দক্ষিণ আফ্রিকায় পরিবেশ বিপর্যয়ের ধাক্কা বিশেষ করে দরিদ্র ও কৃষ্ণাঙ্গ শ্রেণিকে আঘাত করে৷ নারীদের জন্য তা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে৷ এক সাহসি নারী অভিনব এক প্রকল্পের মাধ্যমে আশার আলো আনছেন৷
বিজ্ঞাপন
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ শহরের মধ্যে ও চারিদিকে খনির আবর্জনা স্তূপ৷ আর্সেনিক, সীসা, দস্তা ও তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম মাটিকে বিষাক্ত করে তুলেছে৷ গত কয়েক বছরে আরও ঘনঘন জোরালো বৃষ্টি ও বালুঝড় দেখা যাচ্ছে৷ ফলে বাতাস বিষাক্ত ধুলা গোটা এলাকায় আরও ছড়িয়ে দিচ্ছে৷
ডিভিলে মোকোয়েনা এমনই এক প্রেক্ষাপটে পরিবেশ অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে উঠেছেন৷ তাঁর দিদির দুই ছেলে রয়েছে৷ সোয়েটো টাউনশিপে বাপের বাড়িতেই তারা থাকে৷ সেই বাড়িতেই ডিভিলে ছেলেবেলা কাটিয়েছেন৷ জলবায়ু পরিবর্তনযে সবার আগে গরিব মানুষের ক্ষতি করে, তাঁর দ্রুত সেই উপলব্ধি হয়েছিল৷ ডিভিলে বলেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তন শুধু পরিবেশের সমস্যা নয়৷ সেটি উন্নয়নের উপর প্রভাব রাখে, মানবাধিকার খর্ব করে, সামাজিক সমস্যা হয়ে ওঠে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতির দিকে নজর দিয়ে তার প্রস্তুতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করলে বোঝা যায়, যে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি বিপন্ন৷''
পরিবেশ রক্ষায় নারীদের লড়াই
05:20
ডিভিলে দক্ষিণ আফ্রিকায় অ্যাপারথাইড বা বর্ণবৈষম্যের যুগে বড় হয়েছেন৷ শৈশবেই তিনি টের পেয়েছিলেন, কীভাবে দরিদ্র ও কৃষ্ণাঙ্গদেরই খনির আবর্জনার স্তূপ সামলাতে হয়৷ শ্বেতাঙ্গ ধনী পাড়া থেকে নিরাপদ দূরত্বে, টাউনশিপগুলির পাশেই সেই আবর্জনা ফেলা হতো৷
নারীদের দ্বিগুণ সমস্যার মুখে পড়তে হতো৷ পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে সবার ক্ষতি হলেও পিতৃতান্ত্রিক সমাজে তাদের আত্মরক্ষার সুযোগ ছিল অনেক কম৷ ডিভিলে-কেও সেই সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘ঐতিহ্য অনুযায়ী পুরুষরা বিয়ের পর প্রথম সন্তান হিসেবে ছেলে প্রত্যাশা করে৷ আমার জন্মের পর বাবা-মা দেখলেন, তাদের তৃতীয় সন্তানও মেয়ে৷ বাবা বললেন, যথেষ্ট হয়েছে, আর মেয়ে নয়৷ আমার নামের অর্থও তাই – ‘যথেষ্ট হয়েছে'৷''
ডিভিলে চার বোনের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন৷ তাঁর বাবা ছিলেন গর্বিত পুরুষ৷ তিনি পরিবারের দেখাশোনা করতেন৷ কিন্তু অন্যদিকে ঐতিহ্যও মেনে চলতেন৷ তাই মেয়েদের প্রশিক্ষণে বিনিয়োগের কোনো কারণ দেখেননি৷
ডিভিলে তা সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন৷ পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য যথেষ্ট আয় করতেন৷ প্রথমে ব্যাংকের কেরানি হিসেবে, তারপর বড় এক জাতীয় সংবাদপত্রের বিপণন বিভাগে কাজ করেছেন৷ একই সময়ে তিনি বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পেও সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি৷ তারপর চাকুরি ছেড়ে সোয়েটো টাউনশিপে পরিবেশ সংরক্ষণে প্রচার অভিযান আয়োজন শুরু করেন তিনি৷
