1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পরিবারের অন্তরালে নীরব সহিংসতার ছায়া

Lubna Ferdowsi – Wissenschaftlerin an der University of Hull
লুবনা ফেরদৌসী
২২ আগস্ট ২০২৫

পরিবারের অন্তরালে নীরব সহিংসতা বাংলাদেশের সমাজের একটি গোপন অথচ বিস্তৃত এবং বহুমাত্রিক সমস্যাকে প্রতিফলিত করে।

বিশেষ করে নতুন দম্পতিদের মধ্যে পরিবারিক চাপ, সামাজিক লজ্জা এবং আর্থিক নির্ভরতার কারণে অনেক নারী সহিংসতা সহ্য করেন, কিন্তু কাউকে জানান না। সমাজে ‘বিয়ের ভাঙা মর্যাদা' এবং ‘ইজ্জতের' ধারণা নারীদের ডিভোর্স বা বিচ্ছেদ চাওয়ার সাহসকে সীমাবদ্ধ করে।ছবি: Tinnakorn/imago images

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসে ৩৬৩টি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যাতে ৩২২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে৷ ১১৩ নারীর প্রাণ গেছে স্বামীর নির্যাতনে। এই সংখ্যা কেবল পরিসংখ্যান নয়; এটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আইনি ব্যবস্থার মৌলিক ব্যর্থতার স্পষ্ট প্রতিফলন। পারিবারিক সহিংসতা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বা দাম্পত্য দ্বন্দ্বের সীমাবদ্ধ বিষয় নয়; এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সমস্যা, যা সমাজের মূলনীতি, লিঙ্গভিত্তিক সামাজিকীকরণ এবং সাংস্কৃতিক মানদণ্ডের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

গবেষণা ও আন্তর্জাতিক সাহিত্যও এই বাস্তবতাকে সমর্থন করে। ওয়েইটজম্যান দেখিয়েছেন, সাবেক স্বামীদের ডিভোর্সের পর জীবনমান ৪২% বৃদ্ধি পায়, কিন্তু সাবেক স্ত্রীদের জীবনমান কমে যায় ৭৮%; এই বৈষম্য আজকের সমাজেও বিদ্যমান এবং বহু নারীর জন্য বিয়ে এখনো একটি অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন উল্লেখ করেছেন, নারীর বিবাহ থেকে বেরোনোর ক্ষমতা অসমান, যা স্বামী বা পুরুষ অংশীদারদের বিবাহে অসামান্য ক্ষমতা ও আলোচনার সুবিধা প্রদান করে। ওকিন-এর তত্ত্ব অনুযায়ী, পরিবারে নারীর অসম অবস্থান তার কর্মস্থল ও সামাজিক জীবনের অসাম্যের সঙ্গে আন্তঃসংযোগিত, এই ‘ঝুঁকিপূর্ণ চক্র' নারীর জীবন ও সিদ্ধান্তকে নির্ধারণ করে। জন স্টুয়ার্ট মিল-এর মতে, পরিবারে নারীর অবস্থান সামাজিক সমতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, কারণ পরিবারে লিঙ্গভিত্তিক প্রাধান্য শিশুকাল থেকেই পুরুষকে অগ্রাধিকার দেয়।

আইনের প্রান্তে—‘অনভ্রান্ত বিধান', ‘নীরব বাস্তবতা'

