পরিযায়ী পাখিরা হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে পৌঁছে যায়৷ কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাদের যাত্রাপথ বদলে যাচ্ছে৷ বিজ্ঞানীরা এক অভিনব উপায়ে তাদের গতিবিধির উপর নজর রাখছেন৷
বিজ্ঞাপন
প্রতি বছর আগস্ট মাসে সারস পাখিদের যাত্রা শুরু হয়৷ ইউরোপে তাদের চারণক্ষেত্র থেকে আফ্রিকায় শীতকালীন আশ্রয়স্থল পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়৷ তবে সম্ভবত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাদের যাত্রাপথ বদলে যাচ্ছে৷ পৃথিবীর বুকে এই পরিবর্তনের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷
মিশায়েল কাৎস সারস পাখিদের শরীরে হাইটেক ট্রান্সমিটার লাগিয়ে জানতে চান, পাখিগুলি পরিবর্তনশীল জলবায়ুর কারণে কী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘জিপিএস ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট ব্যবস্থার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তা পাঠানো হয়৷ অর্থাৎ ট্রান্সমিটারে বসানো সিম কার্ডের মাধ্যমে সারসের অবস্থান দেখা যায়৷''
মাক্স প্লাংক ইন্সটিটিউটের সহকর্মী মার্টিন ভিকলেস্কিকে নিয়ে মিশায়েল কাৎস নতুন এই প্রযুক্তি পরীক্ষা করে দেখছেন৷ অ্যান্টেনার মাধ্যমে তাঁরা ট্রান্সমিটার বসানো পাখিগুলির অবস্থান নির্ণয় করছেন৷ এই প্রযুক্তিকে সফল হতে হবে, কারণ গবেষকদের বড় এক লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে৷ তাঁরা চান, মাইক্রো-ট্র্যাকার সারস পাখির গোটা জীবন ধরে তথ্য প্রেরণ করে যাবে৷ পক্ষীবিজ্ঞানী ড. মার্টিন ভিকলেস্কি বলেন, ‘‘এর মধ্যেই আমরা আমাদের গ্রহের পরিবর্তনগুলি দেখতে পাচ্ছি৷ আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, পাখিরা কোনদিকে যাচ্ছে, ২০ বছর আগে কোথায় যেত৷ তাদের যাত্রাপথে কী পরিবর্তন এসেছে এবং বিগত কয়েক বছরে ঠিক কী কী পরিবর্তন ঘটেছে?''
পাখিদের অভয়াশ্রম বাইক্কা বিল
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের পূর্ব পাশের প্রায় একশ হেক্টর আয়তনের জলাভূমিই বাইক্কা বিল৷ নানান শ্রেণির দেশি আর পরিযায়ী পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থল এই বিল৷
ছবি: DW/M. Mamun
পরিযায়ী পাখির দল
বাইক্কা বিলের আকাশে ডানা মেলা পরিযায়ী পাখির দল৷ দেশি ও পরিযায়ী মিলে প্রায় ১৬০ প্রজাতির পাখির অভয়াশ্রম এই বিল৷
ছবি: DW/M. Mamun
পদ্ম ফুলে সমারোহ
পদ্ম ফুলে ভরা বাইক্কা বিল৷ শীতের শেষে বাইক্কা বিলে ফুটতে শুরু করে পদ্ম ফুল৷ এপ্রিলের শেষ অবধি বিলজুড়ে দেখা যায় পদ্ম ফুলের সমারোহ৷
ছবি: DW/M. Mamun
কায়েম পাখি
বাইক্কা বিলের কচুরিপানার মাঝে এক দল পার্পল সোয়াম্প হেন বা কায়েম পাখি৷ সারা বছরই দেশি এ পাখিটির দেখা মেলে এই বিলে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বড় বক
