সিমেন্ট আর পানি ছাড়া কংক্রিটে যা কিছু থাকে, পরিভাষায় তার নাম ‘অ্যাগ্রেগেট'৷ কিন্তু সেই অ্যাগ্রেগেটে যদি পুরনো ইনডাস্ট্রিয়াল ফাইবার, এমনকি পুরনো টায়ার বা প্লাস্টিকের টুকরো ঢোকানো থাকে, তাহলে তার নাম হয় ‘সবুজ কংক্রিট৷'
বিজ্ঞাপন
কংক্রিট বস্তুটি সবসময় আমাদের চারপাশেই রয়েছে, অথচ অদৃশ্য৷ সিমেন্ট, বালি বা নুড়ি আর পানি মিশিয়ে যে কংক্রিট তৈরি হয়, এ আমরা সকলেই জানি৷ শহরের বড় বড় বাড়িঘরের অস্থিমজ্জা হল এই কংক্রিট৷
সালের্নো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা আপাতত একটি ইউরোপীয় গবেষণা প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত, যার উপজীব্য হল কংক্রিট৷ সাধারণ কংক্রিটের উপাদান হল পানি, সিমেন্ট আর বালি, নুড়ি ইত্যাদি – বিজ্ঞানীরা তার সঙ্গে যোগ করেছেন ‘রিসাইকল্ড ইনডাস্ট্রিয়াল ফাইবার' বা শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত নানা ধরনের আঁশ বা তন্তু৷ উদ্দেশ্য: আরো বেশি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কংক্রিট তৈরি করা৷
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এনজো মার্তিনেলি জানালেন, ‘‘আমরা দেখার চেষ্টা করছি, কংক্রিটে সাধারণ ইনডাস্ট্রিয়াল ফাইবারের পরিমাণ কমিয়ে তার বদলে কীভাবেপুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্পোপযোগী তন্তু ব্যবহার করা যায় – এবং কংক্রিটের মান ও স্থিতিস্থাপকতার হানি না ঘটিয়ে তা করার চেষ্টা চলছে৷''
ময়লা দিয়ে ব্যবসা করেন তাঁরা
বর্জ্য, বিশেষ করে প্লাস্টিক বর্জ্যকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই ব্যবসা করছেন৷ এতে একদিকে যেমন পরিবেশের ভাল হচ্ছে, তেমনি কিছু মানুষের কর্মসংস্থানও হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Frentzen
বিলিকিস আদেবিয়ি-আবিওলা
যুক্তরাষ্ট্রে এমবিএ করার পর আইবিএম-এ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পাঁচ বছর কাজ করার পর নিজ দেশ নাইজেরিয়ায় গিয়ে বর্জ্য নিয়ে ব্যবসা করছেন৷ দেশটির সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত শহর লাগসের ময়লা নিয়ে ব্যবসা করছেন৷ কোম্পানির নাম ‘উইসাইকেলার্স’৷ তাদেরকে আবর্জনা দেয়ার মাধ্যমে স্থানীয়রা ‘উপহার’ পেয়ে থাকেন৷ আর আবিওলার কোম্পানি ঐ আবর্জনা থেকে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে৷ আরও জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: WeCyclers
থাটো গাটহানিয়া ও রেয়া এনগোয়ানে
দক্ষিণ আফ্রিকার এই দুই তরুণী প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে স্কুল ব্যাগ তৈরি করেন৷ দরিদ্র শিক্ষার্থীদের এগুলো দেয়া হয়৷ এ সব ব্যাগে সোলার প্যানেল বসানো আছে৷ ফলে শিক্ষার্থীরা হেঁটে স্কুলে যাওয়া-আসার ফলে প্যানেলগুলো যে চার্জ পায় তা দিয়ে রাতের বেলায় আলো জ্বলে৷ ফলে মোমবাতি না জ্বালিয়ে শিশুরা পড়তে পারে৷ ছবিতে একেবারে ডানে রেয়া আর বাম থেকে তিন নম্বরে থাটোকে দেখা যাচ্ছে৷ আরও জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: repurposeschoolbags.com/Screenshot
