাহিদার মাত্র এক শতাংশ আসে পরমাণু বিদ্যুৎ থেকে৷ ২০২০ সালের মধ্যে এই হারটা চীন ছয় শতাংশে নিয়ে যেতে চায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশে প্রথম
পাবনার রূপপুরে বাংলাদেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হতে যাচ্ছে৷ রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি হতে যাওয়া এই কেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images
11 ছবি1 | 11
ভারত-ভিত্তিক পরমাণু রক্ষাকবচের অতিরিক্ত প্রোটোকল অনুমোদন করা জরুরি কেন? যেহেতু ভারত পরমাণু অস্ত্রপ্রসার রোধ চুক্তি এনপিটিতে সই করতে রাজি হয়নি, অর্থাৎ ভারত তার পরমাণু কেন্দ্রগুলি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার নিরীক্ষণের আওতায় রাখার অনুমতি দেয়নি, তাই বিশ্বের অন্য সব পরমাণু দেশগুলির সঙ্গে পরমাণু উপকরণের বাণিজ্য করা বা উন্নত পরমাণু প্রযুক্তি আমদানি করা ভারতের জন্য নিষিদ্ধ ছিল৷ অতিরিক্ত প্রোটোকল অনুমোদন করে ভারত বিশ্বকে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জোরাল বার্তা দিল যে, পরমাণু শক্তিধর হিসেবে ভারত এক দায়িত্বশীল এবং বিশ্বাসযোগ্য দেশ এবং ভারত-মার্কিন বেসামরিক পরমাণু চুক্তি বাস্তবায়নে দৃঢ়সংকল্প৷
শুধু তাই নয়, পরমাণু অস্ত্রপ্রসার রোধ চুক্তির প্রতি দায়বদ্ধ৷ এ বিষয়ে এনএসজি-র বিশেষ ছাড় পাবার যোগ্য এবং সেই নিরিখে ভারত এনএসজি-র সদস্যপদেরও দাবি করতে পারে৷ এর জেরে আইএইএ ভারতের বেসামরিক পরমাণু কেন্দ্রগুলির জ্বালানি ও রিঅ্যাক্টরগুলি খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করতে পারবে৷ সেজন্য ২০টি বেসামরিক পরমাণু কেন্দ্র চিহ্নিত করেছে দিল্লি৷
উল্লেখ্য, আগামী সেপ্টেম্বর মাসে ওয়াশিংটনে মোদী-ওবামা বৈঠকের জমি তৈরির পক্ষেও এটা সদর্থক পদক্ষেপ মোদীর৷ এ মাসে নতুন সংসদের যৌথ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক বেসামরিক পরমাণু চুক্তি বাস্তবায়িত করতে পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করা হবে৷ তবে একটা কাঁটা এখনো রয়ে গেছে৷ সেটা হলো ভারতের পরমাণু দায়বদ্ধতা বিল৷ তাতে পরমাণু কেন্দ্রে কোনোরকম দুর্ঘটনার জন্য দায়ী থাকবে পরমাণু উপকরণ সরবরাহকারি কোম্পানিগুলি৷ পরমাণু উপকরণ সরবরাহকারী দেশকে সেই শর্ত মানতে বাধ্য করা মোদী সরকারের পক্ষে এক চ্যালেঞ্জ৷ কোনো দেশই এই শর্ত মানতে রাজি নয়৷ কিন্তু জাপানের ফুকুশিমা বা রাশিয়ার চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর এটাকে হেলাফেলা করা যায় না কোনোমতেই৷