পরিবেশ রক্ষায় নারী
পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছেন বিশ্বের অনেক নারী৷ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে কয়েকজন নেতৃস্থানীয় নারী পরিবেশবাদী সম্পর্কে জানুন এখানে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
বাংলাদেশের পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ রক্ষায় অবদানের জন্য প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ‘‘গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজ’’ পান৷ এছাড়া ২০০৯ সালে টাইম সাময়িকী তাঁকে ‘‘হিরোজ অফ এনভায়রনমেন্ট’’ খেতাব দেয়৷ এরপর ২০১২ সালে ‘রামন ম্যাগসেসে’ পুরস্কারও পান তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বন্দনা শিবা
দিল্লির এই পরিবেশকর্মী জিএম খাবারের বিরোধী৷ এমনকি বিশ্বের যেসব কোম্পানি জিএম খাবারের প্রচারণা চালায় তাদেরও বিপক্ষে বন্দনা শিবা - যিনি একজন পদার্থবিদ ও ‘নবদন্য’ নামে একটি এনজিও’র প্রধান৷ জীববৈচিত্র্য রক্ষা, অর্গানিক খাবার এবং কৃষক অধিকার নিয়ে কাজ করে বেসরকারি এই সংস্থাটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হাবিবা সরাবি
আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশের গভর্নর হাবিবা সরাবি যুদ্ধ বিধ্বস্ত এই দেশটির প্রথম ন্যাশনাল পার্ক গড়ে তুলেছেন৷ ব্যান্ড-ই-আমির নামের এই পার্কে ছয়টি গভীর নীল হ্রদ রয়েছে৷ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে হ্রদগুলো রক্ষায় কাজ করেছেন তিনি৷
ছবি: STEPHEN JAFFE/AFP/Getty Images
ইভা মেন্ডেস
পশু রক্ষায় নগ্ন! পশুর লোম দিয়ে পোশাক তৈরি করে অনেক কোম্পানি৷ সেটা বন্ধ করতে পেটা নামের একটি সংস্থা প্রচারণা শুরু করে৷ কিন্তু সেটা জোরালো হয় যখন বিখ্যাত অভিনেত্রীরা নগ্ন হয়ে পোজ দেন৷ এর মাধ্যমে অভিনেত্রীরা বোঝাতে চেয়েছেন যে, পশুর লোমের পোশাকের চেয়ে বরং নগ্ন থাকাই ভাল৷ মার্কিন অভিনেত্রী ইভা মেন্ডেস তাঁদেরই একজন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কারেন ক্রিস্টিয়ানা ফিগেরেস ওলসেন
জাতিসংঘের প্রধান জলবায়ু বিষয়ক কর্মকর্তা থাকাকালীন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে একটা বৈশ্বিক চুক্তির জন্য কাজ করেন তিনি৷ এছাড়া কোস্টারিকার এই নারী তাঁর মহাদেশ দক্ষিণ অ্যামেরিকার বিভিন্ন দেশের জাতীয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা বিষয়ক কর্মসূচি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্রিটানি ট্রিলফোর্ড
নিউজিল্যান্ডের এই তরুণী গত বছর রিও+২০ সম্মেলনে পরিবেশ রক্ষা বিষয়ে উৎসাহমূলক বক্তব্য দেন৷ সেসময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৭৷ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘‘আজ এই মুহূর্তে আমি একজন শিশু – আপনাদের শিশু৷ আমরা সবাই জানি যে সময় চলে যাচ্ছে, দ্রুত চলে যাচ্ছে৷’’
