প্লাস্টিক ব্যাগ সহজে ছেঁড়ে না, অনেক জিনিসও আঁটে৷ কিন্তু ব্যবহারের পর এগুলিকে দেখা যায় বিভিন্ন পার্কে ও জলাশয়ে৷ যার পরিণতি হয় মারাত্মক৷ বার্লিনের এক ছাত্রী প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের গতি রোধ করতে উদ্যোগ নিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
প্রথমে পড়াশোনার পাশাপাশি কাজটি নিয়েছিলেন শ্টেফানি আলব্রেশট৷ বার্লিনে একটি পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থার পক্ষ থেকে প্লাস্টিকের বদলে পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যাগ নিতে রাস্তাঘাটে মানুষকে বোঝাতে হতো তাঁকে৷
পরিবেশ দূষণে অগ্রণী
শুধু জার্মানির রাজধানী বার্লিনেই দোকানপাট ও বাজারে ঘণ্টায় ৩০,০০০ পাতলা ব্যাগ মানুষকে দেওয়া হচ্ছে৷ অর্থাৎ বছরে ২৫৯ মিলিয়ন ব্যাগ৷ এতে ভরা হয় ফলমূল, তরিতরকারি, মাছ মাংস, ওষুধপত্র, বইপত্র, কাপড়চোপড় ইত্যাদি৷ সারা জার্মানিতে দৈনিক ১৭ মিলিয়ন ও বছরে প্রায় ছয় বিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করা হয়৷
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একবার ব্যবহারের পরই আবর্জনা হিসাবে ফেলে দেওয়া এগুলিকে, যা দূষণ করে পরিবেশকে৷
শ্টেফানি আলব্রেশট প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়াশোনা করছেন৷ তিনি সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড় চোপড় কেনেন, বাগানে তরিতরকারি লাগান৷ এইভাবে আবর্জনা পরিহার করার চেষ্টা করেন এই তরুণী৷ কিন্তু প্লাস্টিক ও অপরিশোধিত তেল নিয়ে মাথা ঘামাননি আগে৷
এব্যাপারে রাস্তাঘাটে অপরিচিত ব্যক্তিদের বোঝাতে গিয়ে শ্টেফানি নিজেও সচেতন হয়ে ওঠেন৷ প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যাগ সম্পর্কে পড়াশোনা করে জানতে পারেন, জার্মানির সারা বছরের প্রয়োজন মেটাতে এই ব্যাগের জন্য প্রায় ২৬০ লিটার ভূগর্ভস্থ তেল ব্যবহার করা হয়৷
প্লাস্টিকের ব্যাগ কি শুধুই ব্যাগ?
বাজার করার জন্য একবার ব্যবহার করা যায়, এমন প্লাস্টিকের ব্যাগ হামেশাই দেখা যায় যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর৷ ‘ওয়ান-টাইম’ প্লাস্টিক ব্যাগের জায়গায় সুতি, চট বা কাগজের ব্যাগও হতে পারে৷ ছবিঘরে কিছু ব্যাগের নমুনা দেখুন!
ছবি: DUH
সব সময় শুধু প্লাস্টিক নয়
সুপারমার্কেটগুলিতে ফল বা সবজি কেনার সময়, এই যেমন ধরুন কলা, আপেল বা গাজর কেনার সময়, হাতের কাছেই রাখা থাকে প্লাস্টিকের ব্যাগ৷ সেই ব্যাগে পছন্দের ফল বা সবজিগুলি ভরে ওজন করে নিয়ে যেতে হয় কাউন্টারে৷ এভাবেই মাথা পিছু বছরে প্রায় ৭১টি প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করেন জার্মানরা৷
ছবি: Fotolia/pizzicati
দূরে থাকুন
সাধারণ প্লাস্টিকের ব্যাগগুলির শতকরা ১০০ ভাগই কৃত্রিম পলিথিনের, যা জীবাশ্মের অপরিশোধিত তেল থেকে তৈরি৷ এই ব্যাগগুলো মোটেই পরিবেশবান্ধব নয় এবং এগুলো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ বছর সময় লাগে৷ এ কারণেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবেশ বিষয়ক কমিশন প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানায়৷
ছবি: picture alliance/ZB
‘অর্গানিক’ যে সব সময় ভালো, তা নয়
জৈবিক উপায়ে ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়, এমন প্লাস্টিক ব্যাগও পাওয়া যায় আজকাল৷ তবে সেই সব প্লাস্টিকের ব্যাগ সাধারণত শতকরা ৭০ ভাগ অপরিশোধিত তেল এবং ৩০ ভাগ নবায়ণযোগ্য কাঁচামাল থেকে তৈরি৷ শুনতে ভালো লাগলেও, এ ধরণের প্লাস্টিকের ব্যাগ ‘রিসাইক্লিং’ করার ক্ষেত্রেও কিন্তু সীমাবদ্ধতা আছে৷
ছবি: picture-alliance/ZB
রিসাইক্লিং-এর ভাগ বেশি থাকাও যথেষ্ট নয়
একবার ব্যবহার করা যায়, এমন প্লাস্টিকের ব্যাগে রয়েছে শতকরা ৭০ ভাগ রিসাইক্লিং পলিথিন৷ এগুলি সাধারণ প্লাস্টিক ব্যাগের তুলনায় কিছুটা যে পরিবেশবান্ধব – তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু জার্মানিতে বেশিরভাগ প্লাস্টিক ব্যাগই আবর্জনায় ফেলে দেওয়া হয়, তাই উপায় থাকলেও রিসাইক্লিং করা হয় না বা যায় না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ভালোর চেয়ে মন্দই বেশি