অ্যান্ড্রু মুপুয়া
মাত্র ১৬ বছর বয়সে স্কুলে পড়ার সময় বাবা-মা দু’জনই যখন চাকরি হারিয়ে ফেলেন তখন অ্যান্ড্রু কাগজের ব্যাগ তৈরির ব্যবসা শুরু করেন৷ পুঁজি জোগাড় করতে ৭০ কেজি প্লাস্টিক বোতল বিক্রি ও শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা ধার নেন তিনি৷ ব্যাগ তৈরি শিখতে ইন্টারনেট আর ভিডিওর সাহায্য নেন তিনি৷ বর্তমানে ২৪ বছর বয়সি অ্যান্ড্রুর অধীনে ২০ জন কাজ করছেন৷ আরও জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: DW
লরনা রুট্ট
ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে কেনিয়ার নাইরোবিতে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং ফ্যাক্টরি গড়ে তোলেন তিনি৷ এসব প্লাস্টিক দিয়ে তাঁর কোম্পানি বেড়া তৈরি করে৷ ঘরবাড়ি সহ সংরক্ষিত এলাকায় বেষ্টনী দিতে তাঁর বেড়া ব্যবহৃত হয়৷ কাঠের বদলে এ সব বেড়া খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে৷ আরও জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: L. Rutto
বেথেলহেম টিলাহুন আলেমু
আফ্রিকার ফুটওয়্যার ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে ইথিওপিয়ার ‘সোলরেবেলস’ বিশ্বে অনেক জনপ্রিয়৷ আলেমু’-র উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি গাড়ির পুরনো টায়ার, ফেলে দেয়া জামাকাপড় ব্যবহার করে জুতা তৈরি করে৷ আরও জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Frentzen
বাংলাদেশে রিসাইক্লিং ব্যবসা
প্লাস্টিক বোতল রিসাইকেল করে এমন অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে ঢাকায়৷ তাদের হয়ে পরিত্যক্ত বোতল সংগ্রহ করছেন অনেকে৷ এতে তাদের দারিদ্র্যতা দূর হচ্ছে৷ বোতলগুলো মেশিন দিয়ে টুকরো করে প্লাস্টিক পণ্য বানায় এমন কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়৷ কিছু অংশ বিদেশে, বিশেষ করে চীনেও রপ্তানি হয়ে থাকে৷ আরও জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.Uz Zaman
ওয়েস্ট কনসার্ন
বেশ কয়েক বছর ধরে ঢাকার বর্জ্য থেকে কমপোস্ট সার তৈরি করছে ওয়েস্ট কনসার্ন নামের একটি কোম্পানি৷ তাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটি এক লক্ষ মেট্রিক টনের বেশি বর্জ্য রিসাইকেল করেছে৷ বিস্তারিত জানতে উপরে ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: wasteconcern.org
7 ছবি1 | 7
রিসাইকল্ড পদার্থে সমৃদ্ধ এই পরীক্ষামূলক কংক্রিট বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা করা হয়: বেঁকিয়ে, চাপ দিয়ে, টেনে লম্বা করে ও চিরে দেখা হয়, চরম পরিস্থিতিতে ঐ কংক্রিটের কী প্রতিক্রিয়া হয়৷ আর্জেন্টিনার ইঞ্জিনিয়ার আন্তোনিও কাজিয়ানো সেজন্য সব ধরনের স্ট্রেস টেস্টের ব্যবস্থা করেছেন৷