ছবি: REUTERS
ওয়াঙ্গারি মাথাই
কেনিয়ার নোবেলজয়ী এই নারী ৩০ বছর ধরে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করেছেন৷ এ সময় আফ্রিকা মহাদেশের অসংখ্য নারীকে দিয়ে তিনি প্রায় ৩০ মিলিয়ন গাছ লাগিয়েছেন৷ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি ২০১১ সালে মারা যান৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বারবারা উনম্যুসিশ
জার্মানির বারবারা উনম্যুসিশ একাধারে লেখক, রাজনীতিক ও পরিবেশকর্মী৷ পরিবেশ রক্ষায় তিনি ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমি, ইকোলজি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা গড়ে তুলেছেন৷ এই সংস্থা ‘সবুজ ইউরোপ’ গড়ে তোলার পক্ষে কাজ করছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
8 ছবি1 | 8
আজ তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘জেন্ডার ইনটু আর্বান ক্লাইমেট চেঞ্জ' নামের এক উদ্যোগের সমন্বয়ক৷ জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি সামলানোর ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বে নারীদের ভূমিকা জোরালো করছেন তিনি৷ জোহানেসবার্গ শহরে এক কর্মশালায় সমন্বয়করা নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করছেন ও চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন৷
দক্ষিণ আফ্রিকায় এই উদ্যোগ দু'টি শহরের সঙ্গে কাজ করে – শোয়ানে ও জোহানেসবার্গ৷ ডিভিলে শহুরে এলাকায় পরিবেশবান্ধব কৃষিকাজে বিশেষভাবে আগ্রহী৷ জোহানেসবার্গ শহরের মাঝে জুবার্ট পার্কে সেই স্বপ্ন এর মধ্যেই বাস্তব হয়ে উঠেছে৷
পরিত্যক্ত এক গ্রিনহাউসে আজ শাকসবজি ও জড়িবুটির চাষ হচ্ছে৷ এই সমবায় দুই বেকার নারীকে কাজ দিয়েছে৷ ডিভিলে মোকোয়েনা বলেন, ‘‘এই দুই তরুণীর বাসার কাছে নিজস্ব জমি রয়েছে৷ স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে তাঁরা গ্রিনহাউসের দেখাশোনা করেন৷''
জলবায়ু পরিবর্তনে মেয়েদের ক্ষতি হয় বেশি
01:11
This browser does not support the video element.
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি পদ্ধতিরও পরিবর্তন করতে হচ্ছে৷ ‘গার্ডেন ফর দি উইমেন' প্রকল্প নারীদের আরও টেকসই পদ্ধতিতে উৎপাদনের প্রশিক্ষণ দেয়৷ এভাবে তারা নিজের আয় বাড়িয়ে সমাজে খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে পারবে৷ সেই প্রকল্পে যুক্ত মামোসওয়েউ সোয়াবি৷ তিনি বলেন, ‘‘গ্রিনহাউসে আমরা অরগ্যানিক শাকসবজি চাষ করি৷ এই প্রয়াস আমাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করছে৷ স্থানীয় বাজারেই আমরা শাকসবজি বিক্রি করি৷ ফলে প্রতি সপ্তাহে আমাদের আয় হয়৷''