অন্যদিকে কাগজের ব্যাগ যে সব সময়ই পরিবেশবান্ধব, অর্থাৎ কৃত্রিম ব্যাগের তুলনায় ভালো – তাও কিন্তু নয়৷ কারণ, এ সব ব্যাগ তৈরিতে অনেক বেশি সময় এবং ব্লিচিং করার জন্য শক্তিশালী রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়, যা পরবর্তীতে আবারো রাসায়নিক উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করতে হয়৷ এতে কিছুটা হলেও দূষণ ঘটে৷
ছবি: PA/dpa
কাপড়ের ব্যাগের অন্য দিক
কাপড়ের ব্যাগ যদি সুতির হয়, তাহলে সেগুলি বেশ মজবুত হয় এবং পরিবেশ রক্ষাতেও ভূমিকা রাখে৷ কিন্তু এ ধরণের ব্যাগ তৈরির জন্য একদিকে যেমন বেশি মাত্রায় কাঁচামাল প্রয়োজন হয়, তেমনই প্রয়োজন হয় বেশি পরিমাণে জ্বালানি৷ বলা বাহুল্য, এর একটা প্রভাবও পড়ে পরিবেশের ওপর৷
ছবি: Fotolia/Robert Kneschke
আছে মজবুত প্লাস্টিকের ব্যাগও
কাপড়ের ব্যাগের তুলনায় কৃত্রিম বা পলিয়েস্টারের ব্যাগ কিন্তু কম মজবুত নয়৷ ‘ওয়ান টাইম ইউজ’ বা ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’ – এমন ব্যাগ ছাড়াও বাজারে কয়েকবার ব্যবহারযোগ্য কৃত্রিম প্লাস্টিকের ব্যাগও পাওয়া যায়৷ এই যেমন ছবির ব্যাগটি৷ তবে এগুলো কতটা পরিবেশবান্ধব – সেটা বলা কঠিন৷
ছবি: DUH
বিজয়ী হচ্ছে...
তাই সত্যিকার অর্থে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ হচ্ছে পলিয়েস্টারের তৈরি এই হাল্কা ব্যাগগুলি৷ এগুলির ওজন মাত্র ৩০ গ্রাম এবং ভাঁজ করলে এগুলো একেবারে হাতের মুঠোয় রাখা সম্ভব৷ এই ব্যাগ দেখতে ছোট এবং ওজনে কম হলেও প্রায় ১০ কেজি ওজনের জিনিস বহন করতে পারে৷
ছবি: DUH
8 ছবি1 | 8
অন্যদিক প্লাস্টিকের সুবিধাও অনেক: সস্তায় তৈরি করা যায়, জায়গা কম নেয়, সহজে ছেঁড়ে না, পানি ও রাসায়নিক দ্রব্য প্রতিরোধী ও হালকা৷ তবে প্রায়ই বিনা পয়সায় পাওয়া যায় বলে রিসাইক্লিং না করে ফেলে দেওয়া হয় এসব ব্যাগ৷
প্রকৃতিতে মিশে যেতে সময় লাগে
সমীক্ষায় জানা গেছে, প্রকৃতিতে প্লাস্টিক মিশে যেতে ১০০ থেকে ৫০০ বছর লেগে যায়৷ মাইক্রো অর্গানিজম বা অণুজীবরা এগুলি নষ্ট করতে পারে না৷ আবহাওয়ার কারণে ছোট ছোট টুকরা হয়ে বাতাসে বা পানিতে ভাসতে থাকে এইসব ব্যাগ, যা পরিবেশ ও প্রাণিজগতের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে৷
প্লাস্টিকের ব্যাগ, বোতল, আসবাবপত্র, দাঁতের ব্রাশ ইত্যাদি পানিতে পড়ে একটা আস্তরণের মতো হয়ে যায়, ঢেকে ফেলে দৃষ্টি৷ এরফলে জলজ প্রাণীগুলির করুণ পরিণতি হয়৷ প্লাস্টিকের টুকরাগুলি খাবার জিনিস মনে করে তারা খেয়ে ফেলে, হজম করতে পারে না, মলের সাথে বের হয় না, অনেক সময় গলায় আঁটকে শ্বাসরোধ হয়ে মারা যায়৷
গবেষকরা অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে প্রতি দুইটির মধ্যে একটি সামুদ্রিক পাখির দেহে প্লাস্টিকের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন৷ এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে ২০৫০ সালের মধ্যে ৯৫ শতাংশ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে৷ বিশেষ করে মাছ, শামুক, তিমি, ডলফিন, কুমির ইত্যাদি প্রাণীগুলি ঝুঁকির সম্মুখীন৷
স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান
এইসব তথ্য শ্টেফানিকে খুব আঘাত দেয়৷ জার্মান পরিবেশ সহায়তা সমিতির সঙ্গে মিলে একটি ইন্টারনেট প্লাটফর্মে স্বাক্ষর সংগ্রহের অভিযান শুরু করেন এই তরুণী৷ এতে জার্মান সরকারের প্রতি পাতলা প্লাস্টিক ব্যাগের মূল্য ধার্য করার ব্যাপারে আইন প্রণয়ন করার আহ্বান জানানো হয়৷ এই উদ্যোগে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়৷ ইতোমধ্যে ১০০,০০০ স্বাক্ষর সংগৃহীত হয়েছে৷ জার্মান পরিবেশমন্ত্রীর কাছে এই তালিকা হস্তান্তর করবেন শ্টেফানি৷