বাইক্কা বিলে একটি গ্রেট এগরেট বা বড় বক৷ এটিও একটি স্থানীয় পাখি এবং সারা বছরই বিলে কমবেশি এদের আনাগোনা থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ছোট্ট ডুবুরি পাখি
বাইক্কা বিলে লিটল গ্রেবে বা ছোট ডুবুরি৷ দেশি এই বিরল পাখিটি বাইক্কা বিলে সারা বছরই কমবেশি দেখা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
জল মোরগ
বাইক্কা বিলে কমন মুর হেন বা জল মোরগ৷ এ পাখিটিও দেশি পাখি৷
ছবি: DW/M. Mamun
ধূসর বক
গ্রে হেরন বা ধুপনি বক বা ধূসর বক নামেও এটি পরিচিত৷ দেশি এই পাখিটি বাইক্কা বিলে প্রচুর দেখা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
ছোট্ট পানকৌড়ি
বাইক্কা বিলে এক দল লিটল করমোর্যান্ট বা ছোট পানকৌড়ি৷ বাংলাদেশের আবাসিক এ পাখিটিও সারা বছর দেখা যায় এ বিলে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বড় পানকৌড়ি
ডানা মেলে রোদ পোহানো এ পাখিটির নাম গ্রেট করমোর্যান্ট বা বড় পানকৌড়ি৷ পরিযায়ী এ পাখিটি শীতে দেখা যায় বাইক্কা বিলে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সাপ পাখি
ওরিয়েন্টাল ডার্টার বা সাপ পাখি৷ সাপের মতো লম্বা গলার বিরল এই পাখিটি বাইক্কা বিলে দেখা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
দেশি ও পরিযায়ী পাখি
বাইক্কা বিলে একদল দেশি ও পরিযায়ী পাখি৷ বিলের পশ্চিম প্রান্তে নির্জনে এরকম পাখির দল বেশি দেখা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
কালো মাথার কাস্তেচরা
বাইক্কা বিলের পশ্চিম প্রান্তে খাবারের খোঁজে একদল ব্লাক হেডেড আইবিস বা কালো মাথার কাস্তেচরা৷ পাখিটি দেখলে মনে হয় এর মাথা আলকাতরায় ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে৷ বাইক্কা বিলে শীতের সময় বিরল এ পাখিটি দেখা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
শামুকখোল পাখি
বাইক্কা বিলে বাংলাদেশের আবাসিক পাখি এশিয়ান ওপেনবিল বা শামুকখোল৷
ছবি: DW/M. Mamun
লেঞ্জা হাঁস
পিনটেইল বা লেঞ্জা হাঁস৷ পরিযায়ী এ পাখিটি শীতে দেখা যায় বাইক্কা বিলে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পাতারি হাঁস
বাইক্কা বিলে শীতের পরিযায়ী পাখি কমন তিল বা পাতারি হাঁস৷
ছবি: DW/M. Mamun
খুন্তে হাঁস
বাইক্কা বিলে নর্দান শোভেলার বা খুন্তে হাঁস৷ পরিযায়ী এ পাখিটি বাইক্কা বিলে শীতে দেখা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
আলোকচিত্রীদের ভিড়
ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফারদের কাছে বাইক্কা বিল একটি পছন্দের জায়গা৷ শীতে জায়গাটিতে আলোকচিত্রীদের আনাগোনা বেশি থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পাখি দেখা
বাইক্কা বিলে ছোট নৌকায় চড়ে পর্যটকরা পাখি দেখতে পারেন৷ এছাড়া বিলের পাশে পর্যটকদের জন্য দুটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারও আছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
