বিকল্প ও পরিষ্কার জ্বালানির উৎস হিসেবে হাইড্রোজেনের গুরুত্ব বাড়ছে৷ কিন্তু সেই জ্বালানি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কার্বন ফুটপ্রিন্ট বিতর্কিত বিষয়৷ সবুজ হাইড্রোজেন উৎপাদন প্রক্রিয়া এখনো জটিল ও ব্যয়বহুল৷
বিজ্ঞাপন
হাইড্রোজেন কি ভবিষ্যতের প্রধান জ্বালানি হয়ে উঠতে পারে? ইউরোপে জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানির বিকল্প হিসেবে হাইড্রোজেন বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে৷ রটারডাম শহরের এই বন্দরে সেই দিশায় কাজ চলছে৷ অপারেটর কোম্পানি গোটা বন্দর জুড়ে বিশাল এক হাইড্রোজেন-ভিত্তিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে৷
এই উদ্যোগের মাধ্যমে রটারডামকে এক আন্তর্জাতিক হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে৷ সেখান থেকেই ইউরোপের অন্যান্য দেশে হাইড্রোজেন উৎপাদন, আমদানি ও পরিবহণের ব্যবস্থা করা হবে৷
কিন্তু জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন কি সত্যি পরিবেশবান্ধব? আসলে হাইড্রোজেনের নিজস্ব কোনো রং নেই৷ তবে উৎপাদন প্রক্রিয়া অনুযায়ী সেটিকে ধূসর, নীল অথবা সবুজ রংয়ে চিহ্নিত করা হয়৷
বর্তমানে উৎপাদিত হাইড্রোজেনের বেশিরভাগ অংশই ধূসর৷ প্রাকৃতিক গ্যাস এবং কয়লার মতো জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি থেকেই সেটি উদ্ধার করা হয়৷ নোংরা এই উপাদান উৎপাদনের সময়েও বিশাল পরিমাণে কার্বন নির্গমন হয়৷
পরিবেশবান্ধব খাদ্যের টুকিটাকি
পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য রাখতে পরিবেশে সচেতনতার বিষয়টি এখন মুখে মুখে৷ প্রতিটি জনপদ থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে এই ধ্বনি৷ খাদ্য উৎপাদন কিংবা গ্রহণের মধ্য দিয়েও পরিবেশের সুরক্ষা সম্ভব৷ পরিবেশবান্ধব খাদ্য নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: DW/V. Kern
প্রাকৃতিক খাদ্য
মাংস দূষণ কেলেঙ্কারি কিংবা কৃষিতে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব-এসব মাথা নিয়ে মানুষ এখন দিনকে দিন নিরামিষভোজী হয়ে উঠছেন৷ তবে প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেও আহারের আরো কিছু উপায় আছে৷ আলপাইনের মতো তৃণভূমি হয়তো সবখানে নেই! কিন্তু অবারিত প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠা প্রাণীজ মাংসের পণ্য এখন হাতের কাছেই মিলছে৷
ছবি: imago/Eibner
নিরামিষভোজী
উনিশ শতকের ৭০ কিংবা ৮০-র দশকের কথা যদি ধরি, তখনকার নিরামিষভোজীরা যেকোনো প্রাণিজ্য খাদ্য থেকে দূরে থাকতেন৷ এমনকি দুধ, ডিমের মতো সাধারণ খাবারও তাঁরা খেতেন না৷ সময়ের সঙ্গে বদলে যায় সবকিছু৷ জোনাথন সাফরান ফুয়েরের ‘ইটিং অ্যানিমেল’ বইটিতো মাংস নিয়ে মানুষের ভাবনাকে নাড়িয়ে দিয়েছে৷ গোটা বিশ্বে বেড়েই চলেছে নিরামিষ রেস্তোরাঁ৷
ছবি: DW/V. Kern
কার্বন ও পানির প্রভাব
নিরামিষ ভোজনের ভালো দিক হলো কার্বন নির্গমণটা কমিয়ে দেয়, তেমনি সাশ্রয় করে পানি৷ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসেব তো চমকে দেয়ার মতো৷ সংস্থাটি বলছে, মানুষের কারণে সৃষ্ট গ্রিনহাউজ গ্যাসের এক পঞ্চমাংস আসে মাংস থেকে৷ যা জলবায়ু পরিবর্তনে রাখছে নেতিবাচক ভূমিকা৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাত্র এক কেজি গরুর মাংস উৎপাদনে ১৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়৷