রাজনীতিকদের নজর আকর্ষণ করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ৷ শহর কর্তৃপক্ষ গ্রিনহাউস সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল৷ তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে অর্থায়ন কমিয়ে দেওয়া হয়৷ ডিভিলে বলেন, ‘‘এখনো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে৷ তবে তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মূল্যায়ন, তাদের সমালোচনা করে উন্নতির প্রস্তাব পেশ করতে করতে আমরা ক্লান্ত হবো না৷ ঘাটতি দেখলেই মুখ খুলবো৷''
এমন কাজের জন্য তাঁর সাহস ও ধৈর্যের শেষ নেই৷
স্টেফান ম্যোল/এসবি
পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা
পরিবেশ নিয়ে জার্মানরা বরাবরই সচেতন৷ তা জৈব খাবার হোক, জ্বালানি সাশ্রয় কিংবা আবর্জনা আলাদা বা পুনর্ব্যবহার করা – এ সব নিয়ে জার্মানদের ভাবনার শেষ নেই৷ তবে এরপরও অনেকেরই রয়েছে নানা ভুল ধারণা৷ তারই কিছু নমুনা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দেশীয় ফল ও সবজি
দেশীয় ফল ও সবজি খাওয়ার কথা আজকাল প্রায়ই শোনা যায়৷ কিন্তু নিজের দেশের শাক-সবজি ও ফল তখনই ভালো, যদি সেসব ফ্রিজে রাখা না হয়৷ অর্থাৎ মৌসুমি ফল আর সবজি৷ ফ্রিজে খাবার সংরক্ষণে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়, বিদেশ থেকে জাহাজে পণ্য পরিবহণ করতে তার চেয়ে অনেক কম নিঃসরণ হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
পানির অপচয় নয়
দাঁত ব্রাশের সময় ট্যাপের পানি ছেড়ে রাখা মানেই পানির অপচয়! তাই পানির খরচ কমাতে প্রায় সকলেই এ ব্যাপারে সচেতন জার্মানিতে৷ কিন্তু পানির বড় বড় পাইপগুলোতে জলবণ্টন বা পানির ফোর্স বাড়ানোর যে বাড়তি জল দেওয়া হয়, তা নিয়ে কেউ ভাবেন না৷ এতে যে জল অপচয় হয়, তা নিয়ে প্রশ্নও করেন না কেউ!
ছবি: picture-alliance/dpa/J.Büttner
বিদ্যুৎ সাশ্রয়
জার্মানিতে অনেকেই এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়ার সময় লাইট অফ করে যান৷ ধারণা, এতে করে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে৷ কিন্তু সেটা মোটেই ঠিক নয়৷ বরং কিছুক্ষণ পর আবারো নতুন করে লাইট ‘অন’ হতে যে জ্বালানি খরচ হয়, তা কিছুক্ষণ ‘অফ’ থাকার চেয়ে অনেক বেশি৷
ছবি: Fotolia/Marco2811
ওয়াশিং মেশিনের শর্ট প্রোগ্রাম বিদ্যুৎ বাঁচায়?
মেশিনে কাপড় ধোয়ার সময় ‘শর্ট প্রোগাম’ বা দ্রুত কাচার ‘অপশন’-টি বেছে নিলে কম জ্বালানি খরচ হয় বলেই বিশ্বাস করেন কেউ কেউ৷ এটাও কিন্তু সঠিক নয়৷ কারণ অনেকক্ষণ ধরে মেশিন চললে এবং ধীরে ধীরে চললে জ্বালানি খরচ তো কম হয়ই, কাপড়ও ভালো পরিষ্কার হয়৷ হালের মেশিনগুলোতে অবশ্য পরিবেশবান্ধব ‘ইকো প্রোগ্রাম’ রয়েছে, যা জ্বালানি সাশ্রয় করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/gms AEG
হাত দিয়ে বাসন ধোয়া কি পরিবেশবান্ধব?
মোটেই না৷ কারণ ট্যাপের গরম পানি ছেড়ে রেখে একটি করে বাসন ধুলে, বিদ্যুৎ এবং পানি দু’টোরই বেশি খরচ হয়৷ অন্যদিকে মেশিনে ধোয়ার সময় বিদ্যুৎ ও পানি – দু’টোই কম খরচ হয়৷ তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি ডিশওয়াশারটি বাসন দিয়ে পুরো ভরে নিয়ে তারপর চালানো হয়৷ এতে কম খরচে একসঙ্গে অনেক বাসন ধোয়া হয়ে যায়!