বাংলাদেশে কিশোরীদের এক তৃতীয়াংশ কোনো-না-কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে৷ এই তথ্য সংসদকে জানিয়েছেন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ৷
বিজ্ঞাপন
তবে শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠান ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স'-এর প্রধান নির্বাহী ডয়চে ভলেকে বলেছেন, বাংলাদেশে প্রতি ১০ জন মেয়ে শিশুর মধ্যে সাত জনই যৌন হয়ারানির শিকার৷ আর তারা প্রধানত পরিচিত পরিবেশেই এর শিকার হয়৷
সোমবার জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ জানান, ‘‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১৫-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সি কিশোরীদের মধ্যে ৩৪.২ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার৷ আর ৩০.৯ শতাংশ কিশোরী জীবনে কোনো-না-কোনো সময় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷''
নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা জানিয়ে মেহের আফরোজ সংসদকে জানান, ‘‘নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্প লাইন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে৷ টোল-ফ্রি হেল্প লাইন ১০৯২১ নম্বরে ফোন করে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু তাদের পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট সকলে প্রয়োজনীয় তথ্য, পরামর্শসহ দেশে বিরাজমান সেবা ও সহায়তা সম্পর্কে জানতে পারছে৷ চলতি বছর থেকে হেল্প লাইন নম্বরটি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পাঠ্যপুস্তকের কভারে সন্নিবেশ করা হয়েছে৷''
রোকসানা সুলতানা
বাংলাদেশে মেয়ে শিশুদের যৌন হয়রানির চিত্র আরো ভয়াবহ বলে মনে করেন ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স'-এর প্রধান নির্বাহী রোকসানা সুলতানা৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা আমাদের পর্যক্ষেণ এবং নমুনা জরিপে দেখেছি, প্রতি ১০ জন মেয়ে শিশুর মধ্যে সাতজনই যৌন হয়ারানির শিকার৷ আর এরা প্রধানত নিজেদের ঘরে বা পরিচিত পরিবেশেই যৌন হয়রানির শিকার হয়৷''
তিনি জানান, ‘‘সাধারণভাবে মনে করা হয় নিম্নবিত্ত পরিবার বা বস্তিতে এই প্রবণতা বেশি৷ বাস্তব চিত্র হচ্ছে, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত সব পরিবেশেই মেয়ে শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে৷আমাদের এই পর্যক্ষেণ ধর্ষণের বাইরে৷ ধর্ষণে বাইরের লোকরা জড়িত থাকে বেশি৷ আমরা ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে যৌন হয়রানির শিকার হওয়া যেসব মেয়ে শিশু আসে, তারা নিম্নবিত্ত পরিবারের৷ তবে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন এসব ঘটনা গোপন করে৷ তাই সাধারণভাবে মনে হতে পারে, নিম্নবিত্ত পরিবারে এই সমস্যা বেশি৷ আসলে তা সঠিক নয়৷''
রোকসানা সুলতানা আরো বলেন, ‘‘পরিচিত পরিবেশ বলতে আমরা আত্মীয়-স্বজনকেই বোঝাচ্ছি৷ এবং মেয়ে শিশুরা পুরুষ আত্মীয়দের দ্বারাই সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয়৷ শুধু আইন নয়, এটা প্রতিরোধে প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা৷''
যৌন হয়রানির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন শিশুকে
শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার৷ সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের৷ অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না পিশাচের থাবা৷ আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ৷ শুধু একটা অস্বস্তি থেকে যায় সারাটা জীবন৷
ছবি: picture alliance/abaca
ভয়াবহ অবস্থা ভারতে
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব৷ অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা৷ তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব৷
ছবি: Fotolia/Kitty
যেভাবে বোঝাবেন বাচ্চাদের
সহজ ভাষায় খেলা বা গল্পচ্ছলে শিশুদের এ বিষয়ে একটা ধারণা গড়ে তোলা যেত পারে৷ বাচ্চাদের বলতে হবে যে, তাদের শরীরটা শুধুমাত্র তাদের৷ অর্থাৎ কেউ যেন তাদের ‘গোপন’ জায়গায় হাত না দেয়৷ তাই কোনো আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিকর ঠেকলে, কেউ তাদের জোর ঘরে কোনো ঘরে নিয়ে গেলে, খেলার ছলে চুমু দিলে বা শরীরের কোথাও হাত দিলে – তা যেন মা-বাবাকে জানায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনিয়ে দিন যৌনাঙ্গ
অনেক বাবা-মা নিজ সন্তানের সঙ্গে যৌনাঙ্গ নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন৷ কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং খুব ছোটবেলাতেই ছবি এঁকে অথবা গল্পে-গানে বাচ্চাকে তার শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ, লিঙ্গ ইত্যাদি চিনিয়ে দিতে হবে৷ এমনটা করলে কেউ যদি তাদের সঙ্গে পিশাচের মতো ব্যবহার করে, তাহলে শিশুরা সহজেই বলতে পারবে কে, কখন, কোথায় হাত দিয়েছিল৷
ছবি: DW/S.Rahman
শিশুর কথা শুনুন, তার পক্ষ নিন
শিশু যাতে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে – সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনার বাচ্চা যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে বিকৃত সেই মানুষের কৃতকর্মের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন আর তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বার করে দিন ঐ ‘অসুস্থ’ লোকটাকে৷
ছবি: Fotolia/pegbes
স্কুলেরও দায়িত্ব আছে
বাচ্চারা দিনের অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়৷ তাই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায়৷ তবে স্কুলের মধ্যে, বিদ্যালয় চত্বরেও ঘটতে পারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা৷ তাই স্কুল থেকে ফেরার পর বাচ্চা যদি অতিরিক্ত চুপচাপ থাকে, একা একা সময় কাটায় বা পড়াশোনা করতে না চায়, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ জানতে চান কী হয়েছে, প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানান৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ছেলে-মেয়ে সমান!
আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ মেয়ে হলেই হাতে একটা পুতুল আর ছেলে হলে ধরিয়ে দেয়া হয় বল বা খেলনার পিস্তল৷ ছেলের পাতে যখন তুলে দেয়া হয় মাছের বড় টুকরোটা, তখন মেয়েটির হয়ত এক গ্লাস দুধও জোটে না৷ এ বৈষম্য বন্ধ করুন৷ বাবা-মায়ের চোখে ছেলে-মেয়ে সমান – সেভাবেই বড় করুন তাদের৷ তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে কীভাবে? কীভাবে কমবে শিশু নির্যাতন?