ছবি: Fotolia/Janis Smits
জেনে শুনে বুঝে নিন
ক্রেতাকে কাছে টানতে জীবন্ত পশু দেখিয়ে বিক্রি করে পোস্টডামের একটি খামার৷ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পশু জবাইয়ের আগে ক্রেতার সঙ্গে আলোচনা করে নেয় তাঁরা৷ যদিও তাঁদের কার্যক্রমটি আশপাশের এলাকাতে সীমাবদ্ধ৷ ‘মাইনে ক্লাইনে ফার্ম’ বা ‘আমার ছোটো খামার’ ধরণের প্রকল্পগুলোও যানবাহন নির্ভরতা সংকুচিত করে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমণকে কমিয়ে আনে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কৃষি হাট
স্থানীয় পণ্য স্থানীয়রা কিনে নিলে দীর্ঘ পথে পণ্য পরিবহনের ঝুট ঝামেলা মিটে যায়৷ ফলে কার্বন ফুটপ্রিন্টও কমে যায়৷ ক্যানাডিয়ান দম্পতি অ্যালিসা স্মিথ এবং জে বি ম্যাককিনন তাঁদের ‘হান্ড্রেড মাইল ডায়েট: আ ইয়ার অব লোকাল ইটিং’ বইতে এ বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরেছেন৷ তাঁদের বাড়ি থেকে শত মাইলের মধ্যে খাবার যোগাড় করে বছর জুড়ে খেয়েছেন এই দম্পতি৷ নিজেরা খাবার সংরক্ষণ করে পূরণ করেছেন শীতকালের কঠিন সময়৷
ছবি: DW/E. Shoo
একফসলি চাষ ঝুঁকিপূর্ণ
আধুনিক কৃষি শিল্পে ভূট্টা কিংবা সয়ার মতো একফসলি চাষ লক্ষ্যণীয়৷ এর ফলে শস্যদানা সংক্রমতি হয় নানা রোগবালাইয়ে আর আক্রমণ করে কীটপতঙ্গ৷ ফলে প্রচুর কীটনাশক দিতে হয় চাষীকে৷ একমুখী চাষের বদলে বৈচিত্র্য আনা হলে ভালো ফলন যেমন হয়, তেমনি কীটপতঙ্গের সংক্রমণও কমে যায়৷ খরার দিনেও ফলন নিয়ে টেনশনে থাকতে হয়না কৃষককে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বার্লিনের প্রিন্সেস গার্ডেন
বড় শহরে থেকেও নিজের চাহিদা কিংবা তারও বেশি পরিমাণ শস্য উৎপাদন খুব একটা কঠিন কাজ নয়৷ জার্মানির রাজধানী বার্লিনের মতো শহরে ‘প্রিন্সেস গার্ডেন‘ সেই দৃষ্টান্ত রেখে চলেছে৷ শস্য উৎপাদন করে নিজেদের চাহিদা তো মিটছে, সঙ্গে দুপুরের খাবারও বিক্রি করছে তাঁরা৷ বাণিজ্যিক ব্যবহার বাড়াতে খোলা হয়েছে একটি ক্যাফে৷ এই বাগানটি যেমন তাজা খাবারের চাহিদা পূরণ করছে তেমনি পরিবেশ সম্পর্কেও বাড়াচ্ছে সচেতনতা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খাদ্যবর্জ্য কমান, সম্পদ বাঁচান
পরিসংখ্যান বলছে, বছরে ২০ মিলিয়ন টন খাবার নষ্ট করে জার্মানি৷ তাই ভাগাভাগি করে খাওয়াকে পরিবেশবান্ধব প্রবণতা হিসেবে দেখা হচ্ছে৷ রেস্তোরাঁ আর মুদি দোকানিরাও অনেক খাবার দান করছে৷ জার্মানিতেই আছে foodsharing.de নামের একটি ওয়েব পোর্টাল৷ কারো কাছে অতিরিক্ত খাবার থাকলে এই পোর্টালের মাধ্যে বিনিময় করার সুযোগ থাকছে৷ ফলে খাবার নষ্ট হওয়ার পরিমাণ কিছুটা হলেও কমে আসছে৷
ছবি: Dietmar Gust
সুস্থ থাকার সুবিধা
খাদ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরামিষভোজী হওয়াটা ভালো সিদ্ধান্ত৷ অনেকগুলো গবেষণা বলছে, প্রতিদিনের খাবার তালিকা থেকে মাংসের পরিমাণ কমিয়ে আনা হলে ক্যান্সার, হৃদরোগ, মুটিয়ে যাওয়া এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যাবে৷
ছবি: dream79 - Fotolia.com
9 ছবি1 | 9
নীল হাইড্রোজেনও আসলে ধূসর৷ এটির উৎসও জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি৷ তবে উৎপাদনের সময় জলবায়ুর জন্য ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস আলাদা করে গ্যাসের আধারে জমা রাখা হয়৷ ফলে এ ক্ষেত্রে কার্বন ফুটপ্রিন্ট অনেক কম৷