18 ছবি1 | 18
যত বেশি সংখ্যক সারস পাখি অনুসরণ করা হবে, বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর অবস্থা সম্পর্কে তত বেশি তথ্য জানতে পারবেন৷ তার জন্য যাত্রা শুরুর আগে কম ও বেশি বয়সি সারস পাখিদের শরীরে ট্রান্সমিটার বসাতে হবে৷ কাজটা মোটেই সহজ নয়, কারণ সারস পাখি স্বভাবে বড়ই লাজুক৷ তবে তাদের কী ভাবে ধরতে হয়, মিশায়েল কাৎস তা জানেন৷ সারস পাখি ঘাসের উপর নেমে খাবারের খোঁজ করার সময় বিশেষ এক ধরনের ফাঁদের সাহায্যে তিনি তাদের বন্দি করেন৷ তারপর ধীরে-সুস্থে তাদের শরীরে ট্রান্সমিটার লাগানোর পালা৷ পিঠে রাকসাক ব্যাগ গলিয়ে নেওয়ার মতো ট্রান্সমিটার লাগানো হয়৷ পাখিটিকে শান্ত রাখতে কাপড় দিয়ে তার চোখ ঢেকে দেওয়া হয়৷ পাখির কাছে অন্ধকার মানেই ঘুম৷ সবার শেষে পরীক্ষা করতে হয়, মিনি ট্র্যাকার ঠিকমতো লাগানো হয়েছে কিনা৷ ড. মিশায়েল কাৎস বলেন, ‘‘এটি একটি ট্রায়াক্সিকাল অ্যাক্সিলারেটর সেন্সর এবং তার গতি দেখে বোঝা যায় সারস পাখিটি কী করছে৷ যেমন সে বসে আছে অথবা নিজের পালক সাফ করছে৷ মানে শুধু তার অবস্থান নয়, সেখানে সে কী করছে, সেটা জানতে পারা সত্যি বিস্ময়কর৷''
শুধু পাখিদের আচরণ ও যাত্রাপথ নয়, এত তথ্যের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে আরও অনেক বিষয় জানতে চান৷ যাত্রাপথের পরিবর্তনে সূক্ষ্ম তারতম্য ইঙ্গিত দিতে পারে, যে সেই এলাকায় পঙ্গপালের উৎপাত, খরা অথবা রোগের প্রকোপ আছে কিনা৷
সারস পাখি যদি ভবিষ্যতে হাইটেক প্রযুক্তির কল্যাণে ধারাবাহিকভাবে তথ্য দিয়ে যায়, তার ভিত্তিতে আমাদের গ্রহের অবস্থা আরও নিখুঁতভাবে জানা যাবে৷
প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি: হামিংবার্ড
মাত্র তিন থেকে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা এই পাখিগুলির চেহারা, খাবার-দাবার, আচার-আচরণ, সবই অসাধারণ৷ ফুলের মধু খায় মৌমাছিদের মতো; পিছন দিকে উড়তে পারে পোকামাকড়ের মতো; আবার হাজার হাজার মাইল পরিভ্রমণ করে...
ট্রকিলিডে পরিবারের ক্ষুদ্রতম সদস্য এই ‘বি হামিংবার্ড’ বা মৌমাছি হামিংবার্ড, ঠোঁট সুদ্ধু মাত্র দুই ইঞ্চি লম্বা, ওজনে আড়াই গ্রাম বা দু’টি ডাক টিকিটের সমান৷ হামিংবার্ডরা সাধারণত তিন থেকে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা হয়৷ এদের বাস প্রধানত দক্ষিণ ও উত্তর অ্যামেরিকায়৷ পক্ষীবিজ্ঞানীরা ৩০০ থেকে ৩৫০ ধরনের হামিংবার্ড শনাক্ত করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/DUMONT/T. Hauser
তলোয়ারঠুঁটো
হামিংবার্ডরা প্রধানত ফুলের মধু খেয়ে বেঁচে থাকে৷ ফুলের মধ্যে ঠোঁট ঢুকিয়ে খায় বলে নানা ফুলের আকার অনুযায়ী হামিংবার্ডদের ঠোঁটের আকারেরও বিবর্তন ঘটেছে৷ ছবিতে যে তলোয়ারঠুঁটো হামিংবার্ডকে দেখা যাচ্ছে, শরীর (এবং লেজের) তুলনায় তার ঠোঁটের দৈর্ঘ্য পৃথিবীর অন্য যে কোনো পাখির চেয়ে বেশি৷