২০১০ সালের পরিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ছিল নারী–শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে একটি দূরদর্শী গুরুত্বপূর্ণ আইন; সামাজিক আন্দোলন এবং রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতির ফল। তবে আইনের কাঠামো গঠনের সেই অর্জন কেবল নামমাত্রই রয়ে যায়, প্রয়োগ এবং কার্যকর বাস্তবায়নে ভেঙে পড়ে। ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-এর বিশ্লেষণ স্পষ্ট করে, "পরিবারে সহিংসতা অনেক সময় ‘ঘরেরই অন্তরিক বিষয়' হিসেবে দেখা হয়, তাই সেবা প্রদানকারী এবং বিচারকারী বিভাগ তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে না”, ফলে আইনকে লোকসমাজে অমীমাংসিত ও তুচ্ছ করে ফেলা হয়। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট কাউন্টারিং ব্যাকল্যাশ-এর গবেষণায় দেখা গেছে, আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের মানসিকতায় এবং সামাজিক ধ্যানধারণায় পরিবর্তন না আসলে, ভূতপূর্ব বিধানই অব্যবহার্য হয়ে পড়ে। দ্য ডেইলি স্টার এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭২% নারী কখনোই অভিযোগ করেন না, আর মাত্র ৩.১% মামলা ভুক্তভোগীর পক্ষে রায় পায়। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া, অবহেলা, দুর্নীতি এবং পুরুষতান্ত্রিক মনোযোগের অভাব আইন প্রয়োগে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করে, যা ভুক্তভোগীদের জন্য প্রতিকার চাওয়া কঠিন করে তোলে। সহজভাবে বলতে গেলে, ধনী বা শক্তিশালী আদালত ব্যবস্থা না থাকলে, আইন নিজের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি রাখতে সক্ষম হয় না, এটাই আইন ও বাস্তবের মাঝের বৈষম্য, যেখানে ‘অনভ্রান্ত বিধান' থাকলেও, বাস্তবায়িত ‘নীরব বাস্তবতা' তা নির্মূল করে দেয় শুধুমাত্র।

সামাজিক কাঠামোর বিষ: ‘ইজ্জত' ও ধারাবাহিক নির্ভরতা

বিবাহ এবং ‘ইজ্জত' ধারণাটি আমাদের সমাজে শুধুমাত্র পারিবারিক মর্যাদা নয়, বরং একটি নিয়ন্ত্রণমূলক সামাজিক কৌশল হিসেবেও কার্যকর হয়। ‘ইজ্জত', যে ধারণায় নারীর আচরণ, চলাফেরা ও পোশাকের মাধ্যমে পরিবারের সম্মান নির্ধারণ করা হয়, এটি নারীর স্বাধীনতা ও আত্মপরিচয়ের ওপর সরাসরি আঘাত করে। এ ধরনের সামাজিক ধারণা নারীদের নিজের প্রতি সহিংসতা সহ্য করার মনোভাব গড়ে তোলে, যেমন, ভালো-মন্দের অতীত কথনীর বাইরে আদালতে যাওয়ার ধারণাটা অদ্ভুত মনে হতে পারে। পাশাপাশি ফারজানা রহমান ও এ.বি.এম. নজমুস সাকিব এর বিশ্লেষণ স্পষ্ট করে যে, এই পিতৃতান্ত্রিক সামাজিকীকরণের ফলে সহিংসতা স্বাভাবিকীকরণ ঘটে, যা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে চলে; কারণ নারীরা এমন আচরণকে ‘ঘরেরই নিয়ম' বলে অভ্যস্ত হয়ে যায়।

‘ইজ্জত' ধারণা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত, যেখানে নারীদের নিজেদের সংরক্ষণেও প্রভাব পড়ে, অর্থাৎ, তারা প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা চাওয়ার বিপরীতে ‘ঘরে শান্তি বজায় রাখা'কে বেশি মূল্য দেয়। এই প্রবণতা সমাজে সহিংসতার ধারাকে মোলায়েম করে ফেলে, যা সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। কনেল এর ‘হেজিমোনিক পিতৃতন্ত্র' তত্ত্ব অনুযায়ী, এমন সংহত কাঠামোই পুরুষের আধিপত্যকে সাংস্কৃতিকভাবে বৈধ করে তোলে। অথচ বাস্তবতায় নারীর ওপর সহিংসতা স্বাভাবিকভাবেই বিরত হচ্ছে, একটি সমাজ যা ‘ইজ্জত' ধারণার কাছে শালীনতার খাতায় হাত বুলিয়ে দেয়, সেটি সহিংসতাকে নামের বাইরে চলে যেতে সহায়তা করে, এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আইনগত অধিকার চাওয়া কঠিন করে দেয়।