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আন্তোনিও কাজিয়ানো যোগ করলেন, ‘‘আমরা বুঝেছি যে, রিসাইকল্ড ইনডাস্ট্রিয়াল ফাইবারের মূল সমস্যা হল তার জ্যামিতি৷ অন্য নানা কাজে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে তাদের জ্যামিতি আর নিয়মমাফিক বা মসৃণ নয়৷ কাজেই সেগুলি সিমেন্টের সাথে ভালোভাবে মেশে না৷''
কাজিয়ানো আরো বললেন, ‘‘নতুন ইনডাস্ট্রিয়াল ফাইবার আরো ভালোভাবে মেশে৷ যার অর্থ, আমরা এমন একটা কংক্রিট তৈরি করতে পারি যার যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি আরো বেশি সমজাতীয়, এবং সেই কারণে আরো বেশি নির্ভরযোগ্য৷''
কংক্রিটের ভিতরে কী ঘটে
যান্ত্রিক পরীক্ষা ছাড়াও গবেষকরা কম্পিউটার সিমিউলেশনের মাধ্যমে দেখার চেষ্টা করেন, চরম পরিস্থিতিতে কংক্রিটের ভিতরে কী ঘটে৷ তুকুমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হোসে গিয়ের্মো এৎসে বোঝালেন, ‘‘একাধিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে: যেমন কংক্রিটের ভিতরে প্রতিটি উপাদানের অনমনীয়তা, কংক্রিটের ভিতরকার আকার, রসায়ন, অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা, আর্দ্রতার পরিমাণ, কংক্রিটে কতটা ফাইবার আছে ও কী ধরনের ফাইবার – এই সব প্যারামিটার দিয়ে আমরা কংক্রিটের প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করি৷''
বিজ্ঞানীদের আশা যে, তাঁদের গবেষণার ফলে শীঘ্রই কলকারখানায় ‘সবুজ কংক্রিট' তৈরি হবে – যেমন এই কারখানাটি, যেখানে প্রতি বছর ষাট হাজার ঘনমিটার কংক্রিট তৈরি হয়৷ কোম্পানির ম্যানেজাররা বলছেন, তারা টেকসই, বিকল্প কংক্রিট উৎপাদন করতে রাজি – তবে একটি শর্তে৷
প্যাকেজিং বর্জ্য রোধে জার্মানির কী করা উচিত?
একদিকে জার্মানিকে যেমন পরিবেশ সচেতন দেশ হিসেবে বলা হয়ে থাকে, তেমনি আবার অন্যদিকে প্যাকেজিং আবর্জনার দিক দিয়ে ইউরোপের মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে দেশটি৷ তার কিছু নমুনা পাবেন এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/Rainer Hackenberg
অপচয়ে জার্মানি এগিয়ে
প্রতিটি জার্মান বছরে গড়ে ২১৩ কিলোগ্রাম, অর্থাৎ দিনে ৬০০ গ্রামের বেশি প্যাকেট আবর্জনা ফেলে৷ সেই হিসেব ফ্রান্সে ফেলা হয় ১৮৫ কিলোগ্রাম৷ অস্ট্রিয়ায় ১৫০ এবং সুইডেনে জন প্রতি বছরে গড়ে ১০৯ কিলোগ্রাম বর্জ্য ফেলা হয়ে থাকে৷ এই পরিসংখ্যানটি জানা গেছে জার্মানির পরিবেশ সংগঠন ‘ডয়চে উমভেল্টহিল্ফে’ বা ডিইউএইচ৷
ছবি: DW/A. Maciol
অপচয় বৃদ্ধি
যদিও সরকার নানাভাবে কমানোর চেষ্টা করছে, তারপরও গত এক দশকে জার্মানিতে প্যাকেট আবর্জনার অপচয় বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ১৩ ভাগ৷
ছবি: picture alliance/dpa/P.Pleul
‘ওয়ান-টাইম’ ইউজ
রিসাইক্লিং-এর জন্য জার্মানিতে প্লাসটিকের বোতল ফেরত দেওয়া হয়, তবে কিছু কোম্পনি আর সেগুলো ফেরত নিতে তেমন আগ্রহী নয়৷ তারা ‘ওয়ান টাইম’ বা মাত্র একবার ব্যবহারযোগ্য ছোট বোতলের ব্যবহার বাড়াতে চায়৷