ছবি: picture-alliance/WILDLIFE/P.Oxford
পাখা ঝাপটায় বিদ্যুৎগতিতে
হামিংবার্ড নামটা এসেছে ‘হামিং’ বা অতি দ্রুত পাখা ঝাপটানোর একটানা শব্দ থেকে, যেন ভোমরার গুঞ্জন৷ সাধারণভাবে হামিংবার্ডরা সেকেন্ডে ৫০ বার পাখা ঝাপটায় – ওরা আবার পাখা ঝাপটায় ইংরেজি আটের মতো করে, সামনে ও পিছনে, ফলে ওরাই একমাত্র পাখি, যারা সামনের দিকে আবার পিছনের দিকেও উড়তে পারে৷ আর হেলিকপ্টারের মতো বাতাসে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পাখা নাড়া তো আছেই, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘হোভারিং’, যেমন ‘হোভারক্রাফ্ট’৷
ছবি: picture-alliance/Arco Images
উচ্চগতিতে বেঁচে থাকা
হামিংবার্ডদের হৃৎস্পন্দন মিনিটে ১,২৬০ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে, যেখানে মানুষের হৃৎস্পন্দন থাকে মিনিটে ৬০ থেকে ৮০-র মধ্যে৷ হামিংবার্ডরা মিনিটে ২৫০ বার অবধি নিঃশ্বাস নিতে পারে৷ হামিংবার্ডদের শরীরের সাধারণ তাপমাত্রা ৪০ কি ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রাতে তা কমে দাঁড়ায় ১৮ ডিগ্রিতে, হৃৎস্পন্দন কমে হয় মিনিটে ৫০ থেকে ১৮০৷ হামিংবার্ডরা এই সময় যে অর্ধচেতন অবস্থায় থাকে, তাকে ইংরেজিতে বলে ‘টর্পর’৷
ছবি: picture alliance/chromorange/G. Fischer
মেটাবলিজম
পরিভাষায় যাকে বলে বিপাক, অথবা সহজ কথায়, শরীর যেভাবে খাদ্যকে শক্তিতে পরিণত করে ও সেই শক্তি ব্যয় করে৷ হামিংবার্ডদের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াটি জীবজগতে দ্রুততম৷ তাই বেচারাদের প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর মধু আহরণ করতে হয় – চিনির হিসেবে তারা প্রতিদিন নিজের ওজনের অর্ধেক পরিমাণ চিনি খায়৷ ফুলের মধু শরীরে গিয়ে শক্তিতে পরিণত হতে ৪৫ মিনিটের বেশি লাগে না৷
ছবি: AP
দূরের পথ
ছবিতে যে রুবি-থ্রোটেড হামিংবার্ড পাখিটিকে দেখা যাচ্ছে, তারা মেক্সিকো উপসাগরের উপর দিয়ে ৮০০ কিলোমিটার উড়ে গিয়ে অপর পাড়ে পৌঁছায় – একবারও না থেমে৷ অপরদিকে মাত্র তিন ইঞ্চি লম্বা রুফাস হামিংবার্ড গ্রীষ্মের শেষে অ্যালাস্কা থেকে মেক্সিকোয় যায় ৩,৯০০ মাইল পার হয়ে – যা কিনা তার আকারের হিসেবে পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে দীর্ঘতম যাত্রা৷
বহু প্রজাতির হামিংবার্ড মাকড়শার জাল আর শ্যাওলা দিয়ে তাদের ছোট্ট বাসাগুলোকে বেঁধে রাখে৷ এর ফলে বাসার কাঠামোটা ভালো হয়, আবার মাকড়শার জাল টানলে বাড়ে বলে, বাচ্চা হামিংবার্ডরা যত বড় হতে থাকে, বাসাটাও তত বড় হতে থাকে৷ হামিংবার্ডরা দু’টি ছোট সাদা ডিম পাড়ে – স্বভাবতই সেগুলো পক্ষিজগতের সবচেয়ে ছোট ডিম৷ তবে তা থেকে দুই কি তিন সপ্তাহ পরে বের হয় দু’টি কচি হামিংবার্ড...