সংক্ষেপে, ‘ইজ্জত' ও পারিবারিক নিভৃততার ধারণা, একটি সাংগঠনিক নির্যাতন এবং সামাজিক শোষণের রক্ষণাত্মক কাঠামো, যা তৈরি করে সহিংসতার একটি মৌলিক অনুমোদিত পরিধি।

অর্থনৈতিক নির্ভরতা: নারীর নিরাপত্তার বিপরীতে জীবনের নিরাপত্তা

বাংলাদেশে নারীর স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হলো অর্থনৈতিক নির্ভরতা, যেখানে শিক্ষার সুযোগ বা স্বনির্ভর আয় না থাকায় নারীরা প্রায়ই সহিংসতা সহ্য করতে বাধ্য হন বা নির্যাতনের মুখে "বাড়ি ফিরে যাওয়াটিই” একমাত্র বিকল্প মনে করেন। কারণ একা থাকা মানে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, নিরাপত্তাহীনতা ও আর্থিক বিপর্যয়।

গটমাচার ইনস্টিটিউটের গ্রামীণ গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ শিক্ষা থাকা নারীরা সহিংসতা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা দ্বিগুণ। কারণ, তারা নিজের পক্ষে কথা বলতে সক্ষম ও অর্থনৈতিক অসংরক্ষণ বাড়ে। শিক্ষা নারীর অবস্থান বদলাতে পারে, হয় দাম্পত্য থেকে বেরিয়ে আসার সামর্থ্যে, নয়তো গৃহে নিজের অবস্থান শক্ত করার ক্ষমতায়।

তবে, যখন নারী আয়ের উৎস বাড়ে, তখনও বৈরূপিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যেমন, গবেষণায় দেখা গেছে, যদি স্ত্রী স্বামীর চেয়ে বেশি আয় করে, তবে স্বামী তাকে একটা ক্ষমতার হুমকি হিসেবে মেনে নেন এবং সহিংসতা প্রলম্বিত হয়। অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা সরাসরি সহিংসতা হ্রাস করে না, বরং কাঠামোগত লিঙ্গ বৈষম্যকে আরো দৃঢ় করে তোলার পথ তৈরি করে।

পারিবারিক সহিংসতার শেকড় এবং বিস্তার

18:51

This browser does not support the video element.

এমনকি কিছু সমাজতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, অর্থনৈতিক স্বনির্ভর নারীরা সঞ্চয় বা শ্রমের ভূমিকা রাখলেও, শাশুড়ি বা স্বামীর বাড়ির লোকেরা প্রায়ই সেই স্বাধীনতাকে হুমকিস্বরূপ মেনে নেয়, শরীরিক, মানসিক, এবং আর্থিক সহিংসতার মাধ্যম হিসেবে।

অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার ক্ষেত্রে সরকার এবং এনজিও পর্যায়ে কিছু উন্নতি ঘটছে, যেমন, কাস্টিং সেভিংস গ্রুপের মতো উদ্যোগে নারীদের আয় ও সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষমতা বেড়েছে, পাশাপাশি সমাজে নেতৃত্ব নেওয়ার জায়গাও তৈরি হয়েছে। তবে, এই উন্নতি এখনো সংকীর্ণ, যেখানে শিক্ষাগত সুযোগ ও সামাজিক নেটওয়ার্কের অভাব এক রেখায় সংযুক্ত প্রতিরোধের পথ বন্ধ করে দিচ্ছে।

সুতরাং, নারীর নিরাপত্তায় শুধু "নির্ধারিত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা” নয়, বরং সমাজে ও পরিবারে সাংগঠনিক ক্ষমতায়ন, আইন ও সম্পদে প্রবেশাধিকার, এবং সামাজিক মেনে না নেওয়ার সংস্কৃতি, এসবের সমন্বিত পরিবর্তন অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে।