পানি থেকে যে হাইড্রোজেন উদ্ধার করা হয়, সেটিকে সবুজ রংয়ে চিহ্নিত করা হয়৷ এই উৎপাদন প্রক্রিয়াকে টেকসই বলা চলে৷ অরোরা এনার্জি রিসার্চ সংস্থার আলেক্সান্ডার এসার এ বিষয়ে বলেন, ‘‘অণু এইচটু হওয়ার কারণে সব হাইড্রোজেনই আসলে এক৷ তবে ভিন্ন উৎপাদন প্রক্রিয়ার উপর গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা এবং সেইসঙ্গে হাইড্রোজেনর পরিচ্ছন্নতা নির্ভর করে৷’’
হাইড্রোজেন থেকে জ্বালানি
04:36
ইলেকট্রোলিসিস প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে পানিকে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনে ভাগ করা হয়৷ বিদ্যুতের সাহায্যে সেটা সম্ভব হয়৷ সেই বিদ্যুতও কিন্তু সব ক্ষেত্রে নির্গমনমুক্ত প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত হয় না৷ বিদ্যুতের উৎস বায়ু বা সূর্যের মতো বিকল্প জ্বালানি হলে তবেই হাইড্রোজেনকে টেকসই বলা চলে৷
অর্থাৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ার সময় একেবারেই কোনো কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন চলবে না৷ পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে উৎপাদন করলে তবেই সেই হাইড্রোজেনকে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই বলা চলে৷
কিন্তু কোনো দেশ নিজস্ব শক্তিতে সবুজ হাইড্রোজেনের চাহিদা মেটাতে না পারলে কী হবে? জার্মানিতে বায়ু ও সৌরশক্তি কাজে লাগিয়ে যথেষ্ট জ্বালানি উৎপাদন করা হচ্ছে৷ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৫০ সাল পর্যন্ত দেশটিকে প্রায় সাড়ে চার কোটি টন হাইড্রোজেন আমদানি করতে হবে৷ অথচ জাহাজ বা পাইপলাইনের মাধ্যমে দূর থেকে সরবরাহের সময় পরিবেশের বাড়তি ক্ষতি হলে চলবে না৷ আলেক্সান্ডার এসার মনে করেন, ‘‘আমাদের এক আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন প্রণালীর প্রয়োজন রয়েছে, যাতে সবুজ জ্বালানি ব্যবহার করে হাইড্রোজেন উৎপাদনের স্পষ্ট প্রমাণ দেখানো যায়৷ এখনো এমন কোনো ব্যবস্থা নেই৷ এ ক্ষেত্রে ঐকমত্যের অভাব রয়েছে৷’’
দ্রুত সবুজ হাইড্রোজেনের পথে অগ্রসর হবার ক্ষেত্রে বিপুল ব্যয়ভারও একটা বড় সমস্যা বটে৷ ‘নাউ’ উদ্যোগের প্রধান কুয়র্ট-ক্রিস্টফ ফন ক্নোবেল্সডর্ফ বলেন, ‘‘প্রচলিত জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি নিয়ন্ত্রণের কাঠামোর সঙ্গে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সবুজ অথবা নীল হাইড্রোজেনের তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে ব্যয়ের মাত্রা অত্যন্ত বেশি৷’’
অন্যদিকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবুজ হাইড্রোজেনের মূল্যও কমে যাবে৷ পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৩০ সাল পর্যন্ত সেই মূল্য অর্ধেকের বেশি কমে যাবার কথা৷
এখনো পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলিতে বড় আকারে সবুজ হাইড্রোজেন উৎপাদিত হচ্ছে না৷ কার্বন-ডাই-অক্সাইড জমা রেখে নীল হাইড্রোজেন উৎপাদন প্রক্রিয়া বহু বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ থাকবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা৷