ছবি: picture-alliance/Rainer Hackenberg
প্লাস্টিক ব্যাগ
প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার কমাতে কিছু কোম্পানি স্বেচ্ছায় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে৷ যেমন জার্মনির দ্বিতীয় বৃহত্তম সুপার মার্কেট ‘রেভে’ গত জুন মাস থেকে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে৷ এই চেইন শপের মতে, এভাবেই ১৪০ মিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার কমানো সম্ভব৷
ছবি: Fotolia/rdnzl
কাপড়ের ব্যাগ
কিছুদিন আগে পর্যন্তও যে কোনো পণ্য কেনা হলে স্বাভাবিকভাবেই সাথে একটি ব্যাগ দেওয়া হতো৷ তবে এখন ব্যাগের সাইজ অনুযায়ী দশ, বিশ বা পঞ্চাশ সেন্ট মূল্যে ব্যাগ পাওয়া যায়৷ লক্ষ্যণীয় যে, ইদানীং পরিবেশ সচেতন প্রায় সকলের কাছেই কাপড়ের ব্যাগ থাকে৷ যা কিনা সহজেই ছোট করে ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে রাখা যায়৷
ছবি: DUH
পরিবেশবান্ধব নয়, তবে ট্রেন্ড
ছোট্ট, ছোট্ট প্লাস্টিকের ফেলে দেওয়া যে কাপগুলো দেখছেন, এগুলোতে কফি ভরা থাকে৷ একটি কাপ মেশিনে ঢুকিয়ে দিলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ধূমায়িত ও অতুলনীয় স্বাদের এককাপ কফি খুব সহজেই তৈরি হয়ে যায়৷ বর্তমানে জার্মনিতে এই কফি অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও তা কিন্তু মোটেও পরিবেশবান্ধ নয়৷ কারণ এই কফি পান করলে সাধারণ কফির তুলনায় আবর্জনা হয় ১৬ গুণ বেশি৷
ছবি: picture alliance/dpa/L.Sojka
পরিবেশবান্ধব
জার্মানির ভুপার্টাল শহরে জলবায়ু, পরিবেশ ও জ্বালানি বিষয়ক প্রতিষ্ঠানটি মনে করে, বিভিন্ন কোম্পানি যদি পরিবেশ বান্ধব হয়, তাহলে শতকরা ২০ভাগ বর্জ্য কমানো সম্ভব জার্মানিতে৷
7 ছবি1 | 7
কংক্রিট তৈরির কোম্পানির কোয়ালিটি ম্যানেজার মাউরো মেলে বললেন, ‘‘আমরা ইতিমধ্যেই আমাদের কংক্রিটে শতকরা ১০০ ভাগ রিসাইকল্ড পানি ব্যবহার করি৷ আমরা খুব খুশি হয়ে রিসাইকল্ড ফাইবারের মতো পুনর্ব্যবহারযোগ্য ‘অ্যাগ্রেগেট' ব্যবহার করব, যদি তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের উপযোগী হয়৷''
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এনজো মার্তিনেলি আরেকটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করলেন: ‘‘উদ্ভিদ তন্তু দিয়ে সমৃদ্ধকৃত সবুজ কংক্রিট পুরনো বাড়িঘর মজবুত করার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে – যেমন ঐতিহাসিক বাড়িঘর৷ ওটা একটা ভালো, টেকসই বিকল্প, কেননা ওটা এমন সব পদার্থ থেকে তৈরি, পরিবেশের উপর যাদের প্রভাব অনেক কম ও পরিবর্তনীয়৷ যেহেতু ঐ কংক্রিট বাড়ির কাঠামো তৈরির কাজে ব্যবহার হচ্ছে না, কাজেই প্রযোজনে অন্য কংক্রিট দিয়ে তা পালটে দেওয়া যাবে৷''
পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্পোপযোগীতন্তু ও উদ্ভিদজাত তন্তু ছাড়াও বিজ্ঞানীরা আগামীতে পুরনো গাড়ির টায়ার ও পুরনো প্লাস্টিক ব্যবহার করে উচ্চমানের সবুজ কংক্রিট তৈরির আশা রাখেন৷