পর্দা ও চলাচলের সীমাবদ্ধতা: ‘সুরক্ষায়' বিভাজিত স্বাধীনতা

পর্দা ও চলাচলের সীমাবদ্ধতা নারীর স্বাধীনতার আড়ালে থাকা একটি কঠিন বাস্তবতা, যা প্রায়শই ‘সুরক্ষার' খেতাবের আড়ালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সামাজিক ব্যবস্থায় নারীর চলাচল সীমিত করা হয় যেমনটি মনে করা হয় তার সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন, অথচ বাস্তবতায় এটি তাকে সহায়তা চাইবার বা জরুরি সেবা গ্রহণের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। যে পরিবেশে নারীর শারীরিক উপস্থিতি ও সামাজিক অংশগ্রহণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত, সেখানে স্বাস্থ্যসেবা, আইনি সহায়তা, অর্থনৈতিক সুযোগ বা মানসিক সহায়তা গ্রহণ প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। নারীর স্বাধীনতা ‘বিভাজিত' অবস্থায় থাকে, যেখানে ঘরের ভেতরের নিরাপত্তা ও বাইরে সুরক্ষা একত্রিত হয় না, বরং একটি মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংগঠনিক বন্দিত্ব সৃষ্টি করে। এর সঙ্গে জড়িত থাকে অর্থনৈতিক নির্ভরতা, সামাজিক সম্মানবোধ এবং সাংস্কৃতিক ধ্যান-ধারণা, যা নারীর বিচারচাওয়া ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।

দাম্পত্যে সহিংসতায় সামাজিক নান্দনিকতা ও প্রতিরোধের সক্ষমতা

দাম্পত্যে নির্যাতনের পেছনে শুধু ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নয়, বরং সমাজ ও সামাজিক কাঠামোর বর্ধিত দায়বদ্ধতা কাজ করে, যেখানে নারীর বিচার চাওয়া বা সাহায্য চাওয়ার ক্ষমতা বিভিন্নভাবে দমিয়ে ফেলা হয়। বিশেষ করে, বিচার বা সহায়তা চাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা অনেক সময় ‘পরিবারের সম্মানের' ধারণা বা "এই বিষয়টি বাইরে যাবে না” জাতীয় সামাজিক চাপ না পারার কারণে নীরবতা বজায় রাখেন। তথ্য অনুসারে, ‘আবাসিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন' (২০১০) প্রণীত হয়েছে, তথাপি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত রয়েছে কারণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নৈতিক বা সামাজিক দায়বদ্ধতায় অনীহা দেখায়। এ ছাড়া, মহিলা নির্যাতন বিষয়ে জাতীয় জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ নারীর জীবনে অন্তত একবার পারস্পরিক সহিংসতা দেখা গেছে, কিন্তু ৬৪ শতাংশই কাউকে কিছু জানায়নি।

আমার লন্ডনের এথনোগ্রাফিক অভিজ্ঞতায় ব্রিটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে দেখা গেছে, নতুন বাংলাদেশি অভিবাসী নারীরা যারা বিবাহের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে আসেন, তারা বহু ক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার হয়। কিন্তু লজ্জা, সামাজিক চাপ এবং পারিবারিক নীতির কারণে প্রায়ই কেউকে কিছু জানায় না। অনেক ক্ষেত্রে পরিবার জানলে তাদের বলা হয়, "মা-বাবা বলেছে, ডিভোর্স নিয়ে দেশে যেন না ফিরি, উনারা মুখ দেখাতে পারবেন না।” এই প্রেক্ষাপটে, ভিকটিমদের মধ্যে স্টকহোম সিন্ড্রোম-এর প্রকৃতিও লক্ষ্য করা যায়। ভিকটিমরা মান, সম্মান, আর্থিক নিরাপত্তা বা স্টকহোম সিন্ড্রোমের কারণে নির্যাতনকে জীবনের অংশ হিসেবে স্বাভাবিক মনে করে। স্টকহোম সিন্ড্রোম একটি মানসিক প্রতিক্রিয়া, যা ভিকটিম ও নির্যাতনকারীর মধ্যে ঘটে, যেখানে ভিকটিম নির্যাতনকারীর প্রতি ইতিবাচক অনুভূতি রাখে। ব্রিটেনের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭৪ শতাংশ নারী দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনৈতিক কারণে তাদের নির্যাতনকারীর সঙ্গে থাকে।

বাংলাদেশের নারীর ক্ষেত্রেও অনুরূপ বাস্তবতা দেখা যায়। বিশেষ করে নতুন দম্পতিদের মধ্যে পরিবারিক চাপ, সামাজিক লজ্জা এবং আর্থিক নির্ভরতার কারণে অনেক নারী সহিংসতা সহ্য করেন, কিন্তু কাউকে জানান না। সমাজে ‘বিয়ের ভাঙা মর্যাদা' এবং ‘ইজ্জতের' ধারণা নারীদের ডিভোর্স বা বিচ্ছেদ চাওয়ার সাহসকে সীমাবদ্ধ করে। ফলে, নির্যাতন দীর্ঘ সময় পর্যন্ত স্বাভাবিক মনে করা ভিকটিমের মানসিক ও সামাজিক জীবনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে।

অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, যেমন আয়-ক্ষমতার ঘাটতি, কর্মসংস্থানের অভাব, নিজের ব্যবস্থাপনায় অক্ষমতা, নারীদের নির্যাতন থেকে বেরিয়ে আসার পথকে আরো কঠিন করে তোলে। শেল্টারে যাওয়ার বিল, আইনি প্রক্রিয়ার খরচ, নতুন জীবন গড়ার জন্য যাতায়াতের খরচ প্রায়ই তাদের দমিয়ে রাখে। ফলে, "তুই পালালে মানা যায়” ধরনের সামাজিক ও বাস্তবিক ধারণা কার্যকরভাবে কাজ করে, কারণ নিরাপত্তার অভাবে নারীরা তাদের স্বার্থক প্রতিরোধ শক্তি ক্রমে হারিয়ে ফেলেন।

সামাজিক সম্মানবোধ, আইনের কার্যকারিতা, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, সব মিলিয়ে নারীর প্রতিবাদ করার সক্ষমতাকে স্তিমিত করে এবং সহিংসতা সামাজিকভাবে স্বাভাবিকীকৃত হয়। এই জটিল বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ শুধুমাত্র আইনি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগের মাধ্যমে সম্ভব নয়; প্রয়োজন সমাজের কাঠামোগত, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার সমন্বিত পরিবর্তন।

যৌথ প্রতিরোধের রূপরেখা: কাঠামোগত সমাধান

এই প্রেক্ষাপটে যৌথ প্রতিরোধের রূপরেখা গড়ে তোলা অপরিহার্য। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন ও দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া, শেল্টার হোম এবং প্রোটেকশন অর্ডারের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বৃদ্ধির উদ্যোগ, সামাজিক সচেতনতা ও ‘ইজ্জত' বনাম ‘অধিকার' বিষয়ক সংস্কার, পুরুষদের ‘অ্যাপস্ট্যান্ডার' বা সক্রিয় সহায়কের ভূমিকায় উৎসাহিত করা এবং পারিবারিক স্থানিক গতিশীলতা বৃদ্ধি করে সহিংসতার বিরুদ্ধে কার্যকর ক্ষমতা তৈরি। এই ধরনের কাঠামোগত এবং বহুমাত্রিক সমাধান ছাড়া শুধুমাত্র আইনের বিধান বা শিক্ষাগত উদ্যোগই যথেষ্ট নয়।

উপসংহার: না দেখার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা

সমাজে ‘না দেখার' সংস্কৃতি, অর্থাৎ নীরবতা, উদাসীনতা এবং সহিংসতার স্বাভাবিকীকরণ ভাঙতে হলে প্রয়োজন সমন্বিত সামাজিক প্রতিরোধ, যেখানে আইন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক সচেতনতা এবং সাংস্কৃতিক সংস্কার একত্রিতভাবে কাজ করবে। প্রতিটি নারী যাতে নিজের জীবনে নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে, সেই লক্ষ্যেই এই কাঠামোগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা আবশ্যক।

লুবনা ফেরদৌসী মাল্টি ডিসিপ্লিনারি সায়েন্টিস্ট, হাল ইউনিভার্সিটির হেলথ ট্রায়াল ইউনিটে গবেষণা বিজ্ঞানী
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